ভূতের রাজ্যে কানুনেরা নির্বাসনে

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 21 April 2015, 03:41 AM
Updated : 21 April 2015, 03:41 AM


ভূতের রাজার উতল দেশে
উল্টো পথের পথিকেরা চলছে বীরের বেশে
সবখানে কী গাছাড়া ভাব
সবাই ভাবে নিজেই নবাব
কানুনেরা ডুবি ডুবি যাচ্ছে জলে ভেসে…
বেজায় মজা দিনগুলি পাড় খিলখিলিয়ে হেসে…
আহা! খিলখিলিয়ে হেসে…

ভূত রাজ্যের ভূলিশ বাহিনীর ভিএমপি মুখপাত্র খানিক আগে অফিস থেকে বাসায়
ফিরেছেন। ফ্রেশ হয়েই ভূত এফএম এর গানে মনোনিবেশের প্রচেষ্টা। সারাদিন ধরে
ভিডিও ফুটেজ এ্যানালিসিসের ধকলতো কম না। তারপরও ভূত রেডিও চ্যানেলের গান
শুনলে সত্যি মেজাজ ফুরফুরে হয়ে যায়। খিলখিলিয়ে হাসতে ইচ্ছে করে।
নক নক নক।
দরজায় শব্দ।
এই প্রায় সন্ধ্যেবেলা তুই?
মামা, তোমার জন্য একটা পাওয়ারফুল চশমা নিয়ে এসেছি। তোমায় উপহার দেব বলে।
এক নি:শ্বাসে বলে গেল ভিএমপি কমিশনারের কন্যার অধিক একমাত্র ভাগ্নী ভূকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী দ্রোহা। যে বিশ্ববদ্যালয়ের ভ্রক্টর আমজাদ আলী
নিজের আঙিনায় অস্পৃশ্য ভূরুষ দ্বারা ছাত্রী নিপীড়নকালে নির্বিকারে
কম্পিউটার গেম খেলেন।
হঠাৎ চশমা কেনরে? মামার প্রশ্ন।
প্রায় সাতদিন ধরে তন্ব তন্ব করে খুঁজেও দুর্বৃত্তের মুখ দেখতে পেলে না তাই।
মানে, তুই কী ভাবিস আমি চোখে দেখতে পাইনে?
মামা, আমাদের ভাবনায় আদৌ তোমাদের কিছু আসে যায়!
তুই কী আমাকে লজ্জা দিচ্ছিস?
যার যেটা একদম নেই, তাকে আমি সেটা দেই না মামা।

দ্রোহা সত্যি বলছিরে আমরা ভূলিশ ভোয়েন্দা বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা মিলে
টানা ৪৮ ঘন্টা ধরে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ভিডিওগুলো দেখেছি। কিন্তু
দাঁড়িওয়ালা, লীগওয়ালা কাউকে ট্রেস করা যাচ্ছে না।
মামা, তুমি ভূতাত্তোর টিভিতে ফারজানা রূপার রিপোর্ট দেখেছো? সেখানেতো
সংঘবদ্ধ দাঁড়িয়ালদের ব্যাপক আনাগোনা। বুঝেছি, দেখো নাই। ঐ যে ভূতালো
পত্রিকায় মতি ভাই আমাদের পহেলা বৈশাখের প্রতিবাদী হিরো বিশ্ববিদ্যালয়ের
ভূত্র ইউনিয়নের সভাপতি লিটন নন্দীর দুর্দান্ত ইন্টারভিয়্যু ছেপেছে। সেটাও
নিশ্চয় তোমার চোখে পড়েনি।
আরে, ভিডিও দেখছিলামতো, অন্যদিকে মন দেয়ার সময় পাইনিরে।
জাকারবার্গের ভূতবুকে বর্ষবরণ বা পহেলা বৈশাখের সার্বজনীন উৎসবের
শুভাকাঙ্খীরা হাই ডেফিনিশন ফটো আপলোড করে নারী নিপীড়ক ভূরুষদের ধরিয়ে
দিতে বলছে। সেখান দুর্বৃত্তের মুখ খুঁজছো না কেন?
আমাদের ভূলিশ বিভাগের নিজস্ব তদন্ত তরিকা আছে। তুই বাচ্চা মেয়ে এসব বুঝবি
না। তাছাড়া লিটন নন্দীর বস্ত্র হরণের কাহিনী আষাঢ়ে গল্পই মনে হচ্ছে।
মহাভারতে পঞ্চ পান্ডবেরা ধ্রুপদীর বস্ত্র সত্যিই হরণ করেছিল হয়ত। দেবতারা
কী ঠেকাতে পেড়েছিল? সেজন্যইতো কাহিনীটা ইতিহাস হয়েছে। এ যুগে অমনটা
হয়নারে।
মামা, আর কতোটা নীচে নামলে তুমি তাকে নীচ বলবে।
কি বলছিস?

মামা, পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণ উৎসবে বান্ধবীদের নিয়ে ভিএসসি এলাকায় আমিও
ছিলাম। আমি নির্লজ্জ ভূরুষের প্রকাশ্য নোংরামি স্বচক্ষে দেখেছি। দেখেছি
শ্বাপদের লোলুপতা, হায়েনার নখড় দংশন। ওদের অসভ্য নেশার ঘোর এতোটা প্রবল
ছিল যে, সেসময় ওদের নিজেদের মাকে কাছেও পেলেও ঐ কুলঙ্গাররা ছিড়ে খুড়ে খেত
যেন।
আহা বস্ত্রহরণতো হয়নি।
মামা, মেয়েবেলায় বাবা হারিয়েছি, তোমাকে বাবার চেয়েও অধিক জানি, বেশি
মানি। পহেলা বৈশাখে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম উৎসবে, মানুষের বহুবর্ণিল
মিলনমেলায় তোমার এই মেয়েটিকে ওরা নিগ্রহ করেছে, অপমানিত করেছে। এসব তোমার
কাছে কিছু নয়? নীতি নৈতিকতার ব্যাপারটিকে আমলে না নিয়ে তোমরা খুঁজছো
দুর্বৃত্তের দাঁড়ি আছে কী নাই। ভূতলীগ নাকি ঝাড়ুলীগ। নির্যাতনের মাত্রা
কতটুকু! নারীর কাপড় আসলে খসে ফেলতে পেরেছিল কীনা! শ্বাপদের হামলায় নারী
বিবস্ত্র হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছিল কীনা, তবে তাকে বিভৎস বলা যাবে! সবিশেষে
ধর্ষণ হয়েছিল কীনা! ইত্যাদি ইত্যাদি।
দ্রোহা তুই খামোখা রেগে যাচ্ছিস আমার ওপর।

ক্রিং ক্রিং ক্রিং। ভিএমপি কমিশনারের ফোনে ক্লাসিক রিংটোন।
জ্বী স্যার , শুনছি।
বলছিলাম কি, বিষয়টা এমনভাবে হ্যান্ডেল করতে হবে যাতে আরও বেশ কিছুদিন
পহেলা বৈশাখের ব্যাপার স্যাপার নিয়ে মিডিয়া গরম থাকে।
জ্বী স্যার।
প্রেতনগরের ইলেকশানে জয়ের মুখ দেখতে চাইলে কৌশলপত্র ঠিকঠাক করা চাই।
মিডিয়াকে মিসগাইড করার দায়িত্ব তোমার ওপর। সব ভূলিশদের এটা জানিয়ে দাও।
পুরষ্কার আমি নিজ হাতে দেব কেমন।
জ্বী স্যার। জ্বী মস্যার। সালাম স্যার।
কে ফোন দিয়েছিল মামা? দ্রোহার কৌতুহলী প্রশ্ন মামাকে।
আমাদের এই ভূতরাষ্ট্রের অভূত কর্তা।
তা তিনি কী বললেন?
আরে এতো বড় প্রোগ্রামে একটু আধটু যৌন নির্যাতন হতেই পারে। তাছাড়া মেয়েদের
পোশাক আশাক…
মামা তোমার অভূত কর্তা একথা বলতে পারলেন?
আরে নাহ! আমিই বলছিলাম। বস্ত্রহরণতো হয়নি।

মামা! এই নাও তোমার জন্য সেদিনের ঘটনার ঊনিশটা পরিষ্কার ছবি নিয়ে এসেছি।
লিটন নন্দী যার কথা বলেছিল। তোমার ভূতুরে ক্যামেরার বাইরে তোমার এই মেয়ের
বস্ত্রই হরণ করেছিল ভূরুষ নামের লোভী হায়েনারা। মোবাইলে আমার বান্ধবীর
তোলা ছবি। লিটন তার গায়ের পাঞ্জাবি দিয়ে আমার সম্ভ্রম রক্ষা করেছিল মামা।
আমাদের মতো অসংখ্য নারীর অপমানে তুমি, তোমার ভূত কর্তা বা এই
ভূতরাষ্ট্রের কোনো ভাবান্তর ঘটল না। রাষ্ট্রযন্ত্র আর কতোটা নির্বিকার
হলে তাকে ভূতাপেক্ষ রাজ্য বলা যাবে মামা?
মামা অস্ফুটে ছবিগুলোর দিকে তাকালেন। এযে লিটন নন্দীর বর্ণনার চেয়েও
বেশি। মামার চোখে জল। বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠ। মেয়ের দিকে মুখ তুলে তাকাবেন এ
শক্তি তার নিঃশেষিত।

মাগো! আমরা ওপর থেকে দম দেয়া ভাঙ্গা রেকর্ড বাজিয়েই যাচ্ছি, বস্ত্রহরণতো
হয়নি। আসলে তারচেয়েও বেশি কিছু হয়েছে। নারীর কাছে, আমার মায়ের কাছে
করজোড়ে ক্ষমা চাই। আমার মায়ের মহৎ, সুন্দর ও পবিত্র সম্ভ্রমকে
মেরে ফেলেছে শৃগালেরা। কারণ রাষ্ট্রযন্ত্রের অযোগ্যতা ও নির্লজ্জ
ব্যর্থতায় আইন কানুন বা সদাচার এখন পুরোমাত্রায় নির্বাসনে। এমন ভূতরাজ্য
কেমন করে চলতে পারে?
তবে ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ নিক মহান প্রকৃতি।

ফারদিন ফেরদৌসঃ লেখক ও সাংবাদিক।
০৭ বৈশাখ ১৪২২
facebook/fardeen.ferdous
twitter/fardeenferdous