কোঁচ ও একটি নিপুণ শেষ-শিকার

সেজান মাহমুদ
Published : 17 July 2017, 02:36 AM
Updated : 17 July 2017, 02:36 AM

হুড়াসাগর নদীর শুকনা, মরা-ঢোঁড়া-সাপের-মতন চেহারাখানা দেখলে নইমুদ্দির ছোটবেলায়-দেখা নাজির চাচার বুড়া বয়সের জিনিসপত্তরের কথা মনে পড়ে। কেন মনে পড়ে তা বুঝে উঠতে পারে না নইমুদ্দি। নাজির চাচা বেহুদার মতো লুঙ্গি কাছা মেরে ন্যাটা দিয়ে বসে থাকতেন আর কখন যে বেখায়ালে জিনিসপত্তর বের হতো তা হুশ করতেন না। ফাজিল পোলাপান গলা খাঁকারি দিয়ে জানান দিতো 'চাচা, লুঙ্গি সামলায়া বইসেন।' আর তখন পাছার ধুলা ময়লা ঝেড়ে নাজির চাচা লাফিয়ে উঠতেন, ভাবখানা যেন পোলাপানের বলাটা মহা দোষ হয়ে গেছে। বুড়া বয়সের ঝুলে-পড়া জিনিসপত্তর যেমন কোন কামের না, হুড়া সাগরের দশাও অনেকটা সেইরকম; কোন বান আসে না নদিতে, কোন কামের না। শুকনা চরগুলো মানুষজন যে যার ক্ষমতা দিয়ে দখল করে নিয়েছে। এখন নানান ফসলের চাষবাস আর গরু চড়ানো। কেউ কেউ আরেক ধাপ সরেস; এরা নদীর জমির মধ্যেই বাড়িঘর বানিয়ে সংসার পেতে বসেছে। কিন্তু ছোটবেলায় দেখা হুড়াসাগরের উথালি পাথালি রূপ মন থেকে সরাতে পারে না নইমুদ্দি।

নইমুদ্দি এতোটুকু চিন্তা একসঙ্গে করতে পেরে খুব আমোদিত হয়। ফুরফুরে মন নিয়ে হাটখোলার দিকে এগিয়ে যায়। আজ হাটবার। আশেপাশের গ্রামগঞ্জ থেকে মানুষ আসা শুরু হয়েছে। হাটখোলার লাগোয়া মাঠের মধ্যে ঘাসের ওপরে পাটের ব্যাপারীরা চৌকশ গলায় সহজ-সরল কৃষকের কাছে থেকে পাট কিনতে নানান ফন্দিফিকিরের কাহিনি বলতে থাকে-
–'কয়দিন হইলো মহাজনেরা পাটকল বন্ধ-থাকায় নদিতে আটকা পইড়া আছে জানো? দাম দিমু কি নিজের প্যাটে নাত্তি মাইরা?"
আর কথার ফাঁকে কায়দা করে পাট মাপার স্কেলটাকে হাতের মধ্যে একটু কসরত করে ওজনটা কমিয়ে দেখায়। সবজির বাজারে ঝাঁকা-ভর্তি লাউ, কুমড়া, শসা নিয়ে বসতে শুরু করেছে কেউ কেউ। উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব -পশ্চিম সব দিক থেকে মানুষ আসছে পিঁপড়ার মতন। নইমুদ্দি ধীরে ধীরে চিন্তার খেই হারাতে থাকে আর একটা সুক্ষ্ণ কিন্তু তীব্র ব্যথা টের পায় মাথার মধ্যে। জোরে হাঁটতে থাকে নইমুদ্দি সড়ক পথের দুইধারে সারি সারি চায়ের দোকানগুলোর দিকে; সুজানের দোকানে গেলে এক কাপ চা না হোক একটা বেলা বিস্কুট পাওয়া যায়। জোরে জোরে পা চালায় নইমুদ্দি আর সুজানের দোকানে পৌছুতে পৌছুতে মাথার মধ্যের ব্যাথাটা সমস্বরে খোঁচা দিতে থাকে। নইমুদ্দি সোজা দোকানের সামনের বাঁশের মাচার মতো বেঞ্চিটায় বসে আর চিৎকার করে বলে,
— 'হায় আল্লাহ, এ আমি কী কইরলাম?'
সুজান দোকানেই ছিল। বলে, 'নইমুদ্দি ভাই চা খাইবা'? নইমুদ্দি এতক্ষণে মাথা ব্যাথায় কাতর আর চিন্তাভাবনা গুলো কেমন এলোমেলো লাগলে গভীর নিশ্বাস নিয়ে বলে,
— "হায়রে, এই যে এত্তো মানুষ আটের মদ্দে আউলাইয়া গেলো, এগো গোছাইবো কেডো রে ?"
এ কথায় দোকানের সামনে বসে-থাকা চা-সিগারেট-খোর এক খদ্দের হেসে ওঠে-
"শালার পাগল তো দেখি মহা চিন্তার কথা কয়, মারেফতি কথা কয়।'
খদ্দের যদিও ভাল বরাত নিয়ে আসে কিন্তু নইমুদ্দি কে কেউ পাগল বললে সুজান তা সহ্য করতে পারে না। সুজান গলা না চড়িয়েও শক্তভাবে বলে,
–ভাইজান, নইমুদ্দি ভাইরে পাগল কইয়েন না। হে পাগল না।
একথা বলতে বলতে নইমুদ্দির দিকে এক কাপ চা আর একটা বেলা বিস্কুট এগিয়ে দেয় সুজান। নইমুদ্দিকে এখনো গুরুর মতো মান্য করে সুজান। নইমুদ্দি তো গুরুই ছিল তার; মাছ ধরার গুরু। সেই ছোটবেলায় দেখতো গ্রামের সবাই নইমুদ্দির কাছে মাছ ধরার জন্যে আসতো। কেউ আসতো কেমন করে ভাল পলো বানানো যায়, কেমন করে আন্টা আর বিটে বানিয়ে ছোটখাটো স্রোতের ধারায় বসিয়ে অনায়াসে মাছ ধরা যায় তা শিখতে। আর নইমুদ্দি ছিল এসবের ওস্তাদ। কোন বাঁশের ফলা বানাতে হবে, কোন তেলে মালিশ করে পোক্ত করে নেয়া যায় সেই বাঁশের শলা আর কেমন করে বানাতে হবে কৌশলী চাঁই, যাতে খোপে মাছ ঢুকতে পারে অনায়াসে কিন্তু বেরুতে না পারে। সুজানের ছিল জালের জন্য টান। ঝাঁকিজাল, ধর্মজাল, খড়াজাল সবই বানাতে পারতো নইমুদ্দি। সুজান যখন ছোট তখন নইমুদ্দি একটা ঠ্যালা জাল বানিয়ে দিয়ে ছিল সুজানকে। সেই জাল বুনানোর সময় সুজান গিয়ে পাশে বসে থাকতো নইমুদ্দির। কী নিপুণ হাতে নিজের হাতে বাঁশ-দিয়ে বানানো সুতার ববিনটা হাতের মুঠোয় নিয়ে দ্রুত গতিতে জাল বুনতো আর সুজান মুগ্ধ হয়ে ভাবত ইশ আমিও যদি এরকম জাল বুনতে পারতাম! একবার নান্দিনা মধুর বিলে বাউত নামলে দলে দলে লোকজন পলো হাতে মাছ ধরতে গেল আর সুজান কে সঙ্গে নিয়েছিল নইমুদ্দি সেই ঠেলা জালটা হাতে দিয়ে। এক খালুই ভর্তি কই, খোলশা, পুটি মাছ ধরার সেই আনন্দ সুজান কোনদিন ভুলতে পারবে না। নইমুদ্দির নিজের পছন্দের জাল ছিল মইয়াজাল। নৌকা নিয়ে মইয়াজাল দিয়ে মাছ ধরতে কতদিন সাগরেদ হয়েছে নইমুদ্দির তার ইয়ত্তা নাই।
কেন জানি সুজানকে খুব স্নেহ করতো নইমুদ্দি। নিজের টিনের বাড়িতে একটা বাড়তি ঘর ছিল মাছ ধরার সরঞ্জাম দিয়ে ভরা। সেখানে কাউকে ঢুকতে দিতো না। কিন্তু সুজান কে ডেকে দেখতে দিয়েছিল একদিন। ভেতরে জালগুলো সারিবদ্ধ করে রাখা। আর এক দিকের দেয়ালে ঝুলানো নানান রকমের মাছ মারার সরঞ্জাম; এককাঁটা, তেকাঁটা, আঁকড়া, আর একটা কোঁচ। নইমুদ্দি সবগুলোর গায়ে আদর করে হাত বুলাতে বুলাতে বলে যাচ্ছিলো কীভাবে সেগুলো বানানো হয়েছে। বাঁশ কেটে তেল মালিশ করে করে পাকানো হাতলের মাথায় কামার বাড়ি গিয়ে নিজে বসে থেকে বানিয়ে এনেছে লোহার কাঁটাগুলো। কোঁচটার গায়ে হাত দিয়ে বলতো,
— জানোস সুজান, এই কোঁচ দিয়া মারতে জানলে কোন মাছের বাপেরও সাধ্য নাই পার পায়। দেখ এই শলাগুলান, মাথায় চোখা সুক্ষ্ণ ফলা। মোট আঠারোটা। বড় মাছ তো বটেই একখান পুটি মাছও গাঁইথা ফেলতে পারি।
হুড়াসাগর নদীর যখন বাড়বাড়ন্ত অবস্থা তখন চোত-বোশেখেও রয়নাপাড়ার কাছে বিরাট অংশ জুড়ে গভীর পানি জমে থাকতো। সবাই বলতো রয়নাপাড়ার দহ। নদীর সব মাছ যেন আগে থেকেই জেনেশুনে জমা হতো সেই দহে। ঘন শ্যাওলা জমে উঠত আর তার ফাঁকে ফাঁকে ভেসে উঠত বড় বড় মাছ। কাতলা, কালবাউশ, গজার মাছ। নইমুদ্দি মাথায় গামছা বেঁধে একহাতে কোঁচটা নিয়ে বলতো,
— সুজান নু যাই, রয়নাপাড়ার দও থেইকা মাছ মারমু। তুই খালুই ধরবি আর ভাগ পাবি।
সুজানের ভাগের দরকার নাই। নইমুদ্দির সঙ্গে মাছ মারতে পারার আনন্দেই সে খুশি। মাছের ভাগ পাওয়া তো বাড়তি পাওনা। কোঁচ হাতে নদীর ধারে ওত পেতে থাকতো নইমুদ্দি। ঠিক যেরকম মাছরাঙ্গা পাখি মাছের দিকে তাক করে থাকে। মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে বলতো,
— দ্যাখ সুজান, ঐ যে বড় মাছটা ছোট ছোট পোনা মাছের মদ্দে চ্যাগায়া আছে, ও কিন্তু কম কইরা অইলেও এক হাত পানির নিচে। কিন্তু দেখলে মনে অয় পানির দুই ইঞ্জি নিচে। এই মাপ হিসাবে নিয়া কোঁচ মারতে অয়। মাজেমদ্দে হাওয়ার গতিও আমলে নিতে অয়।
তারপর নিঃশ্বব্দে পাকা শিকারির মতো কোঁচটা ডান হাতে উঁচিয়ে ধরে সাৎ করে মেরে দিতো নইমুদ্দি। কোঁচের অন্য মাথায় শক্ত দড়ি বাঁধা, সেই দড়ি আবার ডান হাতের কব্জিতে আটকানো। সপাৎ শব্দে পানি কেটে গেঁথে ফেলতো মাছটাকে আর নইমুদ্দি হাতের দড়ি গোটাতে গোটাতে তীরে নিয়ে আসতো মাছটা। কোঁচের কাঁটাগুলো এমনভাবে গেঁথে যেতো আর মাছের তড়পানি দেখে ভয় হতো সুজানের না জানি কোঁচের শলাগুলো ভেঙ্গে যায়। কিন্তু নইমুদ্দির কোঁচ ভাঙতে পারে তেমন শক্তিশালী মাছ শুধু একবারই দেখেছিল সুজান। সেরকম বড় মাছ আজকাল আর কোথাও দেখতে পায় না।
এই কতো অল্পদিনেই গ্রামের চেহারা, দিনকাল বদলে যেতে দেখলো সুজান। মানুষ বাড়তে বাড়তে সংসারে ভাগ হয়ে নতুন ধানী জমিতে কেউ বাড়ি ঘর তোলে। এদিকে সরকার যমুনা নদী আর হুড়াসাগরের মাথায় স্লুইসগেট দিয়ে আটকে দিলো পানি আসা। বর্ষাকালে তাও একটু আধটু গেট খুলে দিলে নদিতে পানি আসে। অন্য সময়ে খড়খড়া শুকনা। আর আগের মতো বান আসে না। বর্ষাকালে শো শো শব্দে নদিতে স্রোত বয়ে যেতো। ভরা বর্ষায় সেই নদীর পানি উপচে হালট পার হয়ে মাঠে উঠে যেতো। ধান ক্ষেত, পাট ক্ষেত পানিতে টইটম্বুর আর শুরু হতো নানান রকমের মাছ ধরার উৎসব। চ্যাংড়া পোলাপন পর্যন্ত ছোট ছোট বাঁশের কঞ্চিতে কাপড় বেঁধে ঠেলা জালের মতো বানিয়ে নিতো। এখন সেই বানও নেই, মাছও ধরা হয় না। শোনা যায় ইন্ডিয়া নাকি বাংলাদেশের সব নদির মুখে জাল বসিয়ে দিয়েছে। তাই আগের মতো মাছ আর যমুনাতেও আসে না। মাছ ধরার এই মন্দা অবস্থা দেখে ততদিনে চালের ব্যাবসা শুরু করে দিয়েছে নইমুদ্দি। বিয়ে করে সংসার শুরু করেছে। আর ঘরে এসেছে ফুটফুটে একটা ছেলে, সিরাজ। নইমুদ্দি যেন মাছ ধরার সকল আনন্দ খুঁজে পাওয়া শুরু করে নিজের ছেলে সিরাজ আর সংসারের মধ্যে। নইমুদ্দি ছেলেকে কাঁধে নিয়ে এখনও মরা-নদীর-পেটের-মতো দেখতে একটা চওড়া জায়গায় জমে-থাকা পানিতে গোসল করাতে নিয়ে যায়। একটা খেলনা মতো ছোট ঠেলা জাল বানিয়ে দিয়েছে তা দিতে মাছ-ধরা খেলতে থাকে বাপ-ব্যাটা মিলে। নইমুদ্দি সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতো,
— আমার ছাওয়াল কিন্তু এহেবারে জাতের মাছ-ধরনেঅলা অইতো!
তারপরও নইমুদ্দির মাছ ধরা একেবারেই বন্ধ হয়ে গেলে দিনে দিনে অসুখী ভাব চলে আসে মনের মধ্যে। প্রতি বছর বর্ষার মওসুমে কী যেন হাতড়ে বেড়ায়, কী যেন নাই নাই হাহাকার বাজে বুকের মধ্যে। ঘরের ঝাঁকি জাল, খড়াজালে ধুলা জমে; এককাঁটা, তেকাঁটা, আঁকড়ায় জং ধরতে শুরু করেছে। সেগুলো আর ছুঁয়েও দেখে না নইমুদ্দি। মাঝে মাঝে কোঁচটা নামিয়ে গামছা দিয়ে মুছে মুছে রাখে, কাপড়ের ছেঁড়া টুকরায় একটু তেল দিয়ে মাখিয়ে আলতো করে প্রলেপ দেয়।
সেবার বর্ষাকালে যমুনায় পানি একেবারে উথলে উঠলো। পানি বাড়তে বাড়তে ওয়াপদা বাঁধের একেবারে মাথা ছুঁই ছুঁই অবস্থা। স্লুইসগেট খুলে দিয়েছে আর পানি আসছে হুড়াসাগড় নদিতে কিন্তু আগের মতো সেই স্রোত নাই। আর পানি নদীর কিনার পর্যন্ত তো দূরের কথা, যারা কিনার ঘেঁষে চর দখল করে বাড়ি বানিয়েছে তাঁদের ঘরবাড়ি ছুঁই ছুঁই করে কিনা সন্দেহ আছে। হাটখোলায় বসে বসে এনিয়েই আলোচনা করছিল সবাই। হাটখোলা থেকে ফেরার পথে উত্তর পাড়ার মোসলেম বলে,
–অই নু যাই, ইশকুলের মাঠে গিয়া বসি। একখান পরামর্শ আছে।
মোসলেম, নইমুদ্দি, সুজান আর আবুল ইশকুলের মাঠে গিয়ে বসে। মোসলেম কোন কথা না বাড়িয়ে বলে,
— ওয়াপদার বাঁধ ভাংমু। সুইসগেটের কাছে পানি বাঁধের গলা পন্ত আইছে। খালি একখান নালি কাইটা দিলেই কাম। বহুদিন বান নাই, মাঠে পলি অয় না, সার অয় না, মাছ মারা অয় না। আমরা খরায় মরি আর ওয়াপদার ঐ পাড়ের মানুষ ডুইবা মরে। বুছচোস? তোরা আছোস আমার হাতে?
–কিন্তুক এহন বাঁধ ভাঙলে মেলা মাইনষের বাড়িঘর নষ্ট অইবো না? কেউ ডুইবাও মইরতে পারে। সুজান শঙ্কার কথা জানায়।
— নদীর মদ্দে যারা বাড়ি বানাইছে হেই দুই একখান বাড়িঘরের ক্ষতি তো অইবোই। ঐ পাড়ে তো আরও ক্ষতি অইতাছে। চিন্তা কইরা দ্যাখ লোকসানের চাইতে লাভ বেশি। দুইদিকের মাইনষের উপকার।
বানের পানি আসার সম্ভাবনা, মাছ ধরার সম্ভাবনার কথা ভেবে নইমুদ্দির যে ইতস্ততভাব ছিল তা কাটতে থাকে। তারপরও প্রশ্ন করে,
— গেটের ঐ খানে তো পাহারাদার থাকে।
— তা থাকে। আমি চিনি তারে। তাঁরে অন্যদিকে আমি সামলামু। তোরা খালি কোদাল দিয়া বাঁধের বরাবর নালি কাটবি। একবার পানির ছোরত চলতে থাকলে বাকিটা পানি-ই কাইটা নিবো। আর আমরা ফেরার সময় দৌড়াইতে দৌড়াতে আগাম খবর দিয়া দিমু যে বাঁধ ভাঙতে শুরু কইরছে বাড়িঘর ছাড়ো।
সবাই রাজি এবং সেই রাতেই পরিকল্পণা মতো সবকিছু ঘটে গেল। ফুঁসলে ওঠা যমুনার পানি যেন অপেক্ষা করছিল প্রসব-উত্তর মায়ের স্তনের মতো। ওদের কেটে দেয়া সরু নালিতে পানির স্রোত যখন সদ্যজাত শিশুর টানের মতো চোষণ দিলো তখন একেবারে বাড়বাড়ন্ত জোয়ার। সকালের মধ্যেই ওয়াপদা বাঁধের বিশাল অংশ ভেঙ্গে হুড়াসাগরের বুকে সেই পুরনো দিনের মতো বন্যা এনে দিলো। সেই নদীর পানি হালট পার হয়ে মাঠে। কিছু দিনের মধ্যেই সেই পুরানো দিনের মতো বানের পানিতে সয়লাব হয়ে গেল নদী, মাঠ, হালট সবকিছু। নইমুদ্দি আগের মতোই মাছ ধরার আনন্দে একেকদিন একটা জাল নিয়ে বের হয়, কোনদিন পলো নিয়ে যায়, না হয় চাঁই ফেলে আসে ধারে কাছে। কিন্তু এতো আনন্দের মধ্যেও মাঝে মধ্যে মনে খচ করে কাঁটা বেঁধার মতো মনে পড়ে ওয়াপদার বাঁধ যেদিন ভাঙ্গা হলো সেদিন আগাম খবর দিতে দিতে নদীর চড়ে বসত-গড়া সক্কলেই জিনিসপত্তর নিয়ে পালাতে পারলেও মুন্সী বাড়ির বুড়া বাপ-মা পারে নাই। সেই স্রোতের টানে দুইজনেই মরে ভেসে উঠেছিল সেই ভাটির দিকে বাঁশবাড়িয়া গ্রামের কাছে। কেউ অবশ্য এখন পর্যন্ত সন্দেহ করে নাই যে ওয়াপদার বাঁধ আসলে এমনি এমনি ভাঙ্গে নাই, কেউ কেটে দিয়েছিল; কিম্বা বহুদিনের আকাঙ্খিত ঘটনাটি ঘটে যাওয়ায় কেউ আর উচ্চবাচ্য করে নাই। বরং মুন্সী বাড়ির টাকা-পয়সাঅলা বড় ছেলে নদীর চড়ে বাড়ি করেছিল বলে লোকেরা নানান কথা বলতো আড়ালে আবডালে, এখন সুযোগ পেয়ে খোঁচা দিতে পিছ পা হয় না,
— 'হালার মুন্সী লোভের চোটে খালি জিনিসপত্তর নিয়ে দৌড় দিছিল নিজের বাপ-মারে পিছনে ফেইলা। নইলে কি আর এমনে ভাইসা যায়?'
কিন্তু নইমুদ্দি জানে এই দুজন মানুষের মৃত্যুর জন্যে সে দায়ি, যারা যারা বাঁধ কেটে দিয়েছিল তারা সকলেই দায়ি।
প্রতি বছর পরিবেশ, প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নানান জাতের ধানের চাষ করে আসছে এই অঞ্চলের মানুষেরা। নদী যখন শুকনো হয়ে গেল তখন আশায় আশায় চোত-বোশেখে নিচু জমিতে গভীর পানির বোনা আমন আবাদ করেছে সবাই, এই আশায়, যদি নদীতে বান আসে! সোনাই বিলের নিচু জমিতে এখনও বাওইঝাক, বাঁশীরাজ ধানের বীজ বুনে দিতে হয়, বর্ষার পানি না হলেও বৃষ্টির পানিতে সেই ধান তড়তড়িয়ে বেড়ে ওঠে। যারা অল্প পানির কথা ভেবে রোপা আমনের জন্যে বসে ছিল তারা ঠকেছে। কিন্তু আফাজ সরকার আর তাঁর ছেলেপুলেরা পুরো সোনাই বিলে গভীর পানির আমন ধানের বীজ বুনেছিল। বর্ষার জলে সোনাই বিল এখন দেখার মতোন হয়ে আছে। জলে টইটম্বুর বিলের বুক উঁচিয়ে সবুজ ধানের যৌবন বাতাসে ওড়নার মতো উড়তে উড়তে মাথা আলুথালু করে দেয়। নইমুদ্দি পানি একটু কমে আসার আশায় আশায় দিন গুনতে থাকে। বানের পানিতে একটা টান ধরলেই বড় বড় মাছগুলো এই সোনাই বিলের দিকে ছুটে আসবে। আমন ধানের ফাঁকে ফাঁকে পোনা ছাড়বে বিশাল আকারের গজার মাছ। এখন শুধু একদিন বৃষ্টির জন্যে অপেক্ষা। নইমুদ্দি ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকাটা ঠিক করে নিয়েছে এর মধ্যেই। বৃষ্টির দিনক্ষণ দেখে দেয়ালে ঝুলানো কোঁচটা নামিয়ে আনে। পরিষ্কার করে যত্ন নিয়ে। মাথায় মাথালটা ভাল করে লাগিয়ে নেয় যাতে নড়াচড়ায় পড়ে না যায়। বাড়ির কাছে হালটে নৌকা বাঁধা। মাছ ধরতে যাওয়ার রওনার মুখে ছেলে সিরাজ আবদার করে ,
— বাজান, আমিও যামু মাছ মারতে।
— না না, বৃষ্টির মদ্দে শর্দি-গর্মি লাইগা যাইব বাবা।
— না, আমি যামু;
বলেই কান্না শুরু করে সিরাজ। ছেলের এই মাছধরার প্রতি আগ্রহ দেখে বরং খুশিই হয় নইমুদ্দি। নিজেই পলিথিনের ব্যাগ কেটে মাথায় ঢাকনাওলা জামা বানিয়ে দেয়; বলে,
— দ্যাখছো, আমার সিরাজ রে এক্কেবারে বিদেশি সাহেবগোর মতন লাগতাছে। কী মাছ মারার নেশা!
বলেই ছেলের গর্বে বুক ফুলিয়ে ছেলেকে নিয়ে নৌকায় ওঠে নইমুদ্দি। সোনাই বিলের কাছাকাছি যখন নৌকা নিয়ে চলে এলো, তখন বৃষ্টি একটু ধরে এসেছে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি কিন্তু আকাশ একদম মেঘে ঢাকা। বিলের দিকে আমন ধান পানি থেকে এক-দেড় হাত ওপরে উঠে এসে বাতাসে হেলানি-দুলানি খায়। বৃষ্টির ফোঁটা জমে আছে ধানের পাতায় যৌবনবতী স্ত্রীর নাকের ডগায় জমে-থাকা ঘামের মতো। নইমুদ্দি আস্তে আস্তে নৌকা সামনে আগাতে থাকে বিলের ঠিক মাঝ বরাবর লক্ষ্য করে। একবার পেছনে তাকিয়ে দেখে ছেলেটা ঠিক আছে কি না। পেছনের দিকে গলুইয়ের কাছাকাছি বসিয়ে দিয়েছে যাতে সামনে গলুইয়ে দাঁড়িয়ে মাছ লক্ষ্য করে আগাতে থাকলে নৌকাটা সামনের দিকে বেশি দেবে না যায়। ছেলের ওজন সামান্য হলেও একটা ভার তো দিচ্ছে। পই পই করে ছেলেকে বলেছে নইমুদ্দি 'বাজান, শক্ত কইরা ধইরা থাকবি নাওয়ের পাটাতন।'
শ্যেন চোখে পানিতে খেয়াল রাখতে রাখতে আগাতে থাকে নইমুদ্দি। ধান গাছের গুচ্ছের ফাঁকে ফাঁকে চোখ রাখে পোনামাঝের ঝাঁকের উদ্দেশ্যে। যেখানে পোনা মাছের ঝাঁক তার আড়ালেই থাকবে বড় মাছ। এক দঙ্গল পোনা মাছ দুটো ধানের গুচ্ছের ফাঁকে উঁকি দিয়েই সুড়ৎ করে ডুব দেয় আর পোনাগুলোর ফাঁকে দেখতে পায় বিরাট আকারের গজারের মাথা। গ্রামের অনেক মানুষ গজার মাছ খেতে চায় না কিন্তু নইমুদ্দি বলে মাছ তো মাছই, গজারও যা চিতলও তা তার কাছে। নইমুদ্দি লগি রেখে কোঁচটা হাতে নেয়। কোঁচের অন্য মাথা দিয়েই একটু করে ঠেলে ঠেলে নৌকাটা জায়গা মতো নিয়ে আসে। কিন্তু এ বড় শেয়ানা মাছ; তাকে আজ খেলিয়ে ছাড়বে। নৌকা ঘুরিয়ে এক মাথায় তাক করলেই অন্যদিকে সুড়ৎ করে ডুব দিয়ে পালিয়ে যায়। কয়েকবার তাক করেও ঠিক মোক্ষম সময় হাত ছাড়া হয়ে যায়। নইমুদ্দি জানে ধৈর্য্য হারালে চলবে না। কিন্তু হতে হবে ক্ষিপ্রগতি আর নির্ভুল নিশানা। বৃষ্টি আবার বাড়তে শুরু করেছে। খুব জোড়ে বৃষ্টি নামলে আর মাছটা মারা সহজ হবে না। এবার ঠিক করে একদিক থেকে সড়াৎ করে সরলেই নিজেও দ্রুত গতিতে নৌকা ঘুরিয়ে তাক করবে। মাছটা এবার পোনাগুলোর মাঝখান দিয়ে উঁকি দেয়। নইমুদ্দি যেই ভাবে এইবার কোঁচের নিশানা ঠিক করবে ঠিক তখনি পোনাসহ মাছটাও ঘাই দিয়ে অন্যদিকে সরে যায় অনেকটা নৌকার তলা দিয়ে। নইমুদ্দি কোঁচের লাঠি দিয়ে দ্রুত গতিতে নৌকা একেবারে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে আনে আর দেখতে পায় মাছের পোনাগুলো এলোমেলো ছুটছে, কিন্তু বড় একটা ধানের গুচ্ছের কাছে বড় আকারের নড়াচড়া লক্ষ্য করে। অনেক সময় ধানের গুচ্ছের ডাঁটে আটকে যায় বড় মাছ। সেই ডাঁটের জট ছাড়াতে ফাল পাড়ে। নইমুদ্দি নিশানা ঠিক করে নেয়; এটাই মোক্ষম সুযোগ। যে বড় আঠারো ফলার কোঁচ তাতে ধানের গুচ্ছের মাঝামাঝে মারতে পারলেই কেল্লা ফতে। নইমুদ্দি ধানের গুচ্ছের মাঝামাঝিতে তার নির্ভুল নিশানা ঠিক রাখে। বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া মুখায়বে একটা নিঃশব্দ ঝাঁকি দিয়ে কেতাবি ঢঙে কোঁচ ছুঁড়ে দিয়ে টের পায় ঠিক লক্ষ্যভেদ হয়েছে। মাছের মাংসে ফলা ঢুকে যাওয়ার শব্দ আর একধরনের কম্পন অনুভব করে। ধানের গুচ্ছের পাশে পানি লাল হয়ে ওঠে। ডান হাতের কব্জিতে বাঁধা দড়ি টেনে কোঁচটাকে উপড়ে ওঠাতে থাকে মইনুদ্দি। নিজের হাতের মাংসপেশিতে ভার টের পায়। কোঁচের ফলা উঠে আসছে পানি থেকে। মাথার মাথালটা চট করে পেছনে সরিয়ে নিতেই স্পষ্ট দেখতে পায় কোঁচের অংশ উঠে আসছে পানি থেকে। আর বৃষ্টির কম্পনে ঈষৎ ঘোলাটে পানির অবয়বে কোঁচের ফলাগুলো পুরোপুরি উঠে আসতেই নইমুদ্দির মাথায় যেন বাজ পড়ে; এক ঝলকে ঘাড় ঘুরিয়ে নৌকার অন্যদিকে তাকিয়ে দেখে সেখানে সিরাজ নেই। মুহুর্তেই বুঝতে পারে কী সর্বনাশ হয়ে গেছে তার। দ্রুত গতিতে নৌকা ঘুরাতে গিয়ে পেছন থেকে ছেলেটা পড়ে গেছে পানিতে ঠিক ঐ ধানের গুচ্ছের ভেতরে। একেবারে উল্টোদিকে নৌকা ঘুরিয়ে পানিতে পড়ে-যাওয়া ছেলের তড়পানিকেই মাছের নড়াচড়া ভেবেছিল সে। নইমুদ্দি তড়িৎ গতিতে কোঁচ তুলে আনে নৌকার ওপরে আর জাপটে ধরে ছেলের দেহ। নইমুদ্দি জানে এই কোঁচে বিদ্ধ হয়ে বাঁচা কারো পক্ষেই সম্ভব না। রক্তে একাকার হয়ে যায় নৌকা আর আশেপাশের জলরাশি। নইমুদ্দির বৃষ্টিতে ভিজে পানসে ঠোঁট কেঁপে ওঠে, ফিসফিসিয়ে শুধু বলতে পারে-
— 'হায় আল্লাহ, এ আমি কী কইরলাম?!
সেই থেকে নইমুদ্দি পাগল। প্রথম দিকে একেবারেই উন্মাদের মতো আচরণ করতো নইমুদ্দি। নইমুদ্দির এই পাগলের অবস্থা দেখে পুলিশ টুলিশের কাছেও কেউ যায় নাই আর। সুজান আর পাড়ার সকলে মিলে গঞ্জে নিয়ে ডাক্তার দেখায়; পাবনায় হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা করায়। নইমুদ্দির শ্বশুর বাড়ির লোকজন পাগলের হাত থেকে বাঁচাতে বউটাকে জোর করে নিয়ে অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়ে দেয়াতে নইমুদ্দি আরও একা হয়ে পড়ে। নানান ওষুধপত্রে এখন তাও একটু স্বাভাবিক মানুষের মতো কিছুক্ষণ থাকতে পারে। কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে মাথা ব্যথা হয়, চিন্তা এলোমেলো হয়ে যায়। তবু নইমুদ্দিরে কেউ পাগল বললে সুজানের খারাপ লাগে। সুজান নইমুদ্দির সেই টিনের চালঅলা ঘরে গিয়ে দেখেছে কোঁচটাকে আবার যত্নে ঝুলিয়ে রেখেছে নইমুদ্দি। সুজান একবার বলেছিল,
— 'কী দরকার নইমুদ্দি ভাই কোঁচটারে রাখার? ফালায়া দেও। খালি খালি পুরান কতা মনে পইড়া যায় দেখলে।
নইমুদ্দি ভাবলেশহীন চোখে সুজানের দিকে তাকিয়ে বলেছিল,
— 'নাহ, আরাকখান শিকার করমু। জীবনের শ্যাষ শিকার।"।
একদিন নইমুদ্দি জীবনের শেষ শিকার টি করলো; নিজে মাটিতে শীতল পাটি বিছিয়ে সেই মাছ ধরার সরঞ্জামের ঘরে শুয়ে পড়েছিল চিৎ হয়ে। মাথার ওপরে কাঠের আড়া-পাইরের ওপর দিয়ে কোঁচের দড়ি পার করে এনে একহাতে টেনে ধরে কোঁচটাকে উপড়ে তুলেছিল যতটুকু পারা যায়। তারপর নির্ভুল নিশানায় কোঁচের ফলাগুলো নিজের দিকে তাক করিয়ে হঠাৎ ছেড়ে দিয়েছিল হাতের দড়ি। নইমুদ্দির নিশানা কখনো ভুল হতো না। এবারেও হয়নি। কোঁচের ফলা গলার নরম মাংশ, আর বুকের হাড়ের মাঝখান দিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করে বেরিয়ে গিয়েছিল। জীবনের শেষ শিকারেও নিপুণ করিগরের মতো কোঁচ চালিয়েছিল নইমুদ্দি।
নইমুদ্দি আর নেই। সুজান শুধু হাটখোলার চায়ের দোকানে বসে বসে খদ্দেরদের চা বিস্কুট এগিয়ে দিতে দিতে ভাবে এই মনে হয় নইমুদ্দি ভাই এসে বসবে বেঞ্চিতে আর বলবে,
"হায়রে, এই যে এত্তো মানুষ আটের মদ্দে আউলাইয়া গেলো, এগো গোছাইবো কেডো রে ?"