নভেল করোনাভাইরাসে জার্মানিতে ‘ঘরবন্দি’ দিনগুলো

ঈশিতা বিনতে শিরীন নজরুলঈশিতা বিনতে শিরীন নজরুল
Published : 22 March 2020, 01:18 PM
Updated : 22 March 2020, 01:18 PM
করোনাভাইরাস সংক্রমণ তখনও মহামারি ঘোষণা করেনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। আমাদের তখন তিন বছর পর দেশে বেড়াতে যাওয়ার উত্তেজনা। দেশে পৌঁছে তেমন উৎকন্ঠা চোখে পড়েনি। তারপর হঠাৎ করেই একের পর এক বার্তা আসা শুরু হলো ইনবক্সে। সব দোকানের জিনিসপত্র নাকি স্টকআউট হয়ে যাচ্ছে; যে যা পারছে কিনে রাখছে।

তখনও আমরা এটাতে হুজুগে মানুষের প্যানিক বলেই তেমন গুরুত্ব দেইনি। তবে ফিরে আসার আগের সপ্তাহে যখন ঠাণ্ডা-জ্বরে আক্রান্ত হলাম, তখন কিন্তু বাসার সবাই বেশ উৎকন্ঠিত হয়ে গেল আমার অবস্থা নিয়ে। এয়ারপোর্টে নেমে কোয়ারেন্টিন করে রেখে দিলে তো ছেলে নিয়ে মহাবিপদ। আসল বিপদ টের পেলাম প্লেনে ওঠার পর থেকে। কাশি দিলেই মানুষ এমন করে তাকাচ্ছে যেন আমি নিজেই একটি জীবন্ত ভাইরাস। 
 

বাসায় পৌঁছে বুঝলাম অবস্থা আসলে কতটা খারাপ। কোনো রকমে লাগেজ রেখেই খাবারের সন্ধানে বের হয়ে গেল বাবাই। আমাকে জিজ্ঞেস করলো, এক সপ্তাহের জন্য কী কী আনবো? আমি মোটামুটি একটা ফর্দ দিলাম। বাবাই বাজার করে ফিরলেও বেশিরভাগ জিনিসই পায়নি। যা পেলো তাতে একদিন চলবে আমাদের।  তখনই একটা ভয় গ্রাম করলো আমাকে। মহামারির সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানা অভিজ্ঞতা পড়েছি বইয়ের পাতায় হাজার বার। এখন সেই সব পড়া বাক্য  যেন এক নিমেষেই জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

পরের দিন ঠিক করলাম যে, এক সপ্তাহের মতো বাজার করে রাখতেই হবে। বিকালে খবর দেখে বুঝলাম, আসলে এক সপ্তাহের না এক মাসের বাজার করে রাখা প্রয়োজন।

বাবাই জানতে চাইলো, এক মাসে আমাদের সবচেয়ে দরকার কী কী হতে পারে? আমি কোনোভাবেই সবচেয়ে দরকারি জিনিস কোনটা তা বলতে পারলাম না। আমার কাছে মনে হচ্ছে, সবই দরকারি, কোনটাকে বাদ দেব? আমার শুধু মনে হচ্ছে, এক মাসের বাজার করে এরপরে কী হবে? যদি সব খাবারের স্টক ফুরিয়ে যায়? জার্মানি তো বর্ডারও বন্ধ করে দিয়েছে; একে একে সব কিছু বন্ধ করে দিচ্ছে, উৎপাদন, আমদানি বন্ধ হলে এক মাস পরে কী হবে?

নিয়মিত জীবনের জন্য এক মাসের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের বাজার লিস্ট করা আর এক মাস পরে ডিমান্ড অনুযায়ী সাপ্লাই নাও থাকতে পারে মনে রেখে মাসের বাজার লিস্ট করা কিন্তু একেবারে আলাদা।

আরও ভয়াবহ চিন্তা যে, এই মহামারির যে আর্থ-সামাজিক প্রভাব পড়বে সেটা ছেলে নিয়ে কীভাবে সামাল দেব?  কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি কোনো লিস্টই করতে পারি না। জার্মানির মতো সমৃদ্ধ একটা দেশে বসে আমি যে ভয় পাচ্ছি, আমার নিজের দেশের মানুষেরা কেন সেই ভয় পাবে না?

মানুষ সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেকে উপহাস করে পোস্ট করছে যে, চাল-ডাল, এমনকি টয়লেট টিস্যুও নাকি শেষ হয়ে যাচ্ছে। আর আমি দেখছি, একজন মানুষের অনিশ্চয়তার আতঙ্কিত মনস্তত্ব। নিজেকে দিয়েই বুঝতে পারছি এই ভীতি আসলে একজন মানুষকে কীভাবে মানসিক দিক দিয়ে দূর্বল করে ফেলতে সক্ষম।

দু্ইদিন আগেও আমরা বুঝতে পারিনি যে একদিনে ইতালিতে সর্বোচ্চ সংখ্যক মৃত্যু হবে। তেমনি আগামীকাল কী হবে তাও আমরা জানি না। এরপর কে আক্রান্ত হবে জানি না।

জার্মানি সবচেয়ে শেষে বর্ডার বন্ধ করেছে। চ্যান্সেলর বলেছেন, বর্ডার বন্ধ করে এর সংক্রমণ বন্ধ করা সম্ভব নয়। ৭০ শতাংশ মানুষ আক্রান্ত হবেই; বরং অর্থনীতির চাকা বন্ধ হয়ে যাবে, পরিস্থিতি আরও সংকটময় করে তুলবে।

জার্মানি আসলে ৭০ শতাংশ মানুষের সংক্রমণের জন্য মানসিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রস্তুত; তবে সেটা যেন একদিনেই ইতালির মতো একশ থেকে এক হাজারে বেড়ে না যায় সেই চেষ্টাই করছে তারা।

চিকিৎসা সেবা তখনই দেওয়া সম্ভব যখন সেটা একটি নির্দিষ্ট গতিতে বাড়তে থাকে। কভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে যেটা একেবারেই দেখা যায়নি। বরং গুণিতক হারে বেড়েছে এর প্রভাব। করোনা ভাইরাসের মহামারি মোকাবেলা করতে গিয়ে জার্মানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা ম্যার্কেল।

জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা ম্যার্কেল বলেন, "পরিস্থিতি মারাত্মক। একে মারাত্মকভাবেই নিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আমাদের দেশের সমন্বিত সংহতির প্রতি আর কোনও কিছুই এমন মারাত্মক চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারেনি।"

বাভারিয়াতে লকডাউন করা হয়েছে। ধারনা করা যায় সহজেই যে, খুব শীঘ্রই পুরো জার্মানিতেই লকডাউন করে দেওয়া হবে। এমনিতেও সবাই চেষ্টা করছে বাসায় থাকতে। যাদের বাসা থেকে অফিস করা সম্ভব তাদেরকে হোম অফিস করতে দেওয়া হয়েছে। বাকিরা যাদের যেতেই হবে, তাদের জন্য বলা হয়েছে সে ছাড়া বাসার বাকি সদস্যরা যেন বাইরে না যায়। প্রতি পরিবারের একজন সদস্য বাসা থেকে প্রয়োজনীয় কাজ সারতে বের হবে। রেস্তোরাঁ, বার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সব কিছুই এখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

 


করোনাভাইরাস আক্রান্ত হতে পারে ৭০% জার্মান: মের্কেল

জার্মানিতে করোনাভাইরাস আক্রান্ত বেড়ে ১১৭

জার্মানিতে করোনাভাইরাস: ফুল-পাতা রং ছড়ালেও বিবর্ণ গ্রীষ্ম

করোনাভাইরাস: অনলাইনে ক্লাস নেবে স্ট্যানফোর্ড


 

সবাই আসলে নিজেদের কথাই চিন্তা করছে, নিজেদের জন্য ভয় পাচ্ছে। ছোট্ট একটা ফুলকপি রান্না করতে গিয়ে কালকে মনে হচ্ছিল যে, আহা পুরোটা রান্না না করে অর্ধেকটা রেখে দেই, পরে যদি না পাওয়া যায়। কারণ, শীত প্রধান জার্মানিতে সবজি প্রায় চাষই হয় না; এমনকি ধানও না।

এই চারদিনে মাত্র ছয় কেজি চাল আমরা সংরক্ষণ করতে পেরেছি। কারণ বাজারে চাল পাওয়াই যাচ্ছে না। জার্মানরা কি ভাত খুব পছন্দ করে? না, তা না। চাল এখন পরিমরি করে সবাই কিনছে কারণ এটি দীর্ঘ সময় টিকে থাকার মতো শুকনো খাবার। খাবার সংরক্ষনের বিষয়টিও বাংলাদেশের মতো একইরকম হবে কিনা সেটাও চিন্তার বিষয়। কারণ দুটি দেশের জলবায়ু ভিন্ন। মানে বাংলাদেশে পেঁয়াজ আর আলু খোলা ছড়িয়ে রাখলে এক বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা সম্ভব। কিন্তু শীতপ্রধান দেশের ক্ষেত্রে এরকম বিষয়গুলো কতটা কার্যকর বা কত সময় পর্যন্ত কার্যকর তা জানি না।

সংস্পর্শ বাঁচিয়ে চলার ওপর গুরুত্ব দিতে বলা হচ্ছে। কিন্তু সুপার শপের বিভিন্ন খাবারের প্যাকেটগুলোও একাধিক মানুষের সংস্পর্শে আসছে স্বাভাবিকভাবেই। তাই আমরা নিজেরাই যখন খাবার স্টক করার জন্য এগুলো নিয়ে আসছি বাসায়, সেটাও কিন্তু কম ঝুঁকিপূর্ণ নয়।  একজন বাইরে থেকে এসে হাত ধুলেন, গোসল করলেন; কিন্তু যে জিনিসগুলো বাজার থেকে নিয়ে আসলেন সেগুলোকে কীভাবে জীবাণুমুক্ত করা যায়?

সংস্পর্শ মানে শুধু  মানুষেরই নয়, সব কিছুর সংস্পর্শ। সেটা আদৌ সম্ভব হবে কি না সেটাও আমাদের ভাবতে হবে। সন্তানকে কিছুক্ষণ পরপর হাত ধোয়া শেখালেন, আবার অপরদিকে বাইরে থেকে নিয়ে আসা খাবারের প্যাকেট বা চালের প্যাকেট বাসার রান্নাঘরে রেখে দিলেন, ধরে নেই সেই চালের প্যাকেটটাই কোনো ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষ ধরেছেন সুপার শপে এবং ভাইরাসটি যদি তিন ঘন্টা পর্যন্ত বাতাসে বেঁচে থাকে, তাহলে সুরক্ষা হবে কি?

তারমানে আমরা সবাই কি চরম ঝুঁকির মাঝে প্রতিদিন বাস করছি। ঘরে বা বাইরে কোথাও নিরাপদ নই। এই একটি চিন্তাই মানুষকে অসুস্থ করে দেবে। প্যানিক হওয়া সমাধান নয়, আবার ঘরবন্দি দশায় এরকম পরিস্থিতিতে আমরা সবাই প্যানিক হয়েই আছি।

এরকম চলতে থাকলে সমানের সময়টা সবার জন্যই খুব কঠিন। আমেরিকা বা জার্মানির মতো দেশ থেমে থাকা মানে পৃথিবীর অর্থনীতির চাকা থেমে যাওয়া। বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা কাটাতেই কত বছর পিছিয়ে পরতে হয়েছিল পৃথিবীকে। সেখানে এই ধাক্কা কীভাবে গোটা পৃথিবী সামলাবে? এই চরম অনিশ্চয়তা আমাকেে একটা বড় শিক্ষা দিয়েছে, 'প্রয়োজনকে' ফোকাস করতে শেখা। এক চামচ তেল দিয়েও রান্না করা যায়, আবার এই একই রান্না ইচ্ছামতো পরিমাণে তেল দিয়ে করতে পারবেন। এক চামচ তেল হলো প্রয়োজন, যে এর কম দিলে রান্না ঠিকমতো হবে না; আর বাকিটা সাধ্য-রুচির বিলাস। এখন সময়টাই এমন যে সেই এক চামচ তেল খরচ করতেও আমাদের ভয় লাগে বেশি খরচ হয়ে গেলে পাবো কিনা ভেবে।

শুধু জার্মানি নয়, পুরো ইউরোপ জুড়েই একই অবস্থা। প্যানডেমিকের আগামী দিনগুলি কীভাবে কাটবে আমরা কেউই জানি না। শুধু সুসময়ের জন্য অপেক্ষা, একটু বেঁচে থাকার আকুতি সবার।