ঘুরে আসুন মেইন-১২

ফকির সেলিম
Published : 13 Nov 2016, 10:52 AM
Updated : 13 Nov 2016, 10:52 AM

রেডী হয়ে হোটেল থেকে বেরিয়েই নাস্তার জন্য রাস্তার ওপারে ডাংকিন সাহেবের দোকানে ঢুকলাম। বেলা দশটা তারপরও নাস্তা কেনার লম্বা লাইন ডাংকিন ডোনাটে। 'আমেরিকা রানস অন ডাংকিন'; ডোনাট এই বিজ্ঞাপনটি মনে হল মিথ্যা নয়।

মজার ব্যাপার হলো দশ বছর যুক্তরাষ্ট্রে কাটালাম অথচ এখনো কোথাও লাইন দেখলেই মেজাজ খারাপ হয়। লাইন ধরার অভ্যাসতো নেই এজন্যই মেজাজ খারাপ হয়। তিরিশ বছরেরও বেশী সময় পার করে এসেছি জন্মভূমি বাংলাদেশে। কোথাও কোনোদিন লাইন ধরনি। লাইন ধরার শিক্ষাও নেইনি। এখানে আসার পর শুরু হয়ছে লাইন ধরা। হাটে মাঠে বাসে রেলে দোকানে পার্কে যেখানেই যাও লাইন ধরতেই হবে। বিগ বস থেকে ঝাড়ুদার সবাই লাইন ধরে।

২০০৫ সালের পেহেলা জুলাই থেকে এই লাইন ধরার চর্চা করে চলেছি। চর্চার অংশ হিসাবে আজও নাস্তা কেনার জন্যে ডাংকিন ডোনাটে লাইন ধরলাম। কে কি খাবে তা নিয়ে লাইনে দাড়িয়েই ছোটখাট বৈঠক হয়ে গেল। অনু রিশা রামিনের মেনু আমার জানা। অনুর পছন্দ ক্রোসান্ত উইথ এগ। রিপা রিহা বেলাল ভাইও ঐ একই জিনিষ খাবে। রিশা রামিনের পছন্দ স্ট্রবেরী ডোনাট আর হট চকলেট। আমার খাবার, চিজ বেগেল টুইস্ট; সংগে মিডিয়াম কফি। শহীদুল দর্পনও যে যার পছন্দমত নাশতা নিল।

ঘন্টাখানেক শোরগোল করে দোকানটা মাতিয়ে রাখলাম আমরা। মাতৃভাষায় চলছে সবই। সকাল বেলা দোকানে আমাদের জমজমাট আড্ডা দেখে কম কথার দেশ মেইনের বাসিন্দারা আড়জোখে তাকায়। আমাদের কুছ পরোয়া নেহি ষ্টাইল। ভুল করে কারো সঙ্গে চোখে চোখ পড়লে অপর পক্ষ থকে প্লাষ্টিক স্মাইল। প্লাষ্টিক স্মাইল বা কৃত্রিম হাসি ব্যাপারটি শিখেছি; তাও বছর তেরো হয়ে গেল জাপানীদের কাছ থেকে। আমার মতো আড্ডাবাজ নিয়ম শৃংখলা না মানা ভবঘুরে বাউল টাইপের একটা মানুষ টানা সাত বছর কুটনৈতিক পরিবেশে পেঙ্গুইন সেজে (নিয়মিত কোট টাই পরে) পাংচুয়ালিটি মেনটেইন করে প্লাষ্টিক স্মাইল প্রাকটিস করেছি; ভাবতেই অবাক লাগে।

ডানকিন থেকে বের হয়ে সোজা হাইওয়ে ধরে ঘন্টা দেড়েক গাড়ী চালানোর পর বেইলি দ্বীপের সাইন পাওয়া গেল। দর্পনকে ফলো করছি আমি। হাইওয়ে থেকে এক্সিট নেয়ার পর যে রাস্তা সেটির দুপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বর্ননা করা সত্যিই কঠিন। সিংগল লেনের টু ওয়ে রাস্তা। স্পীড লিমিট কোথাও ৩৫ কোথাও ৪০। ছোট ছোট পাহাড়ী ঢাল। আঁকাবাকা সেই রাস্তার দুপাশেই পানি। স্পীড বাড়ানোর সুযোগও নেই তেমন। কিছুদূর পর পর চমৎকার স্থাপত্যশৈলীর ছোট্ট ছোট্ট বাড়ী। বাড়ীগুলো আসলে পর্যটকদের থাকার জন্যে ভাড়া দেয়া হয়।

বেইলি দ্বীপ পোর্টল্যান্ড থেকে মাইল দুয়েকের ড্রাইভ। অনেক কাছেও আরো বেশ কয়েকটি দ্বীপ আছে। কিন্তু আমাদের টারগেট বেইলি দ্বীপ। কারণ ওখানে সব খানদানী জেলেদের বসবাস। তাদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করাটাই উদ্দেশ্য। সে গল্পে যাবার আগে ছোট্ট করে ক্যাস্কো উপসাগরের আরো ছয়টি দ্বীপের কথা বলে নেই।

মেইনের ক্যাস্কো উপসাগরে রয়েছে বেশ কয়েকটি দ্বীপ। পিকস দ্বীপ, লিটল ডায়মন্ড দ্বীপ, গ্রেট ডায়মন্ড দ্বীপ, লং আইল্যান্ড, শিবাগ দ্বীপ, ক্লিফ আইল্যান্ড এবং বেইলী দ্বীপ। প্রতিটি দ্বীপের রয়েছে আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট।

পিকস আইল্যান্ড:
পিকস আইল্যান্ডটি পোর্টল্যান্ড শহর থেকে মাত্র ১৭ মিনিটের দুরত্বে। একদা এই দ্বীপটি মেইনের কোনি আইল্যান্ড নামে পরিচিত ছিল। দ্বীপটি আবসর নেয়া আমেরিকানদের জন্যে অবসর যাপনের দারুন স্থান। ড্রাইভিং ছাড়াও পোর্টল্যান্ড থেকে ফেরীতে যাওয়া যায় দ্বীপটিতে। এখান থেকে দেখা যায় ক্যাস্কো উপসাগরের চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য।

লিটল ডায়মন্ড দ্বীপ:
পোর্টল্যান্ড থেকে মাত্র ১৫ মিনিটের দূরত্বে রয়েছে অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দ্বীপ লিটল ডায়মন্ড। ক্যাস্কো সাগরের জোয়ার ভাটার সাথে সাথে রূপ বদলায় দ্বীপটি। জোয়ারের সময় মনে হবে এটি একটি ভাসমান দ্বীপ। মজার বিষয় হচ্ছে এই ক্ষুদ্র দ্বীপটির হাতে গোনা কিছু অধিবাসীর ব্যাবহারের সব পানি সরবরাহ হয় পোর্টল্যান্ড শহর থেকে।

গ্রেট ডায়মন্ড দ্বীপ:
পোর্টল্যান্ড শহরেরই অংশ গ্রেট ডায়মন্ড দ্বীপ। দূরত্ব; শহর থেকে ২৫ মিনিট। রাস্তা না থাকায় দ্বীপে গাড়ী চালিয়ে যাওয়া কঠিন। গল্ফ কার্ট আর বাইসাইকেল ঐ দ্বীপে যাওয়ার প্রধান বাহন। আর এই বিষয়টিই হচ্ছে গ্রেট ডায়মন্ড দ্বীপের সেলিং পয়েন্ট। 'কার ফ্রি এবং চিল্ড্রেন ফ্রেন্ডলী' দ্বীপ হিসাবে এখানে তাই প্রচুর পর্যটক আসেন। ডায়মন্ড কোভ নামের ফেরী করে স্থানীয় অধিবাসী ও পর্যটকদেরকে এখানে আনা হয়। দ্বীপটিতে ডায়মন্ড এজ নামে একটি রেস্টুরেন্ট আর দৃষ্টিনন্দন ঝর্না রয়েছে।

লং আইল্যান্ড:
লং আইল্যান্ড হচ্ছে ক্যাস্কো উপসাগরের দ্বিতীয় বৃহত্তম দ্বীপ। পোর্টল্যান্ড শহর থেকে ঘন্টাখানেক লাগে লং আইল্যান্ড যেতে। সাগর উপকুলে অপরূপ রূপ মাধুর্যে মন্ডিত ওই দ্বীপটি প্রায় তিন মাইল লম্বা এবং এক মাইল চওড়া। দ্বীপের বাসিন্দার সংখ্যা ২০০ থেকে ১০০০ জন; ঋতুভেদে এ সংখ্যা বদলায়। শীতকালে কমে যায় আর শীত শেষে তা বাড়ে। স্থানীয়দের একমাত্র পেশা সাগর থেকে লবস্টার ধরা।

ক্যাস্কো উপসাগরের অন্যান্য দ্বীপের মতো লং আইল্যান্ডে একদা নেটিভ আমেরিকানরা বসবাস করতেন। ক্যাস্কো উপসাগরের অন্যান্য দ্বীপর ন্যায় ষোড়ষ শতাব্দী থেকে সেখানে বাইরের লোকে বসতি শুরু করে। ১৭৩২ সালে করনেল ইজেকিল নামের এক পশ্চিমা প্রথম সেখানে ঘর বানান। ১৭৬৫ সালে তিনি মারা যান, ৯ সন্তান রেখে। তারাই প্রথম ক্যাস্কো সাগর থেকে লবস্টার ধরাকে পেশা হিসাবে নেন। তাদের পাশাপাশি সেখানে বাইরে থেকে লোক আসা শুরু করে; সাধারনত মাছ ধরার পেশাজীবি হিসাবে কাজ করার লক্ষ্য নিয়ে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লং আইল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্র নৌবাহিনীর বড় ঘাঁটি হিসাবে কাজ করে। তখন সেখানে নির্মিত বহু স্থাপনা এখন দর্শনীয় স্থান।

লং আইল্যান্ড ১৯৯৩ সাল থেকে স্বতন্ত্র শহর হিসাবে নিজস্ব প্রসাশন ও ব্যাবস্থাপনায় দ্বীপটি পরিচালনা করে আসছে। শহরে রয়েছে একটি কেজি-৫ স্কুল, বর্তমানে যার শিক্ষার্থী সংখ্যা ১৩, শিক্ষক ২ জন। রয়েছে একটি লাইব্রেরী, একটি আর্ট গ্যালারী, একটি ফায়ার স্টেশন, একটি প্রি স্কুল, একটি পোস্ট অফিস, দুটি দোকান, একটি ইন এবং শুধুমাত্র সামারের জন্যে একটি উপহারের দোকান। দ্বীপের নিরিবিলি পরিবেশে সাগর তীর ধরে হাটা কিংবা সাইকেল চালিয়ে ঘোরা; যে কোনো মানুষের জন্যে দারুন উপভোগ্য। এই দ্বীপটি সবচেয়ে বিখ্যাত যে কারনে তা হচ্ছে এর চমৎকার বালুময় বীচ। বলা হয় ওই বীচে হাটার ছন্দে ছন্দে বালুর বিন্দুগুলো সংগীতের তালে যেনো তালে নৃত্য করে।

শুহবিগ দ্বীপট:
শুহবিগ দ্বীপটি মেইনের সবচয়ে সুন্দর স্থানগুলোর একটি। পাঁচ মাইল লম্বা দেড় মাইল চওড়া অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা এই দ্বীপে পোর্টল্যান্ড থেকে যেতে সময় লাগে দেড় ঘন্টা। ক্যাস্কো সাগরের সবগুলো দ্বীপের মধ্যে শুহবিগ সবচেয়ে বড়। সারা বছরই পর্যটকের ভীড় থাকে এখানে। তবে লং আইল্যান্ডের মতোই এখানে স্থানীয় বাসিন্দার সংখ্যার তারতম্য ঘটে ঋতুভেদে। গ্রীস্মকালে ১৬০০ পরিবার নিয়মিত বসবাস করেন। নানা ধরনের নাগরিক সুবিধাসহ এখানে রয়েছে পর্যটকদের জন্যে নান ঐতিহাসিক নিদর্শন। লাইব্রেরী মার্কেট গল্ফ ক্লাব মিউজিয়াম হ রয়েছে বহুকিছু।

ক্লিফ আইল্যান্ড:
ক্যাস্কো উপসাগরের ছোট্ট সুন্দর দ্বীপটির নাম ক্লিফ আইল্যান্ড। পোর্টল্যান্ড থেকে দূরত্ব দুই ঘন্টা। ইংরেজী বর্ণ এইচের মত আকারের এই দ্বীপটির শেষ মাথায় গেলে মনে হবে স্থলভাগের শেষ সেটি। ক্লিফে গাড়ীতে করে ঘোরার চমৎকার রাস্তা থাকলেও বেশীরভাগ মানুষ বাইসাইকেল অথবা পায়ে হেটেই উপভোগ করেন অপরূপ প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য।
(চলবে)