ঘুরে আসুন মেইন-২

ফকির সেলিম
Published : 30 Oct 2015, 07:08 PM
Updated : 30 Oct 2015, 07:08 PM

২৭শে জুলাই সোমবার, ঘুম ভাংলো দুপুর বারোটা নাগাদ। ব্রুকলিনে চাচার বাসায় যাওয়ার কথা। শহীদুল পরোটা মাংস গরম করলো। দুইটা বাজলো বের হতে হতে। চাচার বাসায় পৌঁছালাম বিকাল ৪টার দিকে। ক্লাসন এভিনিউ আর বার্গেন স্ট্রিটের কর্নারে আসতেই মনটার মধ্যে অন্যরকম অনুভূতি জেগে উঠলো। দশ বছর আগে; কি আশ্চর্য, আজ থেকে দশ বছর আগে এই দেশে আসার প্রথম দিন ঠিক এমনই সময় এই ক্লাসন এভিনিউ আর বার্গেন ষ্ট্রীটের কর্নার হয়েই চাচার বাসায় উঠেছিলাম। তখন এর দুপাশের এই সুরম্য অট্টালিকাগুলো ছিল না।

৮১২ বার্গেন ষ্ট্রীট ব্রুকলীন, মাথার মধ্যে গেঁথে যাওয়া ঠিকানা। বাড়ীর মালিক গোলাম হোসেন সাহেব আমার শ্বশুর আব্দুল আলী সাহেবের ফুফাতো ভাই। ষ্পষ্ট মনে আছে সেদিনের কথা। এইতো সেদিন মাত্র। ছয় বছরের ছোট্ট রিশা আর এক বছরের রামিনকে নিয়ে নতুন স্বপ্ন চোখে অনু আর আমি অজানায় পাড়ি জমিয়েছিলাম।

২০০৫ সালের ৩১শে জুলাই বিকাল ৪টার দিকে আমাদের বহনকারী উড়োজাহাজটি ল্যান্ড করেছিল জেএফকে বিমান বন্দরে। ক্যাথে প্যাসিফিকের ফ্লাইট ছিল। জেএফকের রানওয়েতে যখন প্লেনের চাকা ষ্পর্শ করলো, কেঁপে উঠেছিলাম। এম্নিতেই বিমান ল্যান্ড করার সময় স্বাভাবিক ভাবেই ঝাঁকুনি লাগে। তেমন না। ভেতর থেকেই কাঁপন উঠেছিল আমার। কী জানি আনন্দ নাকি শংকা ছিল সেটি! মনে আছে সেই মুহূর্তটি। শক্ত করে অনুর হাত চেপে ধরে বিড়বিড় করে বলেছিলাম আমরা আমেরিকার মাটি ষ্পর্শ করলাম। তখন স্বপ্নটা আসলে যে কি ছিল দশ বছরের বাস্তবতায় এখন তা আর মনে নেই। রানওয়েতে প্লেন যখন দ্রুত দৌড়াচ্ছিল বিমানের ছোট্ট জানালা দিয়ে মাটি দেখার চেষ্টা করছিলাম। আমেরিকার মাটি কেমন রং কি সবার আগে সেটিই দেখতে চাই। পারিনি। যতদূর চোখ গেছে পিচঢালা রানওয়ে চোখে পড়েছিল।

ক্যাপশন: দুনিয়ার খাবার তৈরী করে রেখে গেছেন চাচী

বিমানের গেট খোলার পর লাগেজপত্র নিয়ে নেমে ইমিগ্রেশন ফরমালিটি সারতে লাইন ধরলাম। ডিভি ওয়ান লটারী পাওয়াদের জন্য আলাদা লাইন ছিল। বেশী দেরী লাগেনি। সবাইকে আলাদা আলাদা ডেকে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা টুকটাক দুয়েকটি প্রশ্ন করেছিল আর আঙ্গুলের ছাপ নিয়েছিল। এরপর কংগ্রাচুলেশন্স বলে সিল মেরে দিয়ে মূল লাগেজ নেয়ার পথ দেখিয়ে দিয়েছিল। লাগেজ সংগ্রহ করার পর মনে মনে শংকিত ছিলাম, চাচা আমাদেরকে ঠিকমত চিনবেন তো?

মূল টারমিনাল থেকে বের হয়ে দেখি শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে। সবাই যার যার প্রিয়জনদের নিতে এসেছেন। এর মধ্যে গোলাম হোসেন চাচাকে খুঁজে বের করবো কিভাবে? কয়েক সেকেন্ড মাত্র, অনু অনু বলে চিৎকার দিতে দিতে ছুটে এসেছিলেন চাচা আর চচী। অনুকে জড়িয়ে ধরলেন। এরপর একে একে সবাইকে। কুশলাদি বনিমিয়ের পর অনুর হাতে থাকা লাগেজের কার্ট নিয়ে চাচা বললেন চল্ গাড়িতে যাই। চাচী বলেলন, তাড়াতাড়ি চলো, তোমার ভাইয়েরা সব অপেক্ষায় আছে।

টারমিনাল থেকে বের হয়েও মাটির দেখা পেলাম না। কোথাও কংক্রিটের আবার কোথাও টাইলসের ফ্লোর। হাটতে হাটতে চাচার গাড়ীর সামনে গিয়ে থামলাম। হালকা সবুজ রঙ্গের ডাজ ডুরাংগো এসইউভি গাড়ী ছিল সেটি। বাংলাদেশে ডাজ ব্রান্ডের গাড়ী কোনোদিন দেখিনি। খানিকটা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। এ্যাতোগুলো লাগেজ, এ্যাতোজন মানুষ; এই গাড়ীতে ধরবে তো? গোলাম হোসেন চাচা বললো চিন্তা করো না গাড়ীতে অনেক যায়গা। ৮ সীটের গাড়ী। পেছনের সারির সীটগুলো ফ্লোরে ভাজ করে দেয়ার পর লাগেজ রাখার যায়গা হয়ে গেল। আরামে বসলাম আমরা। আমি সামনে বসলাম। চাচী ওদেরকে নিয়ে পেছনে।

এয়ারপোর্ট থেক বের হওয়ার পর প্রথম নজরে এলো মাটি। একি, এতো একই রং একই কায়দা। ভেবেছিলাম আমেরিকার মাটির রং অন্যরকম হবে । নাহ্ একই। মাটিও দেখি মানুষের শরীরের রক্তের মতো। মানুষ সহ সারা দুনিয়ার সমস্ত জীবের রক্তের রং লাল। ঠিক তেমনি মাটির রংও দেখি সর্বত্রই একই। এই আমেরিকা আসার মাসখানেক আগে সবাইকে নিয়ে জাপান গিয়েছিলাম। ওসাকা টোকিও ইয়োকোহামা হিরোশিমা, যতোগুলো শহরে গিয়েছি, সবগুলোর মাটির রং একই রকম। জাপান যাওয়ার পথে ট্রানজিট থাকায় পুরো একদিন কাতারের দোহা শহর ঘুরলাম। সেখানকার মাটির রংও একই। থাইল্যান্ড গিয়েছিলাম দুই তিনবার; সেখানেও মাটির রং ঢং একই রকম।

এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে হতে চাচা ট্যুরিষ্ট গাইডের মতো বর্ণনা দিচ্ছিলেন। হ্যা হু করছিলাম ঠিকই; কিন্তু আমার চোখ ছিল বাইরের প্রকৃতির দিকে। বোঝার চেষ্টা করছিলাম, বাংলাদেশ, জাপান কিংবা কাতারের সঙ্গে পার্থক্য কি? তেমন কিছু বুঝতে পারছিলাম না। এবার গাছপালা দেখতে শুরু করলাম। রিশাতো এক পর্যায়ে বলেই ফেললো- নানাভাই তোমাদের এই আমেরিকার চেয়ে জাপান অনেক সুন্দর। হঠাৎই আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেলো, হ্যা ঠিক বলেছিস বাবা।

বাসা পর্যন্ত যেতে যেতে আমেরিকার জীবন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ব্রিফিং হয়ে গেল। বাসায় ঢুকে দেখি এলাহী কারবার। আমাদেরকে আনতে যাওয়ার আগে দুনিয়ার খাবার তৈরী করে রেখে গেছেন চাচী। চাচা চাচীর তিন পুত্র হাসিব আসিফ আশিকের সংগে পরিচয় হলো। রিশার চেয় বছর তিনেকের বড হবে ছোট ছেলে আশিক। তিনজনই বাংলায় কথা বলার ষ্কিল মোটামুটি ধরনের।

টেবিলে সাজানো পোলাও ভাত মাছ মাংস দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না। হাপুস হুপুস খেয়ে নিলাম। আমাদেরকে থাকতে দেয়া হলো মাঝখানর ঘরে। এসি আছে। তবু গরম। খাওয়া আর ঘুমিয়েই কাটে প্রায় এক সপ্তাহ। কতো আর ঘুমানো যায়। চাচাকে একদিন বলি একটা কাজ দেন। ধমক দিয়ে চাচা বলেন 'বাবারে সারা জীবন কাজই করতে হবে। কয়দিন আরাম করে নাও'।

তারপর একদিন সত্যিই শুরু হলো যুদ্ধ। জীবন যুদ্ধ। আর থামেনি। গত দশ বছরে কতোরকম যুদ্ধ যে করেছি; থাক সেসব, অন্য সময় বলবো। ৮১২ বারগেন ষ্ট্রিটের এই ঘরটিতে তারপর আরো অনেকজন এসে উঠেছে। গোলাম হোসেন চাচার চেনা অচেনা আত্মীয় অনাত্মীয় অনেকেরই প্রথম আশ্রয়স্থল এই ঘর। সেই হিসাবে চাচামিয়াকে ছোটখাটো দাতা হাতেম তাই আখ্যা দেয়া যায়।
যা বলছিলাম; অনেকদিন পর জামাইয়ের আগমন; তারপর আবার টেক্সাস থেকে চাচার চাচা শ্বশুর এসেছেন। ডাবল হরেক পদের রান্না হয়েছে আজ বাসায়। বাড়ীর ব্যাকইয়ার্ডে অনেক যায়গা। সামারে নানা সব্জী চাষ হয়। এবারও হয়েছে। লাউ কুমড়া সিম টমেটো কাচামরিচ বিভিন্ন রকম সব্জির বাগান। এবার চাচার বাগানে প্রচুর আঙ্গুর ধরেছে। আপেল গাছে নতুন আপেল এসেছে। প্রতি সামারেই বাগানে ঢুকে ছবি তুলি। খুব ভালো লাগে। এবারও তুললাম কয়েকটা।

(চলবে)