রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিঃ নিংড়ে নেবে রস হোক যতই মানবীয় ধ্বস

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 24 April 2015, 05:49 PM
Updated : 24 April 2015, 05:49 PM


কবি কল্পনায় 'বাতাসে লোবানের গন্ধে'র মতোই অনিশেষ ঘ্রাণ এখনো বহমান সেইখানে। ঢাকা আরিচা মহাসড়ক ঘেষে সাভারের সেই এলাকার ঘ্রাণটা ভুলতেই পারেন না মহামহিম মালিক সাহেব। প্রাণ পাগল করা ওই ঘ্রাণেই তিনি শান্তি নিদ্রা যান, আবার প্রত্যুষে ঘুম থেকে উঠে অর্থ কড়ির ধান্ধায় নামেন। নিশুতে স্ত্রী সোহাগটাও তিনি ওই গন্ধ মদিরাতেই সারেন। ঘ্রাণটা তাকে বিমোহিত করে, উজ্জীবিত করে। তাকে এবং তার উচ্চাবিলাসী সহচরদের এক ভিন্নতর আনন্দধামে নিয়ে যায় যেন সেই গন্ধ। তিনি আমাদের পোশাক কারখানার মালিক। তিনিই আমাদের পোশাক ভবনেরও মালিক। তিনি কখনো পোশাক সংগঠন বিজেএমই বা বিকেএমই'র নেতা অথবা যুবলীগ নেতা। উনারা সবাই মিলে বাতাসে মনুষ্য লাশের গন্ধে যারপরনাই পুলক অনুভব করেন। কারণ ওই লাশের পিঠেই চড়ানো থাকে বিপুল ব্যাপক অর্থ কড়ি মালামাল। ওই লাশ নিংড়েই তৈরী হয় উপরতলায় উঠে যাবার সোপান। সাহেবদের মন ও মননে তাই সেই সবুজ স্বর্গ গ্রাম থেকে অচেনা শহরে আসা লোভাতুর মুখোশ পড়া তথাকথিত ভালো মানুষদের লালসার যাতাকলে পিষ্ট অসহায় পোশাক কর্মীর প্রাণহীন দেহখানি সতত জিন্দাবাদ। আমরা আর এতোটুকু অবাক হবো না। অবাক হওয়ার অনুভূতি মরে গেছে সেই কবে।

ভাগ্যিস ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে হরতাল সফল করতে ছাত্রদল যুবদল কর্মীরা অভিশপ্ত রানা প্লাজার পিলার ধরে ইয়া বড় ঝাঁকুনিটা দিয়েছিল, নইলে ১১৩৫ জন নিতান্ত দীনহীন পোশাককর্মীর স্বর্গবাস হতোই না। হুর গিলমান বা হাউজে কাউসার ভাগ্যেই জুটতো না তাদের। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দানদক্ষিণার ১২৭ কোটি ৬৭ লাখ ৩৩ হাজার ৩৪৯ টাকা জমাই হতো না। আর ওই যে স্বর্গবাসীদের নামে চার কোটি ডলারের স্বপ্ন তহবিল ভাবাই যেতো না। বাঙালিকে একশ কোটি টাকা খরচ করে যেখানে দেশপ্রেমের গিনেস রেকর্ড করতে হয়, সেখানে একটা ঝাকুনিতেই বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনার রেকর্ডটি কেবল আমাদের। পিলার ঝাকুনির এতো গুণ, আলমগীর মহিউদ্দিন হেসে খুন।

১১৩৫ সংখ্যাটা নিতান্ত গাণিতিক হিসাব নিকাশের বিষয় নয়। মহাবিবেকী মনুষ্য প্রজাতির চাপিয়ে দেওয়া জুরাইন কবরস্থানে ডিএনএ'র কথিত নম্বরী কবরকেই সান্ত্বনা হিসেবে নেওয়া স্বজনদের বুকে পাথর চাপা কষ্ট দূর করবার সুত্র সমাধানও বটে। ওই অংকের ঘরেই যে, কারো মা, বোন, স্ত্রী বা পুত্র কন্যার বসবাস। অতি শোকের দহনে পোড়া অভাগা যেসব স্বজনরা ওইরূপ কবরের চিহ্নটুকুও দেখার সুযোগ পাননি তারা বুঝে চলেছেন কি বেদনার এক এক তিন পাচের কঠিন এই অংক!

সাভার ট্রাজেডির ভয়াল মৃত্যুর হিসাব মিলুক বা না মিলুক, অর্থ বা ডলারের হিসাবতো ঠিকঠাক মিলছেই। রানা প্লাজা ধসের শিকার ৭৩ শতাংশ শ্রমিক বেকার হয়ে পথে ঘুরুক। দিনরাত মেঘাচ্ছন্ন অন্ধকার হাতড়ে বেড়াক। না খেয়ে বিনা চিকিৎসায় অবারও দ্বিতীয়বারের মতো মরুক তাতে কার কী? দেখতে হবে তহবিলে কতটা লাভ থাকছে। চলছে চলুক কথার ফুলঝুড়ি, সভা সেমিনার বা ব্যাপক চাপাবাজি। কিন্তু কেউ কথা রাখবে না। পিছটান দিবে পোশাক মালিকরা। ত্রাণ তহবিলে টাকা জমা হতেই থাকবে। নিখোজ শতাধিক শ্রমিকের সন্ধানে আমৃত্যু ছুটে বেড়াক বিবাগী স্বজনেরা। হুশ না ফিরুক মালিক বা রাষ্ট্রের। মৃতবত ঘুমিয়েই থাক মানুষের কুলীন মানবতা। শ্রমিক হত্যার গ্লানিতে দেশের ভাবমূর্তি গোল্লায় যাক। রক্তের দাগ না শুকাক। অবিরাম চলুক শোকের দাবানল। কস্মিনকালেও নিরাপদ না হোক শ্রমিকের কর্ম পরিবেশ। তাতে কোনো পক্ষেরই কিছু আসবে যাবে না! ধসের নায়কদের বিরুদ্ধে এই জীবনে আর চার্জশীট দেওয়া হবে না। ওসব হয় বিশেষ শ্রেণির মানুষের ক্ষেত্রে হয়তো। কিন্তু ঘর্মগন্ধী শ্রমিক সেইসব পোশাক কর্মীরাতো মনুষ্য গোত্রবংশের মধ্যেই পড়ে না। অতএব রানা প্লাজা নিয়ে পূর্বাপর যা কিছু হচ্ছে বা হবে তার সবটাই কেবল ঠিকই নয় অনেক বেশি সঠিক নিশ্চিন্তে ভাবতেই পারেন।

তবে একটানা সতের দিন দানা পানি না খাওয়া চকচকে পোশাক পড়ে ফৌজি বাহিনীর হাতে উদ্ধার পাওয়া একজন রেশমা ওয়েস্টিনে চাকরি নিয়ে খুব বেশি ভালো আছেন হয়তো। কিংবা একজন দৃশ্যগল্পকার তাসলিমা আখতার ধসের ভিতর আঁকড়ে ধরা দুটি তরুণ-তরুণীর পৃথিবী শ্রেষ্ঠ অমর ভালোবাসার আলিঙ্গনের ছবি তুলে দুনিয়া মাত করবার মতো সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। ধস বুঝি এভাবেই মালিক, সরকার, নেতা বা কারো কারো জীবনে পৌষ মাস বয়ে আনে।

তবে কারো সর্বনাশের মতো মনুষ্য বিবেক জাগ্রত করতে যদি প্রকৃতি নিজে এক অভিনব ঝড় তুলে আপন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয় তবে তা দেখার মতোই হবে বটে। এবার আসুন খানিক সময়ের জন্য সেইরকম একখানা ক্ষুদ্র কল্পনাট্য দেখে আসি।


আমাদের ভোতা বিবেককে নাড়া দিতে তিনি এসেছেন সুদূর আফ্রিকা থেকে। আপাতত: আস্তানা গেড়েছেন গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের বিশালকায় রেইনট্রিগাছে। সেখানে মমতাময়ী মাতৃসমারা থাকেন। যারা জন্ম দেন, কখনো মেরে ফেলেন না। তাই সেখানে শুয়ে বসে নিশ্চিন্তে দেদার বংশ বৃদ্ধি করে যাচ্ছেন তারা। এই গরমে আরও বেশি বেশি। জায়ান্ট মিলিবাগ। আপাত নিরীহ ষটপদী পোকা। জানা যাচ্ছে, উনারা সেকেন্ডে সেকেন্ডে জ্যামিতিক বা গাণিতিক হারে বেড়ে গিয়ে চুলকানি বা অ্যালার্জি উদ্রেককারী বিশেষ ধরণের ধুলায় মাখামাখি করে অচিরেই ছুটবেন বিজেএমই/বিকেএমই ভবন, সংসদ ভবন, গণভবন, সর্বোপরি বঙ্গভবনের পানে। নালিশ জানাবেন। মানুষকে বায়ুরোগ বা মনোবিকারগ্রস্থ ষটপদী পোকা সদৃশ হলে চলে না। অসহায় মনুষ্য নিংড়ানো রস খাদক নয়, তাকে দ্বিপদী মানুষ হয়ে উঠতে হবে। কথা না শুনলে আক্রমন। ছাত্রলীগের মতো কাটা রাইফেল, পিস্তল, বোমা, চাপাতি, রামদা বা হকিস্টিক দিয়ে নয়। অস্ত্র ওই অ্যালর্জিক ধুলো। ফোসকার ছড়াছড়ি, মারাত্মক শ্বাসকষ্টের আহাজারি। অতএব সাধু সাবধান।

এই ক্ষুদ্র নাট্যের আগে পোশাক মালিকদের সৃষ্ট ধস কাহিনী থেকে পলায়নপর মালিকদের পিছটানের গল্প বলছিলাম আমরা। আর্ন্তজাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলও'র ১২১ ধারা মোতাবেক ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দূরে থাক, সোহেল রানা প্লাজা ধসে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারকে কোন টাকা পয়সা দিতে পারবে বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশি পোশাক শিল্প মালিকরা। তাই বলে ভাববেন না যে, তারা শ্রমিকদের জন্য কিছুই করছেন না। গেল কয়েকদিনে পত্রিকা জুড়ে বিকেএমই, বিজেএমই ও বিটিএমই দুই হাত তুলে নিহত ভাইবোনদের স্মরণে কেবলই মোনাজাত করে যাচ্ছেন। বিনা পয়সায় রুহের মাগফিরাত কামনায় এমন মোনাজাত কে পেয়েছে কবে? অতিশয় মানবীয় বিপর্যয় আর বিরল মানবতাবোধ ধসের প্রথম বার্ষিকীতে আসুন ওই মোনাজাত আনজাম করণেওয়ালাদের বাহবা দেই।

শ্রমিকের গণমৃত্যুর এমন শোকাবহ দিন স্মরণে বিশ্বজুড়ে আজ পালিত হচ্ছে 'ফ্যাশন রেভুল্যুশন ডে'। শ্রমবন্ধু পোশাক শিল্পীদের হৃদয় বিদারক দুঃখ দুর্দশায়, বুকফাটা আর্তনাদে, কষ্টের নীলসমুদ্র মন্থনে বা আগুন কান্নার অশ্রু জোয়ারে ভেসে, এসো হে, স্বঘোষিত বিশ্ববিবেকবান মানবেরা সবাই মিলে সমস্বরে এমনতর নিষ্করুণ ও নিদারুণ ফ্যাশন বিপ্লবের জয়গান গাই !

লেখকঃ সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
২৪ এপ্রিল ২০১৪
facebook.com/fardeen.ferdous.bd
twitter.com/fardeenferdous