বিবৃতি আন্দোলনের সাফল্য নিয়ে ঘরে ফিরলেন খালেদা

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 18 April 2015, 06:05 PM
Updated : 18 April 2015, 06:05 PM

বিবৃতি+আন্দোলন=বিবৃতান্দোলন

আন্দোলনের প্রতিশব্দ বা সমার্থক শব্দ হিসেবে বঙ্গভাষায় ঝাঁকুনি, ধাক্কা, শিহরণ, শিরশিরানি, সংক্ষোভ, থরথরানি, নর্তনকুর্দন, লম্ফঝম্ফ, হুটোপুটি, পতপতানি, ধুকপুকানি, উত্তেজনা, গোলমাল, টালমাটাল, খুনখারাবি, ঝটফটানি, মাতামাতি, হৈ চৈ, তুলকালাম, বিপ্লব, টগবগানি, বলক, ভূমিকম্প ইত্যাদি শব্দবন্ধ বহুল ব্যবহৃত।
এছাড়া, উথলে উঠা, ঘোঁট পাকানো বা জল ঘোলা করা জাতীয় শব্দমালাও কারো কারো মনপছন্দ।
আন্দোলনে জিতে গেলে মহানন্দে ঝড়তুফানের মতো মাতামাতি বা গড়াগড়ি খেয়ে ঘামরক্ত টগবগ করে ফোটানো হয়। অন্যদিকে সর্বোচ্চ আন্দোলনের নামে অন্তর্ঘাতে, বিধ্বংসে, বিপ্লবে, সন্ত্রাসে, চরমপন্থায় বা প্রতিহিংসার দাবানলে ব্যর্থ হলে উদ্বেল উৎকণ্ঠা, চাঞ্চল্যে আর অস্থিরতায় নাকের জলে চোখের জলে টলটলায়মান কে না হোন!
উপরোল্লেখিত কথামালা বা শব্দ উদ্ধৃতি যুগে যুগে অধিকার বা দাবি আদায়ের আন্দোলনেরই প্রচলিত ব্যাকরণ। তবে আমাদের বঙ্গবাসীরা ওসবের ধার ধেরে আন্দোলন টান্দোলনে মাথা ঘামান না।
আমাদের আন্দোলনের দুইটি মাত্র মোক্ষম অস্ত্রঃ একপক্ষে চিত্তবৃত্তিহীন বেহায়া স্বেচ্ছা গুহাবাস বা নির্বাসন, প্রতিপক্ষে লাগাতার লজ্জাহীন ভর্ৎসনা বা তিরষ্কার। আনুষাঙ্গিক বিষয় হিসেবে আটেপক্ষে কান ভাঙ্গানো, কুশপুত্তলিকা দাহ, তুলারাম খেলারাম, সালিশি দেনদরবারের চলও দেখা যায়।
আমাদের আন্দোলনে নিরাশা, উদ্বেগ, কাপুরুষতা, ভীতি, হঠকারিতা, কুরুচি, আড়ম্বর, কলঙ্ক, দম্ভ, ধৃষ্টতা বা ঘৃণা অনিবার্যভাবে বিদ্যমান থাকবে। কিন্তু সাহস, সৌন্দর্য, গর্ব, বিনয়, নম্রতা, খ্যাতি, সহিষ্ণুতা, বন্ধুতা, প্রেম জাতীয় বিষয়াবলীর কানাকড়িও দেখা মিলবে না।
পুরাণে আছে বীরের ধর্ম যুদ্ধ করা। জয় পরাজয় নির্ধারণ করার মালিক নিয়তি দেবী। এমন পৌরাণিক ধর্ম মেনেই আমাদের দেশের আপসহীন নেত্রী ও বীরাঙ্গনা বেগম খালেদা জিয়া গেল তিনমাস ধরে ৮৬ নাম্বার গুলশানে স্বেচ্ছা নির্বাসনে গৃহবন্দী থেকে বিবৃতি আন্দোলন করে গেছেন। এসময়কালে তিনি বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে পারেননি। এমনকি ২১ ফেব্রুয়ারি কিংবা ২৬ মার্চে ভাষা ও স্বাধীনতা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা পর্যন্ত জানাতে পারেননি। পুত্রশোকাতুর অশ্রুসজল মা পারেননি বনানীতে আরাফাত রহমানের কবর পর্যন্ত ছুটে যেতে। শেষ পর্যন্ত পুরাণের নিয়তি দেবীর বদ নজরে পড়ে দেশের মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার আদায় ছাড়াই ৭৯ নাম্বার গুলশানের ফিরোজা ভবনের নিজ বাসায় ফিরে গেলেন এরশাদ আমলের আপসহীন নেত্রী। তবে গুহাবাসকালে তাঁর নেতাদের বিবৃতি হরতাল বা অবরোধের ফাঁদে পড়ে শতাধিক আমজনতা প্রাণ হারিয়েছেন, কয়েকশ শ্রমজীবি মানুষ দগ্ধ হয়ে বার্ণ ইউনিটে শুয়ে কাতরাচ্ছেন, পুড়ে গেছে কয়েক হাজার কলের যানবাহন। এসব যদি নেত্রীর আন্দোলনের অর্জন বলেন, বলতেই পারেন। আন্দোলনকে ভুল বুঝে একে আবার বেহায়াপনা বা আপসহীনতা বলতে যাবেন না যেন।
সরকার পক্ষ চেয়েই ছিল, ছলে বলে কলে কৌশলে খালেদা জিয়ার আন্দোলন নামক সাপকে ঝাপিসুদ্ধ বঙ্গোপসাগরে ছুড়ে ফেলে দিতে। কে হায় পায়ে ঠেলতে বা ধুলায় লুটাতে চায় নিজেদের এমন মধুর শাহী মসনদ।
আপেক্ষিকতার সুত্র মেনে আপাতঃ সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার এমন কারুণ্যপূর্ণ পরাজয়ে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণের আওয়ামীলীগ নেতাদের নিয়ে গণভবনে পার্টিও দিয়েছেন। সেসময় প্রধানমন্ত্রী নেতাদের উদ্দেশ্যে সোৎসাহে বলেছেন, বিএনপি নেত্রী অঙ্গীকার করেছিলেন, সরকারের পতন না ঘটিয়ে তিনি ঘরে ফিরে যাবেন না। কিন্তু সরকার উৎখাত করে গলায় ফুলের মালা নিয়ে ঘরে ফিরে যাওয়া তাঁর ভাগ্যে জোটেনি। বরং আদালত থেকে জামিনের পর ব্যর্থতা ও পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে তিনি ঘরে ফিরে গেছেন।
এ ব্যাপারে আওয়ামীলীগে যারা সজ্জন, কথা কম বলা বা কাজের মানুষ হিসেবে পরিচিত সেসব নেতাদের প্রশ্ন প্রধানমন্ত্রী্র কাছে, নেত্রী এটা কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা হয়ে গেল নাতো।
বিস্ময়ে প্রধানমন্ত্রীর উত্তর,
কী বলছেন, প্রতিপক্ষকে ভর্ৎসনা বা তিরষ্কার না করতে পারলে কীসের রাজনীতি আপনাদের। এদেশের রাজনীতিতে সৌন্দর্য বা বন্ধুতা বলে কোনো শব্দ থাকতে নেই। প্রতিপক্ষ আমাদেরকে দুর্বল ভাবুক, এই সুযোগ তাদেরকে দিতে চান?
তোয়াজতন্ত্রের সুত্র মেনে নেতারা পিন পতন নীরব হয়ে গেলেন। খানিকটা লজ্জা কি পেলেন? বুঝা গেল না।
অন্যদিকে বিএনপি নেত্রী সেলিমা রহমান, শিরিন সুলতানা, শিমুল বিশ্বাস বা মারুফ কামাল যারা খেয়ে না খেয়ে তিনমাসের গুহাবাসে ম্যাডামের সঙ্গী সাথী ছিলেন, ম্যাডামের প্রতি সেই নেতাদের বিনীত প্রশ্ন, তিনমাসের আন্দোলনের ফলাফলটা আসলে কী?
বিষন্ন বিধ্বস্ত ম্যাডাম কথা বলতে চাইছিলেন না। কিন্তু সহকর্মীদের মনোবল যে তার ওপরই বিরাটভাবে দন্ডায়মান। তাই অস্ফুটে মুখ খুললেন তিনি।
দেখো, আমার দাদি বলতেন, জাইনা কাম করতে পারলেতো রাজাই হওন যাইত। আমিতো ভেবেছিলাম, ব্যাপক জনসমর্থন পেয়েছি। কিন্তু সমর্থক জনতা বা আমার দলবাজদের সাহস যে, এখনকার সরকারের আধুনিক মারণাস্ত্র ও আরক্ষা বাহিনীর চাপের মুখে কাপুরুষ ও ভীরুতায় পর্যবসিত হবে তা কি আমি জানতাম?
হায়! আমার পুত্রশোক, আমার নির্ঘুম রাত পার, আমার পায়ে ঠেলা হোম সিকনেস, আমার নিজ গৃহের নিশ্চিন্ত আরাম আয়েশ, আমার নেতাদের দমন পীড়ন, মামলায় নির্যাতিত আমার দল অন্তপ্রাণ স্বজন বঞ্চিত পলাতক কর্মীদের ত্যাগের বিনিময়ে আমি কিছুই পাইনি এমন কথা রাজনীতির এবিসি জ্ঞানওয়ালারাও বলতে পারবে না।
জনতার মনোভাব না বুঝে, কেবলমাত্র গুহাবাস বিবৃতিতে হরতাল অবরোধে অধিকার আদায়ের আন্দোলন সফল হয় না, হবেও না। ভবিষ্যত অধিকার সচেতন রাজনীতিবিদের জন্য এটা আমার চরমতম শিক্ষা। এদেশের এতোদিনকার রাজনৈতিক আন্দোলনের শেষ ও মোক্ষম অস্ত্র হরতাল, অবরোধ বা নাশকতাকে চিরতরে ভোঁতা করে দিয়েছি। প্রকৃত জনসমর্থনকেই আমি আন্দোলনের সারথি মেনেছি। এটা কোনোমতেই আমার নিস্ফল প্রস্থান নয়, বরং বোধের প্রশ্নে কঠোর আপসহীনতা।
ফারদিন ফেরদৌসঃ লেখক ও সাংবাদিক
০৫ এপ্রিল ২০১৫
facebook/fardeen.ferdous
twitter/fardeenferdous