টিভি রিপোর্টিং ও সংবাদ পাঠ: কিছু খুঁটিনাটি

ফকির সেলিম
Published : 14 Nov 2015, 07:00 PM
Updated : 14 Nov 2015, 07:00 PM

বাংলাদেশের শুরুর দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশন আর বাংলাদেশ বেতারই ছিল সম্প্রচারের প্রধান গণমাধ্যম। সেখানে কাজ করতেন হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র মানুষ। তখন টিভি রেডিওতে লাইভ রিপোর্টিং হতোই না। সংবাদ পাঠক, বার্তা সম্পাদকের লিখে দেয়া ষ্ক্রিপ্ট পড়তেন ক্যামেরার সামনে বসে। বেতারের খবরের বেলাতেও ছিল তাই। সংবাদ উপস্থাপক সংবাদ সংগ্রাহক বার্তা সম্পাদকের যার যার কাজ যার যার মতো করে করতেন। গণমাধ্যম হলেও সংবাদপত্রের কথা এই আলোচনায় তুলছি না। কারণ বিষয়টি একান্ত সম্প্রচার কেন্দ্রিক।

চুয়াল্লিশ বছর পর এখন এক বিটিভি আর এক বেতারের পাশাপাশি বাংলাদেশে গোটা পঞ্চাশেক টিভি ও রেডিও। এখন সংবাদ সংগ্রহ, সংবাদ উপস্থাপনা, খবরের ষ্ক্রিপ্ট লেখা, ষ্পট থেকে সরাসরি প্রতিবেদন পাঠানো (লাইভ রপোর্টিং), ইত্যাদির পরিসর বেড়েছে বহুগুণ। বেড়েছে পেশার আকর্ষনও। একসময় খবর পড়াকে বলা হতো তোতাপাখির ন্যায় স্ক্রিপ্ট পড়ে যাওয়া। এখন আর তা খবর পড়ার মধ্যেই সীমিত নয়। খবর সংগ্রহ, ষ্ক্রিপ্ট তৈরীসহ নানা বিষয় এর সাথে সংশ্লিষ্ট। এর ফলে এখন টেলিভিশন ও রেডিওর খবর আগের তুলনায় অনেক পরিবর্তিত প্রানবন্ত স্বতস্ফুর্ত। সংবাদ পাঠক এখন শুধুমাত্র সংবাদ পাঠক নন, তিনি সংবাদ উপস্থাপকও।

যে কারনে এই আলোচনা, অত্যন্ত সংক্ষেপে তা সারতে চাই। সংবাদ উপস্থাপনা বা রিপোর্টিং, তা সে লাইভই হোক বা রেকর্ডিং করা হোক; যে কোনো উপস্থাপনাতেই সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন তা হচ্ছে শুদ্ধ উচ্চারন ও সঠিক বাচনভঙ্গি। বাংলাদেশের গোটা পঞ্চাশেক টিভি ও রেডিও'র সংবাদ পাঠ ও রিপোর্টিং এ এখন সবচেয়ে অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে এই বিষয়টির। সংবাদ উপস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্টদের কিছু তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক বিষয় সম্পর্কে আরেকটু পরিষ্কার ধারণা থাকলে আরো ভালো হতো।

একটি বিষয় অবশ্যই শিকার করতে হয় যে এ্যাতো কম সময়ে অতোটুকু একটি দেশে এ্যাতোগুলো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ঠিকমত যে চলছে সেটিই বেশী। এ্যাতো দ্রুত অভিজ্ঞ ও দক্ষ কর্মী পাওয়া সহজ নয়। তাই এখনি বলা ঠিক নয় যে তাদের যোগ্যতার অভাব। তারা বেশিরভাগই যোগ্য; তাদের শুধু প্রয়োজন একটু পেশাগত প্রশিক্ষণ। সামান্য একটু প্রশিক্ষণ নিয়ে যে কোনো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা সফল সংবাদ উপস্থাপক বা প্রতিবেদক হবার চেষ্টা করতে পারেন।

বর্তমানে বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রশিক্ষন কেন্দ্রে রিপোর্টিং, সাক্ষাৎকার নেয়া, সংবাদ উপস্থাপনা, মাইক্রোফোনের ব্যাবহার, কণ্ঠস্বর অনুশীলন, ক্যামেরা চালানো, ভিডিও এডিটিং, স্ক্রিপ্ট লেখাসহ সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে প্রশিক্ষন হচ্ছে শুনেছি। সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ রইলো আপনারা গণমাধ্যম কর্মীদেরকে; বিশেষ করে তরুণ ও নতুনদেরকে এসব শেখাবেন; বিশেষ করে শুদ্ধ উচ্চারণ ও বাচনভঙ্গী।

ইদানীং অনেক টিভি চ্যানেলের সংবাদ উপস্থাপক ও টকশো'র হোষ্টরা ক্যামেরার সামনে বসে রীতিমতো অভিনয় করেন। অভিনয় একটু আধটু করা যায়, কিন্তু তা যখন অতি অভিনয় হয় তখন তা দৃষ্টিকটু হয়। অভিনয় করতে গিয়ে সংবাদ পাঠক উচ্চারণে ভুল করেন যা তিনি বুঝতেই পারেন না। যে শব্দের ওপর জোর দেয়া দরকার সেখানে না জোর দিয়ে জোর দেন অন্য শব্দে। অনেক সময় এতে করে বাক্যের অর্থই ভিন্ন হয়ে যায়; তাও খবর পাঠক বুঝতে পারেন না।

বাংলাদেশের অধিকাংশ টিভি চ্যানেলের রিপোর্টারদের রিপোর্ট করার সময় বাক্যের শেষে বিশেষ এক ধরণের টান রাখেন। কি কারণে বুঝিনা। প্রায় সব টিভি ও রেডিও রিপোর্টিং এর ক্ষেত্রে এই ঘটনা। কেনো তা বুঝিনা। এই কারণেই বলি ছোট্ট সামান্য উচ্চারণের ওয়ার্কশপ করলেই এ সমস্যা ঠিক হয়ে যায়।

টিভি রিপোর্টিং:

বছর দশেক টিভিতে কাজ করার অভিজ্ঞতায় লব্ধ জ্ঞান এবং বিভিন্ন সময়ে এ সংক্রান্ত নেয়া প্রশিক্ষনের উপলব্ধি থেকে টিভি রিপোর্টিং সম্পর্কে দু'য়েকটি কথা বলি। টিভি রিপোর্টিং এর বেলায় ভিজুয়াল হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন বিষয়। স্কিপ্ট করার জন্য ভিডিওর ব্যাবহারের ওপর অপরিসীম গুরুত্ব দিতে হয়। স্ক্রিনে কি ভিডিও যাচ্ছে, স্ক্রিপ্টে তা সবার আগে ভাবতে হবে।

আপনি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো স্কিপ্ট লিখতে পারেন হয়তো, তবে ভিডিও যদি ওই স্ক্রিপ্টের সাথে সঙ্গতিপূর্ন না হয় তবে তার কোনো মানে নেই। সব দর্শক শোনার চেয়ে স্ক্রিনে কি যাচ্ছে তার প্রতি বেশী লক্ষ দেন।

ধরা যাক আপনি ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটে একটি কনফারেন্স কভার করতে যাচ্ছেন। বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশ ও সরকার। সেখানে আপনি বিপুল সংখ্যক শ্বেতাঙ্গ মানুষের ভিডিও করলেন। তারা বাংলাদেশ সম্পর্কে কথা বলছেন। প্যানেলে যারা তারাও বাংলাদেশ সম্পর্কে নানা বক্তব্য দিচ্ছেন। অথচ আপনার স্কিপ্টে বাংলাদেশের নানা সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন আপনি। দর্শকরা আপনার ভয়েসওভার বা বর্ণনা শুনছেন কিন্তু বুঝতে পারছেন না। তারা স্ক্রিনে দেখছেন শ্বেতাঙ্গ মানুষেরা কথা বলছেন, অথচ ভয়েসওভারে বা বর্ণনায় বাংলাদেশের সমস্যার কথা বলছেন। দর্ক স্রোতা এতে বিরক্ত হয়। ভিডিওর সঙ্গে মিলিয়ে ষ্পষ্ট করে বলতে হবে যে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষেরা বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলছেন।

ধরা যাক আপনি বেস্ট বাইতে গেলেন। বেস্ট বাইতে অসংখ্য টেলিভিশনের স্ক্রিনে একসঙ্গে মিউজিক ভিডিওর দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। আপনি হেডফোনে গান শুনছেন। টিভিতে কি গান হচ্ছে আপনি পরোয়া করছেন না। কিন্তু ভিডিও দেখতে খারাপ লাগছে না। কারন দেখা, চোখের দেখা হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন। আপনার চোখ কি দেখছে টিভির জন্য সেটি বেশী গুরুত্বপূর্ন। এক্ষেত্রে কান হচ্ছে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ন অঙ্গ।

যখন আপনিটি টিভির জন্য কাজ করবেন, মনে রাখা জরুরী যে মানুষের প্রথম সেন্স হচ্ছে চোখ। স্ক্রিনে আপনি কি দেখছেন সেটি। ফলে ভিডিওর সঙ্গে বক্তব্য ম্যাচ করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ন। চলচ্চিত্র বলুন, নাটক বলুন, নাচ বলুন, গান বলুন আর খবর বলুন, টেলিভিশনের সকল ক্ষেত্রের জন্য প্রথম বিষয় হোচ্ছে চলমান দৃশ্য। দৃশ্যায়নের ওপর নির্ভর করে সবকিছু। দৃশ্যই দর্শকদেরকে শব্দের সংকেত দেয়। দৃশ্য শব্দকে মনে করায়। তাই যে কোনো স্ক্রিপ্ট লেখার আগে সংশ্লিষ্ট ভিডিও দেখে নিন।

সংবাদের ভিডিও ধারণ:

সংবাদের ফুটেজ নেয়ার জন্যে ভিডিও ধারণ নিয়ে কিছু কথা। টেলিভিশনের খবরের জন্যে, প্রামান্য চিত্র বা যে কোনো অনুষ্ঠান তৈরীর জন্য ভিডিও ধারণকালে পেশাদার ফটোগ্রাফার বা কামেরাম্যানকে সবচেয়ে জরূরী যা মনে রাখতে হবে তা হচ্ছে ক্যামেরার স্থিরতা। ক্যামেরা নড়বে না। ট্রাইপড ব্যাবহারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ধরা যাক, আপনি একটা ট্রেডমিলে হাটছেন। ক্যামেরাম্যান চারদিক থেকে ছবি তুলছে। কাছে যাচ্ছে দূরে যাচ্ছে। জুম ইন জুম আইট করছে। টিল্ট আপ টিল্ট ডাউন করা হচ্ছে। এটা ঠিক নয়। এটা এ্যামেচারিজম। বরং পায়ের ক্লোজ শট নিন, লং শট নিন। হাতের ক্লোজ আপ নিন। ক্যামেরা স্থির রেখেই ভিডিও করতে হবে।

ক্যামেরাম্যান মুভ করবে না। যখন সাবজেক্ট মুভ করছে তখন ক্যামেরা মুভ করবে না। যখন সাবজেক্ট নড়াচড়া করছে তখন ক্যামেরা নাড়ানোর প্রয়োজন নেই। আপনি ক্যামেরাম্যান। কিন্তু আপনি যদি না জানেন পেশাদার ক্যামেরা চালানোর নিয়ম তবে তা এ্যামেচারিজমই হবে। বিষয়ের ১০/১২টা শট নিন ক্যামেরা স্থির রেখে। ডকুমেন্টিং করুন। একসাথে জোড়া লাগান। ক্যামেরা মুভ করবেন না মোশন করার জন্য। মোশন ধরবেন সাবজেক্টের। সাবজেক্টের এ্যাকশন ধরবেন। পেশাদারী শুটিংয়ের সময় ৯৫ শতাংশ প্যান হবেনা, জুম হবেনা; নিতান্ত দরকার না হলে।

ছবিতে প্রতি শট আলাদা করে নিয়ে মুভমেন্ট করানো হয়। যখন ১০টি শট নেয়া হয় তা এক করে মুভমেন্ট করা হয়। প্রয়োজন ছাড়া কখনোই ক্যামেরা মুভ করা যাবে না। বহু বছর আগে কোনো এক সময় আপনার পিতামহ হয়তো ক্যামেরা নিয়ে পেছনে পেছনে ঘুরে আপনার বহু ছবি তুলেছেন। আপনি পেশাদার, আপনি তা করবেন না। বহু ষ্টিডি শট নিয়ে তা একত্রিত করবেন।

প্যান ব্যাবহার হয় খুব নির্দিষ্ট কাজে। ধরুন আপনি ঢাকার একটা বস্তিতে পানি সমস্যার স্টোরি করছেন। শিশুরা রোগে আক্রান্ত। প্রথমে রিপার্টার কথা বলছে সমস্যা নিয়ে। শিশুরা দুষিত পানি নিয়ে খেলছে এমন একটি শট নিন। ওয়াইড মিডিয়াম টাইপ শট নেবেন। প্রথম ওয়াইড, মিডিয়াম, টাইট শট। সব তিনবার করা ভালো। এরপর জোড়া লাগাতে হবে। প্যান কিংবা জুম হলেও তা জোড়া লাগাতে হবে।

রিপোর্টার ও ক্যামেরা পারসন দুজনের প্রতি অনুরোধ; আপনি বা আপনারা যেদিন কোন ইভেন্টে যাবেন সে স্টোরিটা সেদিনই জমা দিতে হবে। কালকের জন্য ফেলে রাখা ঠিক নয়। যেদিন শুটিং সেদিনই তা করা উচিৎ। ৪ টায় কোনো ইভেন্ট হলে তার আগেই সেখানে যাওয়া উচিৎ রেডি হয়ে। ৭ টায় শো। ৬ টায় বসলে হবে না। ৪ টায় এডিটিং শুরু করুন।

ব্রডকাষ্টার বা সম্প্রচারকদের নিয়ে কিছু কথা:

এবার ব্রডকাষ্টার বা সম্প্রচারক নিয়ে কিছু কথা। ব্রডকাষ্টার, সংবাদ পাঠক, উপস্থাপক, রিপোর্টার – আপনি যেই হোন না কেনো, আপনার প্রতি আমার প্রথম অনুরোধবোধক শব্দটি হচ্ছে 'রিল্যাক্স'; খবর পড়া শুরুর আগে আরাম করে লম্বা একটা শ্বাস নিন। রিল্যাক্স; শব্দটি ব্রডকাষ্টিং বা সম্প্রচারের জগতে শব্দটি বেমানান। তবুও সম্প্রচারকদের উদ্দেশ্যে প্রথমেই বলি 'রিল্যাক্স'। যারা সরাসরি সম্প্রচার (লাইভ ব্রডকাষ্ট) করছেন কিংবা উত্তেজনাকর অবস্থায় বা যুদ্ধ ক্ষেত্রের খবর পাঠাচ্ছেন, তাদেরকেও বলবো 'রিল্যাক্স'।

রেডিও এবং টেলিভিশনের সম্প্রচারকদের কাছে খটকা লাগছে হয়ত। সময় এবং সীমার মধ্যে থেকে, চাপ এবং উত্তেজনার মধ্যে থেকে, নীতি এবং কৌশলের মধ্যে থেকে 'রিল্যাক্স' কিভাবে সম্ভব। ভাবছেন 'বোকা নাকি?'

টেলিভিশন ও রেডিও প্রতিবেদকের কাজে চাপ উত্তেজনা এবং সময় বেঁধে দেয়া থাকে এটা ঠিক। তাকে সংবাদ অধিবেশনের ডেডলাইন মানতে হয়। সময় বেঁধে দেয়া হয় রিপোর্ট জমা দেয়ার জন্যে। কিন্তু তাকে প্রতিবেদন তৈরীর জন্য বাইরে যেতে হয়, ফোন করতে হয়, সংশিলষ্ট মানুষজনের সাক্ষাৎকার নিতে হয়। হাতে সময় থাকে কম।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিবেদককে আবার ষ্ট্যান্ড-আপ করতে হয় যাকে অনেকে পিটিসি বলে থাকেন। তাৎক্ষনিকভাবে ষ্ট্যান্ড আপের বা পটিসির জন্যে স্কিপ্ট তৈরী করা, সাউন্ড এবং ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে তা বলাসহ অল্প সময়ের মধ্যেই সবকিছু করতে হয়। তার ওপর থাকে প্রতিবেদনটির ভয়েস ওভার। নির্ধারিত সময় সীমার মধ্যেই সব করতে হয়। এ অবস্থায় 'রিল্যাক্স' শব্দটি প্রযোজ্য নয় ঠিক, তবে তাড়াহুড়া না করে ধীর স্থির ভাবে করলে প্রতিবেদন ভালো হয়।

কিন্তু এই তাড়াহুড়ো, চাপ, উত্তেজনা, ভয়, হয়ত একদিন আপনার ব্রডকাষ্টার বা সম্প্রচারক পেশার জন্যই হয়ে উঠবে শংকার বিষয়।তাই আবারো বলি, 'রিল্যাক্স'। জানি যতোই রিল্যাক্স বলি, এই চাপ আর উত্তেজনাকর দিনলিপিই সম্প্রচারকদের জীবন। এতেই আনন্দ। এতেই বিষাদ। অন্য কোনে পেশায় এটা নেই। আর থাকলেও এমন করেনেই।   ব্যবসার সাথে যারা সংশ্লিষ্ট তাদের যে কোন মিটিং, শিপমেন্ট, ক্রয়, বিক্রয়, ইত্যাদির জন্য নির্দিষ্ট করা থাকে দিনক্ষন। লেখক, অভিনেতা, শিল্পি সবারই থাকে সময় বেঁধে দেয়া। থাকে নির্দিষ্ট নিয়ম। তাদের কাজ সৃষ্টিশীল। আর তাই সেই সৃষ্টিশীল প্রোডাকশনের জন্য লাগে প্রয়োজনীয় সময় ও পদ্ধতি।

কিন্তু সম্প্রচারক? সৃষ্টিশীল হতে হবে, তবে হাতে সময় কম। প্রতিবেদক বলুন, ফটো সাংবাদিক বলুন, ভিডিওগ্রাফার বলুন, সবাইকেই মানতে হয় অতি অল্প সময়ের ডেডলাইন। কাজ করতে হয় চাপ আর উত্তেজনায়। ফলে সব সময় রিল্যাক্স সম্ভব হয় না।

সংবাদ পাঠক কিংবা কন্ঠ ব্যবহারকারী সম্প্রচারকের 'রিল্যাক্স' করতেই হবে। কারন কন্ঠস্বর নির্ভর করে শরীরের বিভিন্ন মাংসপেশী, অঙ্গ প্রতঙ্গ, রক্ত সঞ্চালনের মাত্রা ও অনুভূতিরওপর। উত্তেজনা স্বরভঙ্গীর  পরিবর্তন ঘটায়। অঙ্গবিন্যাস ও মেজাজের ওপর প্রভাব ফেলে। নি:শ্বাস-প্রশ্বাস ও স্বর নিয়ন্ত্রণে বিঘ্ন ঘটায়। শরীরে যদি প্রেষন, চাপ বা উত্তেজনা থাকে তবে তা কন্ঠেও প্রকাশ পায়।

উত্তেজনা প্রশমন করে কন্ঠস্বর সুন্দর রাখার সবচেয়ে ভাল উপায় হচ্ছে ঠিকমত নি:শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া। ষ্ট্রেস কন্ট্রোল বা উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণের কর্মশালায় (ওয়ার্কশপ) অংশ নেয়া এজন্য খুব জরুরী। এতে শ্লথন বা রিল্যাক্সেশনের জন্য নি:শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যচ্ছদা সম্পর্কিত নিয়মাবলী শেখানো হয়।

স্বাভাবিক নি:শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া কতো গুরুত্বপূর্ন তা প্রাকৃতিক উপায়ে গর্ভপাতের সঙ্গে তুলনা করলেই বোঝা যায়। গর্ভপাতের সময় চিকিৎসকেরা সব সময় মায়েদরকে নি:শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখার পরামর্শ দেন। এই প্রক্রিয়ার মূল কথা হচ্ছে নি:শ্বাস গ্রহণ হবে দীর্ঘ আর নি:সারন বা শ্বাস বর্জন হবে ধীর গতিতে। যে কোনো ধরণের ব্যাথা উপশম বা উত্তেজনা কমাতেও চিকিৎসকেরা এই পরামর্শ দিয়ে থাকেন। চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গেলে বা কোনো সমাবেশে বক্তৃতা দেয়ার আগে এই প্রক্রিয়া চাপ কমাতে খুব কাজে লাগে।

ইয়োগা কিংবা দর্শনশাস্ত্রেও যুগ যুগ ধরে এই নি:শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া মেডিটেশনের অংশ হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ইয়োগা'র দর্শনই হচ্ছে যদি 'প্রানা' বা শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণকরা না যায় তবে মন'কে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।

একইভাবে, সম্প্রচারকদের ক্ষেত্রে মূল দর্শনই হচ্ছে: নি:শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করতে না জানলে কন্ঠস্বর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। সম্প্রচারক যদি ঔদরিক মধ্যচ্ছদা সম্পর্কিত(এ্যাবডোমিনাল) নি:শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করতে না শেখেন তবে তার জন্য কন্ঠস্বর ভাল রাখা কঠিন হয়। সম্প্রচারকের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন হচ্ছে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ।

এই প্রক্রিয়াটি শরীরের আবেগ উত্তেজনা প্রশমন করে শরীরকে সজীব করে তোলে এবংমনে প্রশান্তি ছড়িয়ে দিয়ে মনকে পরিচ্ছন্ন করে। সঠিক নি:শ্বাস প্রশ্বাস প্রক্রিয়া শুধু যে রিল্যাক্সেশন বা শ্লথনের জন্য সহায়ক তা নয়; এটি কন্ঠের শক্তি জোগায়। বক্তার বক্তৃতা দেয়া বা প্রতিবেদকের ভয়েস ওভার করা কিংবা সংবাদ পাঠকের খবর পড়ার জন্য এই প্রক্রিয়া তার দাম বাড়ায়।