অভিশপ্ত নগরে ভেসে যায় মায়ের সম্ভ্রম

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 23 May 2015, 10:04 AM
Updated : 23 May 2015, 10:04 AM

আর তেঁতুলের গল্প নয়।
মায়ের স্বর্গ সম্ভ্রম নিয়ে কাপুরুষের নারকীয় আস্ফালনের প্রতিবাদ হোক সমস্বরে।
দ্রোহে আগুনের পরশমণি ছুঁয়ে যাক আপনার প্রাণে; যদি হন মানুষ।

ডেটলাইন একুশ মে দুই হাজার পনের; বৃহস্পতিবার-সন্ধ্যা। আমাদের এক ২২ বছর বয়সী নৃগোষ্ঠী যিশু অনুসারী গারো মা; যার চোখে ছিল আগামী দিনের সুখ স্বপ্ন; প্রাণদায়িনী মা অথবা দেশ মাকে কিছু ফিরিয়ে দেবার আকুতি; কর্মস্থল থেকে বাসায় ফিরছিলেন। লোভাতুর জানোয়ারসদৃশ আসঙ্গলিপ্সু পাঁচ কাপুরুষ ছাইরঙা গাড়িতে অস্ত্রের মুখে তুলে নেয় ঐ মাকে। নগরে তখন ভয়াল অভিশাপ নেমে এল যেন। ব্যাধিগ্রস্ততায় ছেয়ে গেল নিয়ন বাতি আর উড়াল সড়কের সুসজ্জিত পথ। পাখি বা পোকাদের অশ্রু কান্না; কে বুঝবে? মানুষ কোথায়? স্লো মোশনে গাড়ি রঙবেরঙের সড়কপথে ঘুরছে। পাল্লা দিয়ে ইন্দ্রিয়সেবী শ্বাপদ হায়েনাদের নিলাজ ও বেজন্মা উত্থিত শিশ্নের চক্রাকার খুনের আচড় উঠছে নামছে মায়ের সম্ভ্রমে। এ এক জটিলতর পরিস্থিতি; নারীর কাছে মৃত্যু থেকেও মারাত্মক। এ নির্মম অভিজ্ঞতা ক্রমান্বয়ে ধসিয়ে দিচ্ছিল আমার এ মায়ের জীবনের ভিত্তি। এই মুহুর্তে এক গভীরতম অন্ধকারে পতিত হলেন মা। যন্ত্রণা আর বিভীষিকায় পাগল হয়ে গেলেন যেন। হাত পা মুখ বাঁধা। অস্ত্রের নল চোখ বরাবর। অনুভূতি অসার।

আমার এ মা জননী, তাঁর চিন্তন ও ভাবনার রেখাটি সমান্তরালে রাখবার জোর চেষ্টা করে গেলেন। পিতৃতান্ত্রিকতা, পুরুষাধিপত্ব বা নারীবাদ বিষয়গুলো অল্পবিস্তর জানা আছে তাঁর। বিভীষিকা ভুলতে মন থেকে কিছু একটা পাঠোদ্ধার করবার চেষ্টা করলেন নিরন্তর ধর্ষণ ভীতির মধ্যে বাস করা এই মা'টি। যদি আজ বেঁচেও থাকেন তবু পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, রাষ্ট্র, আইন আদালত সকলেই তাঁকেই দোষ দেবেন। ধর্ষিত হওয়া যেন নারীরই অপরাধ-কেন সে দু'পা চেপে সব কিছু বন্ধ করে রাখে নি? তাঁর মনে হলো, গবেষকদের সেই কথা। নিউজিল্যান্ডে ধর্ষণ সম্পর্কে গবেষকেরা জানিয়েছেন, ধর্ষিতরা বিচারের পীড়নকে খারাপ মনে করে ধর্ষণের থেকেও বেশি; যা অনেকটা ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার সমতুল্য। ধর্ষিত নারী বিচার চাইতে গেলে ধর্ষিত হয় কমপক্ষে তিনবার, দু'বার রূপকার্থে।

ভারতীয় বা গ্রিক পুরাণ কথা স্মরণে এলে তাঁর। ভারতীয় পুরাণের পরাশর কর্তৃক সত্যবতীকে ধর্ষণ কিংবা দেবরাজ ইন্দ্রের স্বর্গমর্ত্য জুড়ে ধর্ষণ করে বেড়ানো মনে পড়ছে তাঁর। গ্রিক পুরাণের প্রধান ধর্ষণকারী দেবরাজ জিউসের কথা মনে করতে পারলেন তিনি। পুরাণকথায় ধর্ষণ যেন ধর্ম বা দর্শনেরই অনুষঙ্গ। পৃথিবীতে পৌরাণিক কাল না থাকুক, দেবতা না থাকুক; দেবতাদের অবাধ ধর্ষণের স্থানটি পৃথিবীজুড়েই মড়করূপে গ্রহণ করেছে ভ্রষ্টাচার বা বদাচারী পুরুষ।

যিশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার কথা মনে হতেই গাড়ির আলো আঁধারীর নরকস্থানে যেন ঐশ্বরিক আলোর ঝলকানি দেখা গেল। তাঁর নিজেকে মনে হলো শ্রেষ্ঠ দাতা মাদার তেরেসা। গৌতম বুদ্ধের অমৃত বাণীও মনে করতে পারলেন তিনি; জগতের সকল প্রাণি সুখী হোক। এখন এই অবস্থায় তাঁর নিজেকে মনে হলো মাকড়শা মা। মাকড়শা মায়ের সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর ছোট্ট বাছারা খাবার হিসেবে মায়ের শরীর খেয়ে কঙ্কাল ফেলে রাখে। সে মা তা সইতে পারেন, নতুন প্রাণের আবাহনে। কিন্তু এখানে মায়ের জরায়ু ভক্ষণে বিকৃত পৌরুষ পরিচয় তুলে ধরবার অভিলাষী হয়েছে দুর্বৃত্তের দল। ফকির লালন সাঁই বলতেন, সহস্র যোনি বেয়ে হাজার যুগ ধরে পুরুষের জন্ম; আর সেই পুরুষ স্বাপদ হয়ে খুবলে খাচ্ছে সেই মায়ের উদর প্রাণ। তবে তাই হোক; থমকে যাক মানব জন্মের সূতিকাগার। মায়ের অপমানে ধ্বংস হোক দূষিত পুরুষ প্রজাতি।

রিরংসাগ্রস্ত কাপুরুষরা আমার গারো মায়ের প্রাণ সংহার করতে পারলেন না; ফিরতে পারলেন নিজের বাসায়। কিন্তু পরদিন মা আমার মুখোমিখি হলেন এক নির্মম ও চির সত্য সমাজ বাস্তবতার।

আপনাদের মনে থাকবার কথা, ১৯৯৫ সালের আগষ্ট মাসে, দিনাজপুরে নিজেদের গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে পুলিশ দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ ক'রে হত্যা করে এক বালিকাকে। প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ শহরবাসীদের মধ্যে প্রাণ দেন অন্তত সাত জন। এবারের পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণ জনসমুদ্র জলসায় প্রকাশ্য নারী নিপীড়ন করে সিসি টিভি চিহ্নিত হায়েনার দল। এ ন্যাক্কারজনক ঘটনাকে দেশের আরক্ষা বাহিনীর বিবমিষাগ্রস্ত প্রধান বলেন, এটা কিছু বাচ্চা ছেলের দুষ্টুমি।

সেই দুষ্টুমি বাতিকওয়ালা আরক্ষা বাহিনীর কাছেই সেই রাতের সম্ভ্রমহানির প্রতিবিধান চাইতে গেলেন গারো মা। কয়েকটা থানা ঘুরবার পর ভাটারা থানার ওসি মামলা গ্রহণ করে নিজেকে পরিচয় দিলেন; তবু তিনি মানুষ। তারপর এই গারো মায়ের সাথেও সেই চিরাচরিত তড়িকার চর্চিত ভাঙ্গা রেকর্ড বাজতে থাকলো। আনবিক বোমাগ্রস্ত গারো মেয়েটির জন্য কারো বেদনা বা করুণা যেনবা নেই। বিচারওয়ালাদের প্রশ্নবাণ এমন যে, তোমার পোশাক আশাক ঠিক রেখে সাবধানে পথ চলতে পারো না! খামোখা কেন ধর্ষণকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতে এসেছে; ঘটনাটিকে ভাগ্য বলে মেনে নাও। পুলিশি প্রশ্নবাণের অশ্লীলতা এতোটা যে, আমার এই মায়ের যেন মনে হচ্ছিল তিনি আবারও ধর্ষিত হচ্ছেন কালকের সেই হায়েনা পুরুষের কাছে। যেনবা প্রকৃত অপরাধী আমার এই মা নিজেই। অহেতুক দেবতুল্য পুরুষকে কলঙ্কিত করতে কেন এই অভিযোগ। ভাবনার ঘোর থেকে সম্বিৎ ফিরে পান তিনি পুলিশের ধমকেঃ

তোমার তো কোন সাক্ষীটাক্ষী নাই। চারজন পুরুষ সাক্ষ্য না দিলে অবশ্য প্রমাণিতও হবে না যে তুমি ধর্ষিতা। দেশের ধর্ম আইনতো তাই বলে। এটা যে প্রমাণিত ধর্ষণ; ডাক্তার দেখে আগে বলুক। অভিযোগ না হয় পরে হবে! তা তোমার গায়ে আঁচড়ের দাগ কোথায়? চিহ্ন ছাড়া আবার ধর্ষণ হয় নাকি?
ধর্ষিতা মা আমার হতবিহবল হয়ে যান!
তবে কী আমি মিথ্যাবাদী…?

কার কাছে বিচার, কীসের বিচার? সবখানে সেই নখড়দন্ত বিশিষ্ট বর্বর পুরুষ। এরা সবাই নারীর ওপর পুরুষাধিপত্য প্রতিষ্ঠার কৌশলে লিপ্ত। নারীবাদী মেরি ওলস্টোনক্রাফট বা সিমোন দ্য বোভোয়ার আপনাদের কথা সত্যি। রাষ্ট্রযন্ত্র, পুলিশ, বিচারকেরা ধর্ষণকে সন্ত্রাস বা অপরাধের ভাষায় কলঙ্কিত বা নিন্দিত করছেন না। পুরুষাধিপত্য কায়েমের লৈঙ্গিক সম্পর্ক বা লৈঙ্গিক রাজনীতির বিষয়টি অস্বীকার করে হায়েনাদের ধর্ষকামকে কিছু যৌন ব্যাধিগ্রস্ত মানুষের বিকৃত কাজ মনে করে বিষয়টিকে পাত্তাই দিতে চাইছেন না এরা। এদের সবার কথায়, আমার মায়ের মনে এই প্রতীতি জন্মে যে, সকল পুরুষের মধ্যেই সন্দেহাতীতভাবে আবাল্য থেকেই ধর্ষণের প্রবণতা রয়েছে। তাই পুরুষের চোখে ধর্ষক দেবতাতুল্য; ধর্ষিতা একমাত্র ও চির অপরাধী।

গারো মায়ের ভাবনা যেন পথহারা পথিকের মতো ঘূর্ণিপাকে পড়ে যায়। স্রোতস্বিনী নদীতে যেন তাঁকে ছুড়ে ফেলা হচ্ছে। সামনে অতল সমুদ্র। যেখানে ভেসে ভেসে দৃষ্টিসীমায় মিলিয়ে যাচ্ছে মায়ের সত্য, সুন্দর ও স্বর্গসম সম্ভ্রম।

১৯৭৩ সালে ধর্ষকের চারণভূমি আখ্যাত ভারতের মুম্বাইয়ের কিং এডওয়ার্ড হাসপাতালের নার্স অরুণা ঐ হাসপাতালের এক পরিচ্ছন্নতাকর্মীর ধর্ষণের শিকার হন। ঘটনার পর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে দীর্ঘ ৪২ বছর কোমায় থাকার পর এবার মে মাসে ৬৮ বছর বয়সে মারা যান তিনি। জানা যায়, হাসপাতালের তত্ত্বাবধানে থাকা পশুপাখির জন্য খাবার চুরি করায় পরিচ্ছন্নতাকর্মী বাল্মীকিকে বকেছিলেন অরুণা। সে কারণে তাঁকে ধর্ষণের শিকার হতে হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাল্মীকির বিচার হয় চুরির জন্য; ধর্ষণের জন্য নয়। এ ঘটনায় সমস্ত আইন আদালতের পুরুষেরা যে তাদের জন্মগত স্বভাবসুলভ বশে নিকৃষ্ট পুরুষের পক্ষেই ছিলেন তা অনুধাবনযোগ্যই।

তাই আমাদের এই গারো মা তথা সকল সম্ভ্রম হারানো বীরমাতা পুরুষের কাছে বিচার না চেয়ে; সমাজরাষ্ট্রের সব এলাকায় পুরুষের সমান নারীর প্রতিষ্ঠা চান। শারীরিক শক্তিতে কিংবা মনোজাগতিক চিন্তা দর্শনে পুরুষের সমকক্ষতা চান আমাদের সকল মা। জীবনদাতার কাছে এই হোক সবিনয় নিবেদন…!

ফারদিন ফেরদৌসঃ লেখক ও সাংবাদিক
২৩ মে ২০১৫
Facebook/fardeen.ferdous
Twitter/fardeenferdous