শখের অবরোধবাসিনী ও নিরোর বাঁশি

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 28 March 2015, 06:03 PM
Updated : 28 March 2015, 06:03 PM

জ্ঞানের কথা: রাজনীতি (Politics) হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কিছু ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত কোন গোষ্ঠী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। রাজনীতি বলতে সাধারণত নাগরিক সরকারের রাজনীতিকেই বোঝানো হয়, তবে অন্যান্য অনেক সামাজিক প্রতিষ্ঠান, যেমন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যেখান মানুষের মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্ক বিদ্যমান, সেখানে রাজনীতি চর্চা করা হয়। অন্যদিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান হচ্ছে শিক্ষার এমন একটি শাখা যা রাজনৈতিক আচরণ শেখায় এবং ক্ষমতা গ্রহণ ও ব্যবহারের উপায় সম্পর্কে আলোচনা করে।
বিজ্ঞানের কথা : কিন্তু আমাদের কালে, যে ভূমিতে সত্যিকারের রাজনীতি চর্চা করার দরকার হয় না অথবা রাজনীতির পাঠগ্রহণ বিষয়ে চিন্তা না করেও শুধুমাত্র বাবা বা স্বামীর চেতনার উপজীব্যতায় বিশালকায় রাজনীতিবিদ হয়ে উঠা যায়, সেখানে আসলে রাজনীতির সংজ্ঞাটা কেমন করে বেমালুম বদলে যেতে পারে এটাই হতে পারে আমাদের আজকের কথকতার মূল প্রয়াস।

মেয়েরা কী আর অবরোধবাসিনী নয়?
জ্ঞানের কথা : নারী জাগরণের অগ্রদূত মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়ার জন্মভূমি রংপুরের পায়রাবন্দের মেয়েরা তথা বাংলার মেয়েরা আর অবরোধবাসিনী নয়। অশিক্ষা, কুশিক্ষা, বাল্য বিবাহ ও ফতোয়াবাজির হাত থেকে এখানকার নারীরা এখন নিরাপদে রয়েছেন। রোকেয়ার আলোতে আলোকিত হচ্ছেন তারা। বর্তমানে এতদাঞ্চলের মেয়েরা নিজেদের অধিকার এবং তাদের ভোটাধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়েছেন। এখানকার বাবা মা তাদের মেয়েদেরকে শিক্ষার জন্য নিয়মিত স্কুল কলেজে পাঠাচ্ছেন। কাজেই নির্দ্বিধায় বলা যাচ্ছে আমাদের মা বোনেরা এখন আর অবরোধবাসিনী নয়।

বিজ্ঞানের কথা: তবে বেগম রোকেয়ার এই নারীমুক্তি দর্শনের সম্পূর্ণ আওতামুক্ত ঢাকার কূটনৈতিক জোনে অবস্থিত বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়। এ বছরের ৫ জানুয়ারী গণতন্ত্র হত্যা বা গণতন্ত্র রক্ষা দিবসের প্রাক্কালে গেল ০৩ জানুয়ারী থেকে প্রথমতঃ সরকারী বালুর ট্রাক, জলকামান বা বন্দুকওয়ালাদের চাপে এবং দ্বিতীয়তঃ নিজস্ব লাভালাভের হিসেবি অংকে সেই মহামহিম কার্যালয়ে শখের অবরোধবাসিনী হয়ে আছেন ২০টা দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। এই অবরোধের এতোই মহিমা যে, আদরের পুত্র প্রয়ানের শোক উদযাপনও ঐ অবরুদ্ধ গহবরেই করতে হয়েছে। শেষবারের মতো নিজের বাড়ির স্পর্শ পাওয়ার অধিকারও রাখেননি খালেদার অকাল প্রয়াত প্রিয় পুত্র কোকো।

পুত্রের শোকবিহ্বলতা একদম কাটিয়ে উঠবার পর সেই বিশেষায়িত গৃহে স্বেচ্ছা অবরোধবাসিনী খালেদা জিয়া বিবৃতিও দিয়েছেন, কোকোর জানাজায় লাখ লাখ মানুষ শরিক হয়ে জিয়া পরিবারের প্রতি অপরিমেয় ও ঐতিহাসিক ভালোবাসা দেখিয়েছেন, তাই তিনি শোক কাটিয়ে উঠার শক্তি সঞ্চয় করে আমৃত্যু দেশবাসীর পাশে থাকবার গভীর অনুপ্রেরণা পেয়েছেন…! আর সেই ইস্পাত দৃঢ় বা নির্মম প্রেরণাতেই অনন্তকাল মনুষ্য পোড়ানো অবরোধ ও হরতাল চলমান থাকবে…! যেমনটা খালেদা জিয়ার ডেপুটি গর্তজীবি রুহুল কবির রিজভীও মাঝে মাঝে গহবর থেকে লাদেন স্টাইলে উঁকি দিয়ে জানান দেন, গুলশানবাসিনী হুজুরনীর কথা ঠিক ঠিক। মানুষের ভাতের অধিকার নিশ্চিত করতে অবরোধের ভিতর হরতাল যথার্থ ঠিক। এখনকার বাঙালি বড়ই ভাতের কাঙ্গাল।

সুকোমল নারীর এমন অতি অদ্ভূত অবরোধবাসের খবরে বেগম রোকেয়া আক্কেল গুড়ুম হতেন কীনা জানা নাই, তবে বিরুদ্ধবাদী দুর্মুখোরা এ নিয়ে কত কথাই বলে। যেখান থেকে ভাইবার, ট্যাংগো বা লাইনের মাধ্যমে জঙ্গি হামলা, সন্ত্রাসী হামলা বা পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়, দেশে জ্বালাও পোড়াও করে অস্থিরতা সৃষ্টির আদেশ দেয়া হয় সেই রাজনৈতিক কার্যালয় কূটনৈতিক জোনে রাখা বিপজ্জনক। ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ণ ইউনিটের উপচে পড়া করুণ আহাজারী বা বিষাদ বিভীষিকার পোড়া ঘ্রাণ থেকে মুক্তির ঐ একটাই উপায়, 'সকলই বন্ধ করিতে হইবে'। দেশ যখন আগুনে অঙ্গার, মানুষ যখন পুড়ে পুড়ে কয়লা, আকাশে বাতাসে নীরব কিন্নর ক্রন্দন, গুলশান কার্যালয়ে এসময় এহেন খ্যাতিমান অবরোধবাসিনীর স্বেচ্ছা বন্দিত্বের মাজেজাটা আসলে কী?

নীরো কি এখনও বাঁশি বাঁজিয়ে চলেছেন?
জ্ঞানের কথা: রোম যখন পুড়ছিল সম্রাট নীরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন, এমন একটা কথা বেশ প্রচলিত। সেসময় গুজব ছড়িয়ে যায় যে, সম্রাট নীরো পেলেটাইনের চূড়ায় বসে আগুন লাগানোর নির্দেশ দেন এবং তার আশপাশ যখন আগুন দাউ দাউ করে গোটা নগর গ্রাস করেছিল তখন তিনি বাঁশিতে 'স্যাক অব ইলিয়াম'-এর সুর তুলছিলেন। ইতিহাসে এ নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে বেশ তর্ক বিতর্ক আছে। নীরোর ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সেকালে রোমে আগুন যে লেগেছিল তাতে কোন সন্দেহ ছিল না। ইতিহাসবিদ টাসিটাসের মতে, নীরো সে সময় 'এনটিয়ামে' ছিলেন এবং বাঁশি যে বাজাচ্ছিলেন তা কেবল গুজব। টাসিটাসের মতে, এই ঘটনার পর নীরো কোন নিরাপত্তা প্রহরী ছাড়াই দৌড়ে যান ঘটনাস্থলে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যে লেগে পড়েন। তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের তার প্রাসাদে আশ্রয়ও দেন। এর পর তিনি নতুন 'আরবান প্ল্যান' তৈরি করেন এবং ভগ্নস্তূপের ওপর গড়ে তুলেন নতুন আধুনিক রোম নগর।

বিজ্ঞানের কথা: আমাদের এখানে একালের বাংলাদেশেও গণতন্ত্র ধ্বংস বা রক্ষার নামে আগুন জ্বলছে। ভগ্নস্তুপে পরিণত হচ্ছে মানুষের প্রাণ। হৃদয়বিদারক ঘটন বা অঘটনের ছড়াছড়ি দেশব্যাপী। হাহাকার আর ক্রন্দন বেশুমার চলছে। মহান সংসদে দাঁড়িয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পাক হানাদার বা তাদের দোসরদের নির্মমতাকেও হার মানিয়েছে এসময়ের রাজনৈতিক ম্যাসাকার। ২০টা দলপন্থী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এমাজউদ্দিন আহমদও যেমনটা বলেছেন, একাত্তরের পর এতোবড় ঝুট ঝামেলায় আর কখনও পরেনি এ বাংলা রাষ্ট্র। তাই যদি হয়, রেকর্ড নির্মমতা বা বর্বরতা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের নীরোরুপী সম্রাটরা আসলে করছেনটা কী? যে সম্রাটের সুদক্ষ র্যাব, পুলিশ, বিজিবি, আর্মি বা দলবাজ ক্যাডার আছে, সেই সম্রাটের ম্যাসাকার বন্ধ করবার যোগ্যতা থাকতে নেই কেন? তবে কী আমাদের সম্রাটরাও বাঁশিতে 'স্যাক অব ইলিয়াম' বাঁজিয়ে চলেছেন, ধ্বংসস্তুপের ওপর আধুনিক বাংলাদেশ গড়বেন বলে! আহা! আমাদের কালের সদাশয় সম্রাটরা এতোটা হৃদয়হীন হতেই পারেন না। প্রতিদিন এ গ্রহের শ্রেষ্ঠ জীব মনুষ্য পোড়ার খবরে তাদেরও নিশ্চয় নয়নজলে বানভাসি ঘটে। হু হু ক্রন্দনে ভেসে গিয়ে হা হুতাশ করেন তারাও। যাই বলেন আমাদের সম্রাটরা বেজায় ধৈর্যশীল ও স্থির চিত্তের। একদম রোমের নীরোর মতো নন।

এই যে, দেখুন না দহনের কালেও কী সুন্দর সকাল সকাল শান্তিনিকেতনিয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে শুনতে প্রিয় গায়কের জন্মদিনে সরাসরি টেলিভিশনে ফোনোকল করে উইশ করতে পারেন। ক্রিকেটাররা বিশ্বকাপ এনে আমাদের গর্বিত করতে বিদেশ বিঁভূয়ে যাচ্ছেন, তাই তাদের সম্মানে জাঁকজমক ডিনার পার্টিও দিতে পারেন আমাদের সম্রাটরা।
একে আর যাই বলেন, নীরোর বাঁশি বাজানোর সাথে মেলাতে যাবেন না আশা করছি।

হারায়ে গেছে সত্য ও সুন্দর
জ্ঞান ও বিজ্ঞানের কথা: আমাদের এই বাঙলা ভূমের অধরা গণতন্ত্র স্বেচ্ছা অবরোধে আর নীরোর বাঁশিতে লেপ্টালেপ্টি করে এগিয়ে চলছে। এক গোলাপী গণতন্ত্রীকে ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখেন। আর এক গোপালী (গোলাপীর ভাষায়) গণতন্ত্রীকে আবার সেই গোলাপীকে আহ্লাদ করতে গিয়ে বন্ধ লৌহ দ্বারের অসৌজন্য নিয়ে পিছুটান দিতে হয়। কে বাঁচাবে আমাদের? কে আছে আমাদের ত্রাণকর্তা? কেউ নেই কোনোখানে। তাই রাজনীতির আগুনে পুড়ে মরবারও শেষ নেই আমাদের। আমাদের বাঙালি জীবনে সত্য ও সুন্দর বলে আর কিছু নেই…!

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই কথাটিই যে আরও সুন্দর করে বলেছিলেন,
দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি,
সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি!

ফারদিন ফেরদৌসঃ লেখক ও সাংবাদিক
৩০ জানুয়ারি ২০১৫
www.facebook.com/fardeen.ferdous