আন্তর্জাতিক আর্থিক জালিয়াতদের আঁতুর ঘর চীন

শাহীন রেজা নূর
Published : 7 Feb 2012, 11:34 AM
Updated : 27 Jan 2021, 11:48 AM

গোটা দুনিয়াতেই বিস্তৃত আন্তর্জাতিক অর্থ প্রতারণাচক্রের জাল। কিছু কুচক্রী রাষ্ট্র এই জালিয়াতি চক্রকে মদত দিয়ে চলেছে। গোপনে অর্থ আত্মসাৎ করার এই চক্রের মাধ্যমে অন্য দেশকে আর্থিক দিক থেকে কাবু করাই এর উদ্দেশ্য। এ ধরনের আন্তর্জাতিক অর্থ জালিয়াতি নিয়ে বেশকিছু গোয়েন্দা সিনেমাও হয়েছে। সেলুলয়েডের পর্দায় ভেসে উঠেছে রাষ্ট্রও জড়িত রয়েছে এইসব অর্থ জালিয়াতিতে। বাস্তবেও দেখা যাচ্ছে সিনেমার থেকেও রোমাঞ্চকর জালিয়াতি। আর এই জালিয়াতির আঁতুর ঘর হয়ে উঠেছে চীন। একাধিক আর্থিক জালিয়াতিতে উঠে এসেছে চীনাদের নাম। রাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন মদত ছাড়া চীনাদের পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। চীনা প্রতারকদের হাতে প্রতারিতদের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশও। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক জালিয়াতিতে উঠে আসে দুই চীনা নাগরিকের নাম।

২০১৬ সালের ২৯ মার্চ বিবিসি বাংলার খবর, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতারণা মামলায় অভিযুক্ত ফিলিপাইনের ক্যাসিনো ব্যবসায়ী কিম অং সেদেশে সেনেট কমিটির কাছে দুই চীনা ব্যবসায়ীর নাম ফাঁস করে দেন। ৮১ মিলিয়ন বা ৮ কোটিরও বেশি মার্কিন ডলার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চুরি হয়। কিম জানিয়েছিলেন, তিনি পেয়েছেন মাত্র ৫০ লাখ ডলার। বাকিটা হজম করে দিয়েছে দুই চীনা ব্যবসায়ী। তাদের নাম-ধাম থেকে শুরু করে পাসপোর্ট নম্বর পর্যন্ত তিনি তুলে দেন সেনেট কমিটির কাছে। শুনানীর সময় ফিলিপাইনে নিযুক্ত তখনকার বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) জন গোমেজ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এই ঘটনার পরও চীনের প্রতারকরা অধরা। বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রের এতগুলি টাকা আত্মসাৎ করার পরেও চীন কোনও কড়া ব্যবস্থা না নেওয়াটা অবশ্যই রহস্যজনক। শুধু বাংলাদেশই নয়, চীনের জালিয়াত বা প্রতারণা সংস্থার জাল বিস্তৃত বিভিন্ন দেশে। ভারত, ইথিওপিয়া ও তানজানিয়ার মতো দেশের অর্থনীতিকে ধংস করে দিতে সবরকম চেষ্টা চালাচ্ছে চীন। চীনের রাষ্ট্রীয় কৌশলের অঙ্গ হিসাবেই জালিয়াতদের সিন্ডিকেট কাজ করছে।

গত ডিসেম্বর মাসেই ভারতে অনলাইনে সঙ্গে সঙ্গে ঋণ দেওয়ার প্রতারক চক্র ধরা পরে। এই জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত চারটি চীনা সংস্থা। তাদের নামধামও প্রকাশ্যে চলে আসে। এই সংস্থাগুলি হচ্ছে, লিউফাং টেকনোলজিস প্রাইভেট লিমিটেড, অ্যাগলো টেকনোলজিস প্রাইভেট লিমিটেড, পিনপ্রিন্ট টেকনোলজিস প্রাইভেট লিমিটেড এবং নাবলুম টেকনোলজিস প্রাইভেট লিমিটেড। এই জালিয়াত চীনা সংস্থাগুলি ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে অফিস পর্যন্ত খুলে বসেছিল। এই চার সংস্থারই কাজ ছিল বিনা অনুমতিতে অনলাইনে ঋণদান। এরজন্য মোবাইল অ্যাপও খুলেছিল তারা। অ্যাপগুলির নাম হচ্ছে ক্রেজি বিন, ক্রেজি রুপিস, ক্যাশপ্লাস, রুপি প্রো, গোল্ড বৌল, রুপি ডে, ক্যাশ গো, ক্যাশ স্টার, মানি নাউ, পকেট রুপি, কুল ক্যাশ, ফার্স্ট ক্যাশ, ক্রেডিট রুপি, রিয়েল রুপি, লোন গ্রাম, ক্যাশ ট্রেন, ক্যাশ বাস, এএএ ক্যাশ, সুপার ক্যাশ, মিন্ট ক্যাশ, হ্যাপি ক্যাশ, লোন কার্ড, রুপে ওয়ান, মানি বক্স, মাঙ্কি বক্স, পাস্ট ক্রেডিট অ্যাপ। গলাকাটা সুদে এই অ্যাপের মাধ্যমে ঋণ দেওয়া ছিল জালিয়াত চক্রের আসল উদ্দেশ্য। কেউ ঋণের অর্থ শোধ দিতে না পারলেই তার ওপর নেমে আসত হরেক ধরনের হুমকি। এমনকী, তাদের পরিবার বা বন্ধুবান্ধবদের ভুয়া আইনি নোটিশ দিয়ে বিভ্রান্তিতে ফেলা হলো। এই চক্রের ফাঁদে পড়ে ৫ জন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। তখনই বিষয়টি সকলের নজরে পড়ে।

প্রাথমিক তদন্তে দেখা গিয়েছে প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ আর্থিক লেনদেন করেছে চক্রটি। লেনদেনের অঙ্ক প্রায় তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই জালিয়াত সংস্থাগুলির ২৬টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রায় ১ কোটি মার্কিন ডলার জব্দ করা হয়েছে। তদন্ত এখনও চলছে। এই জালিয়াত চক্রের চারজন ধরা পড়েছে। চারজনই চীনের নাগরিক। এই চক্রের মাথা ঝে ওয়েই ওরফে ল্যাম্বো পালাতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু নয়াদিল্লি বিমানবন্দরে ধরা পড়ে যায় সে। ভারতে চীনাদের অর্থ প্রতারণা ও জালিয়াতি নিয়ে তদন্ত চলছে। প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে দেশের অর্থনীতিকে ধংস করতেই চীনা সরকার এই ধরনের চক্রকে মদদ দিচ্ছে।

তানজানিয়াতেও অর্থ জালিয়াতির এ ধরনেরই চীনা চক্র ধরা পড়ে। ৮টি চীনা সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টর থেকে শুরু করে সিনিয়র কর্মকর্তারা এখনও জেলবন্দি তানজানিয়ায়। গত নভেম্বর মাসে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে তাদের আটক করা হয়। ব্যাংক অফ তানজানিয়ার অডিটে ধরা পড়ে চায়না কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড (সিসিবি) অর্থের উর্ধসীমার থেকে অনেক বেশি অর্থ তাদের হেফাজতে রেখেছে। তানজানিয়ার সবচেয়ে বড় শহর ও সাবেক রাজধানী দার-এ-সালামে সিসিবি-র সদর দপ্তর থেকে কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখা যায় কোনও আর্থিক নিয়মেরই তোয়াক্কা করেনি। সেখানকার নিয়ম ভেঙে সিসিবি-র কাগজপত্রেই দেখানো হয়েছে তাদের হেফাজতে রয়েছে নগদ ২০ বিলিয়ন তানজানিয়ান শিলিং এবং ২ মিলিয়ন চাইনিজ মুদ্রা ইউয়ান। বাস্তবে অবশ্য আরও বেশি ছিল সিসিবি-র মূলধন। ২৫০ বিলিয়ন শিলিং ও ২০ মিলিয়ন ইউয়ান ছিল তাদের কাছে। পুরোটাই ছিল তানজানিয়ার অর্থনীতিকে বিকল করার পক্ষে যথেষ্ট। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ইন্ধনে ইচ্ছাকৃত ভাবে ভুয়া সংস্থার মাধ্যমে এ ধরনের আর্থিক অপরাধ চালায় বেইজিং।

ইথিওপিয়াতে ধরা পড়েছে কর ফাঁকি ও প্রতারণার ঘটনা। পেছনে সেই চাইনিজ সংস্থা। সেখানকার ফেডারেল পুলিশের অর্থনৈতিক অপরাধ তদন্ত অধিদপ্তর ১০টি চীনা সংস্থার জালিয়াতি ধরে ফেলেছে। এই সংস্থাগুলি কর ফাঁকি দিতে অবৈধ ভাবে অর্থ লেনদেন চালাচ্ছিল। করযোগ্য আয় লুকাতে গিয়ে তারা ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করত। লেনদেন হতো পুরো অবৈধ উপায়ে। এমনকী, নগদ প্রাপ্তির কাগজপত্রও ছাপানো হতো পুরো ভুয়া। অর্থ নিবন্ধীকরণের ক্ষেত্রে নকল যন্ত্রের ব্যবহার করত সংস্থাগুলি। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। চীনা সংস্থার জালিয়াতি ধরে ফেলে ইথিওপিয়া।

চীনের এ ধরনের কার্যকলাপ নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশও চীনা প্রতারকদের জালিয়াতির শিকার। বেশি লাভের লোভ দেখিয়ে চীনা সংস্থাগুলি বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের অনেককেই পথে বসিয়েছে। অন্য দেশেও একই কারবার করে চলেছে তারা। কিন্তু বিদেশের মাটিতে কমিউনিস্ট শাসিত চীনের নাগরিকদের এ ধরনের কার্যকলাপ বিক্ষিপ্ত কোনও ঘটনা নয়। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে চীনের জালিয়াত সংস্থা বা প্রতারকের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির। মোদ্দা কথায়, বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধিকে শ্লথ করে দেওয়াই হচ্ছে চীনা জালিয়াতদের মূল লক্ষ্য। এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, চীনের রাষ্ট্রীয় নীতিকে কার্যকর করতেই সংস্থাগুলিকে কাজে লাগাচ্ছে শি জিনপিং সরকার। খুবই চিন্তা-ভাবনা করে বেইজিং থেকে নির্দিষ্ট কর্মসূচির ভিত্তিতেই বিভিন্ন দেশে চীন প্রতারকদের পাঠাচ্ছে। তারা গিয়ে সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে বিস্তার করছে প্রতারণার জাল। তারপর দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডেই আঘাত করতে চাইছে নব্য সাম্রাজ্যবাদী চীন। তাই এখন সময় এসেছে, এফএটিএফ বা ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স সক্রিয় হয়ে উঠুক চীনের বিরুদ্ধে। না হলে চীনের জালিয়াতিতে সর্বনাশের মুখে পড়বে গোটা দুনিয়ার অর্থনীতি। চীনা সংস্থাকে ব্ল্যাক লিস্ট করার দাবিও উঠছে। অন্য দেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক চীনা সংস্থার অনুপ্রবেশ। নিদেন পক্ষে নিজের দেশের জালিয়াতদের আন্তর্জাতিক বাজারে পাচারের দায়ে সতর্ক করা হোক চীনকে। এখনই জালিয়াতির কারণে বেইজিংকে সতর্ক করা জরুরি। এফএটিএফ-কে অবিলম্বে কড়া ব্যবস্থা নিতেই হবে। নইলে আরও বহু দেশ শিকার হবে নব্য নাৎসি বাহিনীর।