বসন্ত বাতাসে টিউলিপের দেশ নেদারল্যান্ডসে

ঈশিতা বিনতে শিরীন নজরুলঈশিতা বিনতে শিরীন নজরুল
Published : 30 April 2022, 07:59 PM
Updated : 30 April 2022, 07:59 PM

রমজান মাস শুরুর ঠিক আগেই আমরা কয়েকজন গেলাম এক বাসায় দাওয়াতে। সন্ধ্যায় সেই বাসা থেকে বেরিয়ে যখন সবাই যার যার বাসায় ফিরে যাবো, ঠিক তখনই সৃষ্টি ভাবী বললেন, "চলেন সবাই আমাদের বাসায়, আড্ডা দিই।"

পরের দিন সোমবার সবার অফিস-স্কুল তো রয়েছেই, কিন্তু আমরা সবাই যারপরনাই আড্ডা প্রিয় বলে মনের মাঝের দোনোমোনো ভাবটা চাপা দিয়েই আড্ডার প্রস্তাবটা লুফে নিলাম। রাতে আড্ডা দিতে দিতেই জানতে পারলাম, সৃষ্টি ভাবীদের প্ল্যান হলো ইস্টারের বন্ধে নেদারল্যান্ডসের টিউলিপ গার্ডেনে ঘুরতে যাবার।

আমাদেরও ইস্টারের বন্ধ, কিন্তু রোজার সময় হওয়ায় যাবো কি যাবো না, রোজা রেখে হাঁটতে পারবো কি না, ভাবীর বানানো গরম গরম পেঁয়াজু খেতে খেতে এরকম নানা আলোচনার পরে আমরাও পাঁচ পরিবার মিলে হই হই করে যাওয়াই মনস্থির করে ফেললাম।

ছেলে লিওনেলের স্কুল খোলা থাকলে, তখন চাইলেও আর নিজেদের ইচ্ছে মতো যে কোনো সময়ে   আমাদের পক্ষে স্কুল বাদ দিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না, তাই ইস্টারের এই বন্ধই ছিল চট করে কাছের কোথাও থেকে ঘুরে আসার সুযোগ।

জার্মানির পাশের দেশই নেদারল্যান্ডস। ঠিক হলো সবাই মিলে যার যার গাড়িতে ড্রাইভ করে যাওয়া হবে। কিন্তু থাকার জন্য কোনো হোটেলই পাওয়া যাচ্ছিল না। কেন?  কারণ এই সময়টা সবারই বন্ধ এবং ইউরোপীয়ানরা সবাই অনেক আগে থেকেই এই সময়ের প্ল্যান করে রাখে, এমনকি হোটেলও বুকিং করে রাখে।

এদিকে আমরা তো মোটে দুই সপ্তাহ আগে প্ল্যান করেছি, চাইলেই কি আর এখন হোটেল পাবো? তবে কি উপায়? যাওয়াই কি হবে না তাহলে? কিন্তু এত সহজে হতাশ হবই বা কেন?

বিপুল উৎসাহের সাথে খোঁজার পরে একটা দারুণ ক্যাম্পিং সাইটের খোঁজ মিললো। সেখানকার ছবি আর সুযোগ-সুবিধার বহর দেখে আমরা  আপ্লত। কারণ যদি শুধুমাত্র ঐ ক্যাম্পিং সাইটেই আমরা চারদিন থাকি তাহলেও আমাদের, বিশেষ করে বাচ্চাদের কারও একঘেয়ে লাগার সুযোগই নেই। আমাদের প্রথম প্রেফারেন্স হলো, আমাদের সন্তানদের আনন্দ। তাই তাড়াতাড়ি বুকিং দিয়ে দিলাম। কে জানে এক মিনিট দেরি হলে বোধকরি আর কটেজই পাবো না। দুটো কটেজ নেওয়া হলো। কটেজের ভেতরেই রান্নার কিচেনসহ সব কিছু রয়েছে। তাই সবাই মিলে রান্না করবো হইহই করে, আরও কী কী করবো না যাওয়ার আগে পর্যন্ত চললো তার প্ল্যানিং।

নেদারল্যান্ডস বলতে মনে পড়ে বাহারি টিউলিপ ফুলের সমুদ্র, নানা রকমের 'চিজ' আর সারি সারি বাই সাইকেল – সেই সঙ্গে আমস্টারডাম নামের একটি ছোট্ট, খালে ঘেরা শহর। ছোটরা তো বটেই, আমরা বড়রাও খুবই আনন্দিত। জার্মানিতে আমরা যেখানে থাকি সেখান থেকে নেদারল্যান্ডসে পৌঁছতে প্রায় চার থেকে সাড়ে চার ঘন্টার মতো লাগবে। তবে সবার সাথেই বাচ্চা থাকায় ঠিক হলো, নিজেদের মতো আস্তে-ধীরে ড্রাইভ করেই যাওয়া হোক। তাই প্রথম দিনটিতে আমরা আর অন্য কোনো প্ল্যান রাখলাম না। সকালবেলায় পুত্র লিওনেলের ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো; "আম্মু আম্মু তাড়াতাড়ি ওঠো, আমরা রওনা দেবো না?" আমরা যাত্রা শুরু করলাম।

বিকেলের দিকে পৌঁছালাম নেদারল্যান্ডসে। আমি ভেবেছিলাম যে, অন্য দেশে যাচ্ছি, বর্ডারে মনে হয় বড় করে ডাচ ভাষায় লেখা থাকবে, ওয়েলকাম টু নেদারল্যান্ডস টাইপের কিছু। কিন্তু হঠাৎ রাস্তার ভিন্ন চিহ্ন আর সাইনবোর্ডের ভিন্ন ভাষা দেখে বুঝতে পারলাম যে আমরা নেদারল্যান্ডসে প্রবেশ করে ফেলেছি।

জার্মানির সাথে বেশ কিছু পার্থক্য চোখে পড়লো। যেমন, দেখলাম হাইওয়ে জুড়ে প্রচুর লাইট। সবচেয়ে বিরক্তিকর হলো স্পিড লিমিট। জার্মানিতে যেটা নেই বললেই চলে। রাস্তায় আমার বর  কখনও একশ কখনও আশি কিংবা পঞ্চাশে ড্রাইভ করাতে মনে হচ্ছিল আমরা সবাই মিলে বোধকরি ঘুমিয়েই পরবো। মনে হচ্ছিল যেন হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি।

শেষ পর্যন্ত যখন ক্যাম্পিং সাইটে পৌঁছলাম তখন ঠিক গোধূলির আগে আগে। মায়াময় আলোয় ভরে গিয়ে ক্যাম্পিং সাইটটা। ভেতরে কেউ সাইকেল চালাচ্ছে, কেউ জগিং করছে, কেউ তাদের টেরাসে কিংবা ট্রাভেল গাড়ির সামনে ছাতা খুলে তার নিচে বই পড়ছে। আর বাচ্চারা খেলার জায়গাগুলোতে খেলছে; কেউ বা টেবিল টেনিস কিংবা লন টেনিস।

ভেতরের রেস্তোরাঁর বাইরের খাবার জায়গাতে বসে অনেকেই শেষ বিকেলের আলোয় কফি বা ওয়াইন নিয়ে রিল্যাক্স করছে। আমাদের কটেজ-১ এর আরেক বাসিন্দা ইতু ভাবী আর জেনিফার ভাবী আমাদের অনেক আগেই পৌঁছে গিয়েছিলেন। তারা সময়ের সদব্যবহার করে আমরা পৌঁছাবার আগেই খিচুরি রান্না করে ফেলেছিলের রাতের জন্য। আমরা সবাই মিলে ক্যাম্পিং সাইটে কিছুক্ষণ ঘুরে কটেজ-১ এ প্রবেশ করলাম, পুরো কটেজ খিচুড়ির সুবাসে মৌ মৌ করছিল।

নেদারল্যান্ডেসের ইফতার রাত প্রায় পৌনে নয়টার দিকে। তাই সবাই মিলে আড্ডা দিতে দিতে খাবার আয়োজন করতে থাকলাম। রাতের খাওয়া শেষ করে পরের দিনের প্ল্যান করতে বসলাম সবাই, সাথে ইতু ভাবীর বানানো মজাদার গরম ধোঁয়া ওঠা চা।

ঠিক হলো পরের দিন যাবো রাজধানী ও রাত জাগা শহর আমস্টারডামে।  অসংখ্য খালের জন্য উত্তরের ভেনিসও বলে একে।  বলা হয়ে থাকে, আমস্টারডামের কেন্দ্র ডামপ্লাৎসেই এই শহরের জন্ম। জেলেরা ত্রয়োদশ শতাব্দীতে আমস্টেল নদীর তীরে বাস করা শুরু করে। পাশাপাশি প্রথম 'ডাম' অথবা বাঁধটি তৈরি করেন ৷ নেদারল্যান্ডসের রাজধানীর কিন্তু আরো একটি পরিচয় আছেদ ইউরোপে আমস্টারডাম হলো সাইকেল-চালকদের রাজধানী। ২০০১ সালে আমস্টারডামের সেন্ট্রাল রেলওয়ে স্টেশনের কাছে বিশ্বের প্রথম সাইকেল পার্কিং ব্লক তৈরি হয়েছিল।

ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে আমরা সবাই সকালে উঠে রওনা হলাম। তবে  শহরে প্রবেশের সাথে সাথে উৎসাহের পারদ নেমে পারলে মাইনাস হয়ে যায়। কাহিনী কী?  ট্রাফিক জ্যামের জন্য আমরা গাড়ি নিয়ে যেন এগোতেই পারছি না। তারও পরে যে পার্কিং প্লেসে সবার গাড়ি রাখা হবে বলে ঠিক হয়েছিল সেটি অলরেডি দখলে। দীর্ঘদিন পরে এরকম জ্যামের মাঝে পড়ে সবারই মেজাজ বিগড়ে গেলো। রাস্তায় ঘুরে ঘুরে পাকিং প্লেস খোঁজা শুরু হলো এবার যার যার মতো করে।

আমরা একটা পেলাম, সেখানে ঢোকার মুখেই বিশাল লাইন। ভেতরের একটা গাড়ি বের হলে আরেকটা গাড়ি প্রবেশ করতে পারবে। সবাই গ্রুপকলে আলোচনা করছে একটু পর পরই। এভাবেই আমাদের বিকেল তিনটা বেজে গেলো শুধুমাত্র পার্কিং সমস্যা সমাধানে। ততক্ষণে সবাই অল্পবিস্তর ক্লান্ত ও বিমর্ষ। কারণ প্ল্যান অনুযায়ী তো হচ্ছে না কিছু আজকের দিনে। তাছাড়া যেখানে পার্কিং করা হয়েছে সবার সেখানে দিনশেষে ৫৫ ইউরো মানে দেশের হিসেবে ৫০০০ টাকারও বেশি খরচ দিতে হবে। কিন্তু আমরা নিরুপায়।

পায়ে হেঁটে কিংবা সাইকেলে এই শহরে ঘুরতে হয় নতুবা বোটে করে। নানা ধরনের বোট রয়েছে, যেগুলোতে চড়ে আমস্টারডাম শহর দেখা যায়। আমরা টিকিটের খোঁজে গিয়ে দেখলাম প্রায় দেড় ঘন্টা পর স্লট খালি রয়েছে। তাতেই টিকেট করে সবাই বের হলাম পায়ে হেঁটে শহর ঘোরার উদ্দেশ্যে।

শহরের কেন্দ্রে আট লাখের মতো মানুষের বাস; শহরতলিগুলো ধরলে তার দ্বিগুণ। কাজেই একটি আন্তর্জাতিক শহরের আবহটা পাওয়া যায়, আবার একটা ছোট, বাসযোগ্য, উপভোগ্য শহরও বটে। সারা বিশ্ব থেকে মানুষজন এসেছেন এই আমস্টারডামে বাস করতে। তাই নানা জাতির হিসেবে ধরলে কিন্তু আমস্টারডাম বিশ্বে প্রথম শহর, যা কিনা নিউ ইয়র্ককেও ছাড়িয়ে যায়। এছাড়া খালগুলো আমস্টারডামকে একটি শক্তিশালী ব্যবসায়িক হাব বানানোর জন্য সাহায্য করেছে, যার ফলে শহরটি ব্যাপক উন্নতি লাভ করেছে। সপ্তদশ শতাব্দীতে আমস্টারডাম আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটি কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয় ৷ সেই 'সোনার শতাব্দীতে' শহরের বিখ্যাত 'গ্রাখটেন' বা খালের নেটওয়ার্কটি গড়ে ওঠে ৷ আমস্টারডামের প্রাচীন অংশকে চক্রাকারে ঘিরে রয়েছে ১৬৫টি খাল বা জলপথ ও প্রায় পনেরশটির  মতো ব্রিজ, যেগুলি আজ ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অংশ ।

হেঁটে ও বোটে ঘুরে শহরটি দেখলাম শেষ বিকেলের আলোয়। বোট ট্রিপটি আমার কাছে দারুণ লেগেছে। বোটে বসেই শহরের অলিগলি, কিংবা রাস্তা বা ব্রিজে হেলান দেওয়া সাইকেলগুলো অথবা খালের ওপরে বোট-বাড়ি, অফিস বা রেস্তোরাঁ যেন এই শহরের ঐতিহ্যর গল্প বলে চলেছে নিঃশব্দে। রোদমাখা বসন্ত বিকেলে কেউ খালের ধারে বসে বই পড়ছে, কেউ গান শুনছে, কেউ বা বিয়ার হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে রয়েছে। যেতে যেতে দেখলাম খালের ধারের বাড়িগুলোর সামনের সিড়িতে দাঁড়িয়ে প্রবীণরা আড্ডায় মেতে উঠেছে। দারুণ প্রাণোচ্ছ্বল এই শহর যেন বসন্তের আগমনে আরও বেশি করে প্রাণপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

এরপর ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ মৌমিতা ভাবী বলে উঠলেন,  "ঐ দেখো ফেরি যাচ্ছে, চলো ফেরিতে ঐ পাড়ে ঘুরে আসি। যাবে নাকি?"

আমরা সবাই দৌড়ে ফেরিতে উঠে পরলাম অন্যদের সাথে। এত মজা আর আনন্দ নিয়ে সময় কাটছিল। কিন্তু ইফতারির সময় হয়ে এসেছে প্রায়, তাই সবাই মিলে কোথায় খাবো খুঁজতে থাকলাম। জেনিফার ভাবী খুঁজে বের করলেন 'ইস্তাম্বুল গ্রিল', তারপর গুগল ম্যাপ আমাদের পথ চিনিয়ে নিয়ে গেলো। ইফতার শেষ করে ক্যাম্পে ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত সাড়ে এগারোটার ওপরে বেজে গেল। অলিগলির ভেতর দিয়ে গাড়ি চালানো সত্যিই কষ্টের; বিশেষ করে যদি সেটা হয় অচেনা পথ ও রাতের বেলা। এই শহরের আলোকিত অলিগলির পথ দিয়ে এগিয়ে চললাম হাইওয়ের দিকে।

এখানেও ঘটনার শেষ নয়। আমাদের চারটা গাড়ির ভেতর দুটো ভেতরে ঢুকতে পারলো, আমাদের বাকি দুটো গাড়ি নিয়ে আমরা কিছুতেই ঢুকতে পারলাম না। এই গভীর রাতে কি বিপত্তি রে বাবা! ক্যাম্পিং সাইটের অফিস হোটেলের মতো নয় যে, ২৪/৭ খোলা থাকবে। সন্ধ্যা সাতটাতেই বন্ধ হয়ে যায়। তারপর খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম রাত সাড়ে এগারোটার পর গাড়ি ঢোকা যাবে না।  বাকি দুটো গাড়ি ঢুকতে পারলো কীভাবে সেটা জানতে চাইলাম একজন স্টাফের কাছে। সে গম্ভীরভাবে বলল,  "সেটা বলতে পারি না।"

অগত্যা গাড়ি গ্রাউন্ডের বাইরের পার্কিং জোনে রেখে ভরা পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় বড় বড় গাছের মাঝ দিয়ে আমি, বাবাই আর আশিষদা হেঁটে কটেজে ফিরলাম। হাঁটতে হাঁটতেই আশিষদা হাসিমুখে বলে উঠলেন,  "ওরে ওরে ওরে, সেই মজা রে।"

পরের দিন আমরা যাবো কেউকনহফে। সবচেয়ে বড় টিউলিপ বাগানে। যে বাগানকে কেন্দ্র করেই আমাদের এবারের প্ল্যানটি করেছিলাম। টিকেট আগে থেকেই অনলাইনে কিনে রাখতে হয়েছিল। এ সময় লাখ লাখ মানুষ যায় এই বাগানটি ঘুরে দেখার জন্য। প্রবেশ পথের অনেক আগে থেকেই ডিজিটাল বোর্ডে দেখাচ্ছে, সব টিকেট বিক্রি হয়ে গিয়েছে। মানে টিকেট না কিনেই যদি কেউ এই পথ ধরে এগোন, তবে সেখান থেকেই বিদায় নেওয়া ভাল। বিভিন্ন জায়গাতে পার্কিং করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে যেন এক জায়গাতেই বেশি ভিড় না হয়। দারুণ ব্যবস্থাপনা, বাগানের ভেতরে ও বাইরে।

আমি সবসময়েই অবাক হয়ে ভাবতাম টিউলিপ ফুল নিয়ে এত কেন মাতামাতি? ইউটিউবে দেখেও এই প্রশ্নের উত্তর পাইনি। কিন্তু যে মুহূর্তে ভেতরে প্রবেশ করলাম, আমার মাথা নষ্ট হয়ে গেলো। যেদিকে তাকাই শুধু নানা ধরনের নানা রঙের টিউলিপ সবুজের মাঝে ছেয়ে রয়েছে। দিগন্তজোড়া টিউলিপ দেখে ডাচদের টিউলিপম্যানিয়াকে বুঝতে আমার আর অসুবিধা হলো না। অনেকেরই জানা নেই, টিউলিপের আদি বাস ছিল হিমালয়ান অঞ্চলে; তিয়ান শান পর্বত এলাকায়। সেখান থেকে ষোড়শ শতকে তুরস্ক হয়ে এ ফুল পৌঁছায় নেদারল্যান্ডসে। তুর্কি সুলতানরা বসন্তকালে বাগানে টিউলিপ পার্টি করতেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে।

কেউকনহফের  বাংলা করলে হয়, 'হেঁশেল বাগান'। এই নামের পেছনের গল্পটাও কিন্তু বেশ মজার। পঞ্চদশ শতকে তেলিঙ্গেন দুর্গের হেঁশেলে সরবরাহের উদ্দেশ্যে ফল আর সবজি বাগান হিসেবেই সূচনা হয় ২০০ হেক্টর জমির ওপরে এই কেউকেনহফ। আর আজ এই ৩২ হেক্টর জমির ওপর তৈরি করা কেউকেনহফ বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পুষ্পোদ্যান। এখানে সাত মিলিয়ন ফুল নানাবিন্যাসে নানা সজ্জায় নানা রঙে সজ্জিত ও সুশোভিত।

ফুডকোর্টের পাশেই বেশ কয়েকটি স্যুভেনির শপ আর প্যাভিলিয়ন। এসব প্যাভিলিয়ন থিম স্পেসিফিক। প্রথম যেটি দেখলাম ওয়েডিং ফ্লাওয়ার্স। হার্ট শেপে সাজানো পুষ্পরাজি। অনেক রঙের। ৭০০-৮০০ প্রজাতির টিউলিপ রয়েছে এই বাগান জুড়ে। মানুষের কল্পনায় যতগুলো ফুলের রঙ ও রঙের শেড রয়েছে, সবগুলোর দেখা পাওয়া যায় এখানে। সমুদ্রের মতো বিশাল বাগানে যেন ফুলের বন্যায় রঙের ঢেউ হিংসা-হানাহানিতে ভরা জগতকে ঢেকে দিয়েছে। এতো সুন্দর, এতো বর্ণিল, এতো পরিকল্পিত ফুলের সমাহার পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। বাগানের মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে অপূর্ব লেক আর ধার ঘেঁষে রয়েছে ফুলের সমুদ্র। কোথাও কোথাও এমনভাবে সাজানো, যেন ফুল দিয়ে আঁকা হয়েছে বিমূর্ত কোনো শিল্পকর্ম।

ডাচ ঐতিহ্যের উইন্ডমিলও রয়েছে এই বাগানে। বাতাসের শক্তি আহরণ করে তা পানি উত্তোলন ও সরবরাহ, কাগজ, গাছের গুঁড়িসহ নানা উৎপাদন কারখানায় ব্যবহৃত হতো উইন্ডমিল। একসময় ভীষণ জনপ্রিয় প্রযুক্তি ছিল। ছিল বলছি কেন, পুরো নেদারল্যান্ডস জুড়ে এখনো ছড়িয়ে আছে কয়েক হাজার উইন্ডমিল। তবে শিল্পবিপ্লবের পর প্রযুক্তি বদলেছে। উইন্ডমিলের জায়গা নিয়েছে উইন্ড টারবাইন। পুরো কেউকেনহফ বাগানের বার্ডস আই ভিউ পাওয়া যায় বলে সবাই মই বেয়ে ওঠে উইন্ডমিলের চূড়ায়।

বাগানের এক জায়গায় মিউজিকের ব্যবস্থা রয়েছে, দেখে মনে হয় যে, সিডি প্লেয়ারে মিউজিক হচ্ছে। আসলে কিন্তু তা নয়। কাজগুলো পরীক্ষা করার জন্য পিছনে ঘুরেই দেখতে পেলাম একটি একক বেল্ট-চালিত চাকা সংযুক্ত করে এতে শক্তি দিচ্ছে, যার মধ্যে বিভিন্ন অর্গান পাইপ, কাঠ-ব্লক এবং ড্রাম রয়েছে যার মাধ্যমে সুমধুর সুর তৈরি হচ্ছে, যা একটি লম্বা শিটে স্বরলিপির মতো রেকর্ড করা থাকে, সেই অনুযায়ী সুর তৈরী হয়। অনেকক্ষণ আমি আর পুত্র লিওনেল মিউজিকের সাথে নাচলাম মনের আনন্দে। আমরা সবাই মনে হয় সবচেয়ে শেষে এখান থেকে বের হয়েছিলাম।

পরদিন ফেরার পালা। ক্যাম্পিং সাইটেই সবাই একসাথে সকালবেলা ট্রেনে করে ঘুরে পুরো এলাকাটি দেখে দুপুরের দিকে ফিরে চললাম যার যার নীড়ের দিকে।