‘ইউটোপিয়া’ ও আমার সোনার বাংলা

ঈশিতা বিনতে শিরীন নজরুলঈশিতা বিনতে শিরীন নজরুল
Published : 28 March 2018, 12:49 PM
Updated : 28 March 2018, 12:49 PM

জার্মানিতে কয়েক মাস পরপরই স্বাস্থ্যের রুটিন চেকআপ হয়। এমনকি অামি দীর্ঘদিন পুত্রকে নিয়ে যাইনি বলে তারা রীতিমত চিঠি পাঠিয়ে নিয়ে যেতে অনুরোধ করলো। এদের স্বাস্থ্যসেবায় আমি যারপরনাই মুগ্ধ! ভাল কিছু দেখলেই মনে হয়, আহ! আমাদের দেশে যদি এমনটা করা যেত! দেশে থাকতে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করার বেশ অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে। তাই তুলনা মনের অজান্তেই চলে আসে। যেদিন বাংলাদেশ জুড়ে উৎসবের ঘনঘটা হলো উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতিতে , সেদিনই আমার ডাক্তারের সাথে এখানে অ্যাপয়ন্টমেন্ট ছিল।

ডাক্তারঃ তোমার সি সেক কেন হয়েছিল? কে ধরনের কমপ্লিকেশন দেখা দিয়েছিল একটু বিশদে বলো তো।

আমিঃ সে রকম তো কোন কিছু ছিল না। ডাক্তার বলেছিলেন সেজনই…।

ডাক্তারঃ আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি, শুধুমাত্র টাকা নেয়া ছাড়া আমি তো আর কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছি না!  এ ধরনের অপারেশনে টাকার পরিমাণ কত লাগে?

আমিঃ বিভিন্ন হাসপাতালে বিভিন্ন রকম (তারপর তাকে সেই পরিমাণ বিশদে বললাম)।

ডাক্তার‌ঃ তোমার দেশের মানুষ তো না কি এতই গরীব যে না খেতে পেয়ে মারা যায়! ছোটো ছোটো বাচ্চাদের তো অপুষ্টিতে পেট বিশাল বড় হয়ে বের হয়ে থাকে আর চোখ কোটরে ঢুকে থাকে। তোমরা তাহলে এত টাকা দিয়ে সিজার করো কীভাবে? তোমাদের দেশের ডাক্তাররাই বা কেন এমন করে? যাদের টাকা নেই, তারা কী করে? তোমার দেশে তো খুব মারামারি হয়…। আরও অনেক অনেক প্রশ্ন তার!

ডাক্তার যখন কথা বলছিলেন তখন আমি কল্পনাতে শিল্পাচার্য জয়নুল অাবেদিনের 'দুর্ভিক্ষ' ছবিটিকে দেখতে পাচ্ছিলাম। কোথায় যেন একটা রাগ ভেতরে ভেতরে ফেটে পরছিল। মনে হচ্ছিল এমন কিছু একটা অবশ্যই বলতে হবে যেন এই ডাক্তার সারা জীবন বাংলাদেশ নিয়ে আর একটাও এ ধরনের কথা না বলতে পারে।

অামি তাকে দেশের অবস্থা, বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবার অবস্থাগত পরিবর্তনের ধারনা দিয়েছি সবিস্তারে। তিনি বিস্ময়াভূত হয়েছেন।  কারণ, আমি তাকে সোনার বাংলার গল্প বলে এসেছি। অামি তাকে এমন একটি বাংলাদেশের গল্প বলে এসেছি, যে দেশে নেই কোনো ভেদাভেদ, নেই কোনো সাম্প্রদায়িকতা, নেই কোন দুর্নীতি, নেই ধর্ষণ, গোঁড়ামি। অাছে  সহনশীলতা, যৌক্তিক চেতনার অবাধ ক্ষেত্র। রয়েছে সুশাসন আর অাইনি ও স্বাস্থ্যসেবা প্রক্রিয়ায় অবাধ অংশগ্রহণ। এ সবই অামার ইউটোপিয়া। অামাদের ইউটোপিয়ান সমাজ…!

স্যার থমাস মুর যথার্থই বলেছিলেন, কোনো কিছুর মালিক না হয়েও তো ধনী হওয়া যায়, আনন্দ, শান্তি আর দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনের চেয়ে মূল্যবান সম্পদ কী আর রয়েছে কিছু?

১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে সাম্প্রতিক নানা গবেষণা থেকে জানা যায়, মানুষের সৃষ্ট এই দুর্ভিক্ষ রোধ করা সম্ভব ছিল। সরকারের ঔদাসীন্য, খাদ্যশস্য সরবরাহে ব্যর্থতা, যুদ্ধ, মুনাফালোভীদের খাদ্য মজুদ ও গণতন্ত্রহীনতা ছিল এই দুর্ভিক্ষের অন্যতম কারণ।

বাংলাদেশের মেদিনীপুর, বিক্রমপুরসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলের গ্রামের কৃষিজীবী মানুষই সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। যৎসামান্য খাদ্যের আশায় ও বেঁচে থাকার আর্তি নিয়ে দলে দলে লোক পরিবার-পরিজন নিয়ে চলে এসেছিল বড় বড় শহরে।

কঙ্কালসার এই মানুষগুলো খেতে না পেয়ে মরে থাকত ডাস্টবিনের পাশে, ফুটপাতে ও রকে। শিল্পাচার্য জয়নুল অাবেদিন দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের বেঁচে থাকার আর্তিকে মোটা তুলিতে যেভাবে রূপায়িত করেছিলেন তার কোনো তুলনা নেই।

এক দশক আগেও আমাদের দেশের মঙ্গাপীড়িত অঞ্চলে গবেষনার জন্য ফান্ড চাওয়া খুবই ষ্বাভাবিক ছিল। এখন আর দেশের মানুষ না খেয়ে মরে না, শিশুদের পেট ও হয়তো বড় হয়ে ফুলে থাকে না, মাতৃ ও শিশু মৃত্যু হ্রাস পেয়েছে। তারপরেও বাংলাদেশে রয়েছে উচ্চ শিশু মৃত্যুর হার এবং ৫ বছরের নিচের শিশু মৃত্যু হারের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান ৫৭তম। কিন্তু জীবনের আর্তি এখনও শোনা যায়।

এখনও বয়স্ক ভাতা প্রকৃত বয়স্কদের হাতে পৌঁছায় না, আঞ্চলিক ও রাজনৈতিক স্বজনপ্রীতির কারণে তালিকায় হয়তো তাদের ঠাঁই হয় না। একবার এক গ্রামে কয়েকজন বৃদ্ধা হাত ধরে কেঁদে বলেছিলেন, কয়টাই তো মোটে টাকা, তাও কেন সেটা তারা হাতে পায় না? এর উত্তর নেই আমার কাছে।

সরকারি হাতপাতালে যখন মেঝেতে রোগী শুয়ে সুচিকিৎসার দিবাস্বপ্ন দেখে, তখন প্রয়োজনের তুলনায় চিকিৎসক ও চিকিৎসা সেবা দুটোরই যেন দুভিক্ষ! যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজে আমি গবেষনার কাজে যেতাম, সেখানে আমি টয়লেট করতে পারতাম না। তাই পানি খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম, শরীর মারাত্মক খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

আমি শুধু ভাবতাম, রোগীদের অবস্থা, তাদের এই অব্যবস্থাপূর্ণ  ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রোগমুক্তি আদৌ কীভাবে সম্ভব?  যখন বিশ্বজুড়ে হাইজিন নিয়ে এত গবেষনা, সেসময় অামাদের হাসপাতালের অপরিচ্ছন্নতা যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে প্রশ্ন করে- বাংলাদেশ তোমার অর্জন কী? শুধুই একটি সীমানা নাকি আরও বেশি কিছু?

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে, কিন্তু প্রয়োজনীয় উপকরণ নেই। দেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় এ প্লাসের ধুম লেগে গিয়েছে, কিন্তু শিক্ষার্থীরা কী শিখছে সেটাও আজ প্রশ্নের সম্মুখীন।

২ বছরের শিশুকে ধর্ষণ করে অামরা নিজেদের পরিবারের অাশ্রয়-প্রশ্রয়ে হৃষ্টপুষ্ট হই যেন আরও অভিনবভাবে ভবিষ্যতে ধর্ষণ করতে পারি। ধর্ষণের একমাত্র কারণ হিসেবে শুধুমাত্রই নারী ও শিশুর পোশাককেই দায়ি করি। ছেলে শিশুর আবার ধর্ষণ হয় না কি বলে আমরা বিষয়টিকে এড়িয়ে যাই।

আমাদের সাথে মতের অমিল হলেই আমরা তার ওপর অাক্রমণ করি। কোটা দিয়ে মেধাকে অবহেলা করি। রাজনৈতিক ক্ষমতা দিয়ে শিক্ষকতায় অধিষ্ট হই, সে যোগ্যতা থাকুক কি না থাকুক! তারা কী শেখাবে আমাদের সন্তানকে?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি জার্মানির পরাজয় দেশটিকে ইউরোপসহ বিশ্বজুড়ে অনেকটাই একঘরে করে দেয়। হিটলারের নাৎসি বাহিনী ইউরোপজুড়ে তাণ্ডব চালিয়েছিল; ধ্বংস-নির্যাতন-হত্যা, লাখ লাখ বন্দিকে আটক করে নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে হত্যার ইতিহাস পৃথিবীর সব নির্মমতাকে ম্লান করে দিয়েছিল। ১৫ বছরের শাসনামলে হিটলার নিজ দেশেও অন্য ধর্ম, বর্ণ ও অন্য রাজনৈতিক মতাবলম্বীর ওপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছিল।

৭০ বছর আগের ফ্যাসিবাদী জার্মান প্রজন্মের সঙ্গে আজকের জার্মান প্রজন্মকে কোনোভাবেই মেলানো যাবে না। তবু ৭০ বছর ধরেই সব মূলধারার দল–মতনির্বিশেষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অপরাধবোধ কাঁধে নিয়েই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন নীতি ও নিজেদের গণতান্ত্রিক ধারা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন অব্যাহত রেখেছে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত জার্মানি উঠে দাঁড়িয়েছে, হিটলারের কথা তারা আলোচনাও করতে চায়না।

কিন্তু আমরা কী করেছি? একমাত্র দেশনেতাকে ১৯৭৫ সপরিবারের হত্যা করি আমরা, অামরা যুদ্ধাপরাধীদের অাশ্রয় দেই বিন্দুমাত্র লজ্জিত না হয়ে, তাদের পার্লামেন্টে বসাই এবং স্বাধীন দেশের পতাকা দেয়া গাড়িতে চড়তে দেই, যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলে আমরা তাদেরকে হত্যা করার পরিকল্পনা করি, দেশের জন্য যারাই কাজ করতে চায় তাদেরকেই আমরা আমাদের শত্রু বলে মনে করি।

দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এই প্রজন্মের অনেকেই আজও ২৫ শে মার্চের গণহত্যার প্রয়োজনীয়তা খুঁজে বেড়ায়। স্বদেশীয় যুদ্ধাপরাধীদের কৃতকর্মের সমর্থন দেয়, লজ্জা পাওয়া তো দূরে থাকুক। এখনও এই দেশে এমন মানুষ রয়েছে যারা স্বাধীনতা যুদ্ধকে নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করে।

সুতরাং, প্রাপ্তির ঝোলা যে আমাদের শূন্য! দেশে একজন বিষাক্ত মানুষই যথেষ্ট পরবর্তী প্রজম্মকে অকৃতজ্ঞ ও অন্ধকার মানসিকতার মানুষ হিসেবে তৈরি করার জন্য, যে কি না এখনও অস্বীকার করে এই পতাকাকে। এখন এই দেশে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছেলেমেয়েরা ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২৬শে মার্চ আর ১৬ই ডিসেম্বরের পার্থক্য করতে পারে না। এই লজ্জা, এই দুঃখ কোথায় রাখি?

ভাবছেন হঠাৎ করে এমন একটি প্রজন্ম তৈরি হয়েছে? না তো! ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে। ১৯৭৫ সালেরও আগে থেকে তৈরি হয়েছে এই নকশা।  তবেই না আমরা দীপন ভাইয়ের খুনিকে ধরতে পারিনা, বিচার করা তো দূরের কথা। তবেই না আমরা নির্দ্বিধায় ডঃ ‍মুহাম্মদ জাফর ইকবালকে হত্যার পরিকল্পনা করি।

তারপরেও ভালবাসি দেশকে। তারপরেও আমার ছোট্ট সন্তানকে দেশের পতাকার রঙ চেনাই, সোনার বাংলার গান শেখাই। তারপরেও স্বপ্ন দেখি দেশ নিয়ে। যেখানে কল্পনা চাকমা বা মন্টি চাকমা বা দয়া চাকমাদেরকে অপহৃত আর বেপাত্তা হতে হবে না। যেখানে অদিতি বৈরাগী বা অন্যদেরকে যৌন সন্ত্রাসের শিকার হতে হবে না। ধর্ষণ মামলা তুলে না নিলে আবার ধর্ষিত হতে হবে না।

তারপরেও স্বপ্ন দেখি ত্বকী বা অভিজিৎ বা তনু হত্যার বিচার হবেই। তারপরেও স্বপ্ন দেখি দেশ নিয়ে যেখানে উন্নয়নের আরেক নাম সুন্দরবনকে বলি দেয়া নয় কখনই।