শুধু কোটা নয়, পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রেরই সংস্কার প্রয়োজন

ঈশিতা বিনতে শিরীন নজরুলঈশিতা বিনতে শিরীন নজরুল
Published : 12 April 2018, 08:37 PM
Updated : 12 April 2018, 08:37 PM

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাম শাসন এসেছিল একটি মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে; একটু শ্বাস নেবার স্বপ্ন থেকে। তারা মেহনতি মানুষের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার জন্য প্রথম দিকে অনেক সংগ্রাম করেছে, কিন্তু সঠিকভাবে প্রলেতারিয়েত বা সর্বহারাদের দল হয়ে উঠতে পারেনি। মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রগতিশীল অংশের দল হয়ে রয়েছে। ইতিহাস সাক্ষী হয়ে রয়েছে যে, পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের প্রায় ত্রিশ বছরের বেশি ক্ষমতায় থাকাকালীন প্রথম দিকে তারা গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন অথবা ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে শাসন কাঠামো পুনর্গঠন ও শক্তিশালী করাকে  অগ্রাধিকার দিলেও পুঁজিপতিদের দল বলে কথিত কংগ্রেসের শাসকদের মতোই দলতন্ত্র ও দুর্নীতির পোষকতা, মাস্তানতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি কাজে হাত পাকিয়েছে, মানুষকে অতিষ্ট করে ক্ষমতা হারিয়েছে।

কংগ্রেসের কায়দায়ই শিল্প প্রতিষ্ঠার নামে  সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে কৃষক দলনের নীতি গ্রহণ করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। কোনো সাংগঠনিক রূপ ছাড়াই যখন তৃণমূল ক্ষমতায় এসেছিল, বলা ভাল মানুষ অাবারও অতিষ্ঠ হয়েই ক্ষমতায় এনেছিল এক বুক স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু যেই কে সেই! বাম বা কংগ্রেসের লেজুররাই আবার তৃণমূলের লেজুর হয়েছে। দেশ চলেছে দেশের গতিতে, ভুক্তভোগীরা ভুক্তভোগীই থেকে গিয়েছে।

এত কিছু বললাম কারণ, কাঠামোকে ভাঙ্গা খুব কঠিন। অন্ধ দম্ভকে ভাঙ্গা খুব কঠিন। ক্ষমতালোভী স্বার্থান্বেষীদের চিহ্নিত করে দল থেকে বহিস্কার করাও যেমন কঠিন, ততটাই সহজ বিতারিতদের অন্য দলে যোগ দেয়া। তাই বলছি, কাঠামো সংস্কার না হলে কিছু করাই কঠিন।

স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরে এসে মুক্তিযোদ্ধা কোটা যে নিতান্তই অযোৗক্তিক সেটি সরকার বুঝেও না বোঝার ভান করছেন! কারণটি খুবই স্বচ্ছ, মুক্তিযোদ্ধা কোটাও যে দলীয় নয়, সেটি কিন্তু আমরা প্রমাণ করতে পারবো না। আমরা নিতান্তাই সাধারণ মানুষ, যারা আদৌ কিছুই প্রমান করতে পারিনা, বা চাই না। কেটেই তো যাচ্ছে দিন, ঝামেলা করার চেয়ে চলুক, যেমনটি চলছে! কোটা সংস্কার নিয়ে কিন্তু বহুদিনই আলোচনা চলছে, তারপরেও অবস্থান যখন আজকের দিনের মতো হয়ে ওঠে, তখন আশঙ্কা বা হতাশা দুটোই সমানভাবে হতেই থাকে। যখন একটি বৈধ আন্দোলন থামানোর জন্য রাজনৈতিক সন্ত্রাসের আশ্রয় নিতে হয়, তারচেয়ে লজ্জার বোধকরি একটি সরকারের জন্য আর কিছুই হতে পারেনা।

অন্যদিকে, শুধুমাত্র কোটা সংস্কার হলেই মেধাবীরা সুযোগ পাবে এটিও আমি পুরোপুরি মানি না। দলীয় নিয়োগ বা নিয়োগের বাজারজাতকরণ আপনি কিভাবে ঠেকাবেন? যে দেশের নিয়োগ প্রক্রিয়াও টাকার বিনিময়ে কিংবা চামচেবৃত্তির মাধ্যমে বিকিকিনি হয়ে থাকে সর্বত্র সেখানে আর যাই হোক মেধার অংশগ্রহণ আমি কোথাও দেখতে পাই না। অাবার হাজার হাজার শিক্ষার্থীিদের মাঝে চান্স পাওয়া মেধাবী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন ভর্তির প্রথম দিন থেকেই পাঠ্য বইয়ের বিকল্প হিসেবে বিসিএস গাইড মুখস্ত করে, তখন আমার হতাশা লাগে দেখে যে কত মেধার কি বিপুল অপচয়।

একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে পাস করা কেউ যখন বিসিএস কেই জীবনের একমাত্র স্বপ্ন ভাবে, তখন আপনি কি বলবেন? অথবা একজন ডাক্তার এসে যখন ডাক্তারী ছেড়ে ম্যাজিস্ট্রেট বা কাস্টমসের জন্য নাম লেখায় অাপনি কি বলবেন না মেধার কি বিপুল অপচয়? অথবা ধরুন, অাপনি মেধাবী কিন্তু, আপনার টাকা নেই, আরেকজন মেধাবীর দুটোই আছে, সাথে নিয়োগ বাজারজাতকরনের ব্যবস্থাও বলবৎ রয়েছে, শুধুমাত্র কোটা সংস্কার দিয়ে কিন্তু সমস্যার সমাধান হবে না তখন।

সংস্কার আজ প্রয়োজন পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রেরই। পার্লামেন্ট থেকে শুরু করে সর্বত্র। পার্লামেন্টে যখন একসময়ের অগ্নিকণ্যা বেসামাল কথা বলেন, তখন বুঝতে হবে দেশের ঘোর পরিণতি বুঝি অার ঠেকানোই গেল না। রাজনীতিবিধদের বয়সসীমা নির্ধারণ করে দেয়া যে কতটা প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে তা কিন্তু আমরা আমাদের অতিপ্রবীণ রাজনীতিবিদদের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি! আমি এখনও আশা রাখি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এধরনের মন্ত্রী পরিষদ বা দলীয় ব্যক্তিবর্গের চেয়ে নিজের বিচক্ষণতার ওপরেই আস্থা রাখবেন। নিজের দলকে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি নিজেদের অবস্থানকে টিকিয়ে রাখার জন্য। পুরো কোটা ব্যবস্থা বাতিলের মতো সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র ভবিষ্যত নিয়োগ ক্ষেত্রের রাজনৈতিক বা ক্ষমতাধারীদের স্বেচ্ছাচারীতার আরও একধাপ এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। পিছিয়ে পড়া জেলাগুলোর, বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার কিংবা প্রতিবন্ধী মানুষের আরো পিছিয়ে পড়া ছাড়া এর কোন কার্যকারীতা নেই সেটি কি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জানেন না? যখন একটি ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য ছেলেমেয়েরা মাঠে রাস্তায় হলে মার খাচ্ছে, তখন কি না ছাত্রলীগ প্রধানমন্ত্রীর বরাত দিয়ে বলছে, কোটাই বাতিল করে দেয়া হবে। দেশের পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোকে আরও পিছিয়ে পরার ব্যবস্থা করা হবে?

আওয়ামী লীগ নিজেদেরকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির দিক নির্দেশক যদি মনেই করে থাকে, তবে ভারতের কংগ্রেসের মতো দলটির যাতে পরিণতি না ঘটে, সেদিকে তাদের বিশেষ নজর দিয়া কি এখন সময়ের প্রয়োজন নয়?