আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 10 June 2015, 09:04 PM
Updated : 10 June 2015, 09:04 PM

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভিয়েনায় এক মনোচিকিৎসককে নাতসীরা তাঁর পরিবারসহ কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে তুলে নিয়ে গেলে সেখানে তাঁর মা-বাবা ও স্ত্রী মারা যান। শুধু বেঁচে যান সেই মনোচিকিৎসক। সেসময় তিনি কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে আটক মানুষদের ওপর মনোসমীক্ষণ করেন। একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায় তাঁর কাছে; যেসব মানুষ জীবনে সুখ খোঁজে বা কেবল নিতে চায়, বিলাসী দ্রব্য কিনতে চায়; তাদের মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করার ইচ্ছাশক্তি কম হয়। আর যেসব মানুষ কিছু দিতে চায় সমাজকে; পরার্থে কাজ করে জীবনের গভীরতম অর্থ খুঁজে পেতে চায়, তাদের মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা বেশী হয়। পরার্থে আপনারে দান নিয়েই আজকের পারিবারিক গল্প।

গ্রামের সহজ সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত আমাদের বাপুজি। শহুরে যান্ত্রিক আভিজাত্য ঠিক তাঁর ধাতে সয় না। তাই পারতপক্ষে তিনি কখনও শহরমুখো হন না। কিন্তু এবার এমন এক অনিবার্যতার সামনে দাঁড়িয়ে যে, ঢাকা শহরের হাতছানি কড়জোর করেও যেন ফেরাতে পারলেন না তিনি। আমাদের আম্মু গলাতে গুরুতর সমস্যায় আক্রান্ত; যার নিদান জানেন কেবল ঢাকার অধ্যাপক শ্রেণির ডাক্তাররা।

সপ্তাহের প্রথম দিন রোববার ভোরেই প্রিয়তমা স্ত্রীকে নিয়ে লোকাল বাসে ঢাকায় যাত্রারম্ভ করলেন বাপুজি। ৩৭ ডিগ্রি তাপমাত্রার গ্রীষ্মদিনে লোকাল বাস যাত্রায় আম্মুর বাস ভ্রমণে 'মোশন সিকনেস' বা 'হিস্টিরিয়া'র মতো কিছু ক্রনিক সমস্যা কেমন বাড়নাড়ন্ত রূপ ধারণ করতে পারে বাপুজি তা জানতেন। কিন্তু অবসর জীবনযাপনে সামর্থ্যের বিষয়টি তাঁর মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে অবিরাম। নিজের গ্রাম বাঙ্গুরী থেকে তাঁদের দ্বৈত যাত্রারম্ভ হলো। উদ্দেশ্য ঢাকার গ্রিন রোডের গ্রিন লাইফ হাসপাতাল। যেখানে বসেন দেশের খ্যাতিমান নাক কান গলার ডাক্তার অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত।

গরম আবহাওয়ায় মানুষের গাদাগাদিতে বাসের পরিবেশ ভয়ানক হয়ে উঠে অসুস্থ্য আম্মুর কাছে। ঘন ঘন বমি ঠেকাতে সঙ্গে রাখা পলিথিন ব্যাগের সংগ্রহটা একসময় শেষ হয়ে গেলে বাপুজি পড়েন মহাবিপদে। তবে আম্মুর হিস্টিরিয়া ব্যামোটা যেন হঠাৎ রক্ষাকবচ হয়ে আসে। জ্ঞান হারালেন তিনি। আপাততঃ বমনের ঝামেলা মুক্ত হলেও বাস থামবার পর আম্মুর জ্ঞান ফিরবে কিনা এই নিয়ে টেনশনে পড়েন বাপুজি।
রাস্তার ভয়াবহ যানজটের ধকলসহ নানা ঝক্কি ঝামেলা শেষে বিকেলে গ্রিন রোডে পৌছতে পারেন বাপুজি। নিজেদের দুজনেরই বাড়তি সুগার সমস্যা নিয়েও সময়মতো দুপুরের খাবারপর্বটি সারতে ব্যর্থ হন তাঁরা। তার ওপর অধ্যাপক সাহেবের চেম্বারে গিয়ে শুনলেন তাঁর আসার অনেক বাকী। সন্ধ্যায় বসবেন তিনি। বাপুজির মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে যেন, ঢাকায় থাকবেন এমন পরিকল্পনা নিয়েতো তিনি আসেননি। তারপরও সঙ্গিনীকে কিছু বুঝতে না দিয়ে নিজেকে সামলে নেন।

আম্মুর গলায় ফুলে যাওয়া গ্ল্যান্ড অপারেশন করতে হবে প্রাথমিকভাবে চিকিৎসকরা এমনটাই ধারণা দিয়েছিলেন। কিন্তু এই অধ্যাপক অবশ্য বললেন, আরও পরীক্ষা নিরীক্ষা দরকার। তাই এই টেস্ট সেই টেস্টের নামে বাহারী ডাক্তারী আবদারও পূরণ করলেন বাপুজি। এসব করতে করতে রাত ৮টা। কপালে দুঃশ্চিন্তার রেখা; গ্রামের বাড়ি ফিরবেন কীভাবে? গ্রিন রোড থেকে রিকশা করে কারওয়ান বাজার মোড়ের দিকে যাত্রা করলেন। অভিজাত মার্কেট বসুন্ধরা সিটি শপিং সেন্টারের সামনে এসেই রিকশার ডান চাকার হাওয়া বের হয়ে গেল। যেন কিঞ্চিত দূর থেকে বন্ধুকের আওয়াজ। ঠুশ!

বাবা, মা, আপনারা এই রাতে এখানে!

আমাদের বাপুজি ও আম্মু এমন সুললিত মধুর ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বিপরীতে ঘার ঘুরিয়ে দেখেন তাঁদের সুদর্শনা প্রিয় বৌমা বর্ষা।
বাবা, আপনারা ঢাকায় আসবেন একবার জানালেনও না। কেন বাবা? আপনার ছেলে নাহয় ব্যস্ত। আমাকে অন্ততঃ একটা ফোন দিতে পারতেন! আপনার নিজের মেয়ে হলে এমনটা পারতেন? আবেগ ও অভিমানমাখা প্রশ্নের পর প্রশ্ন।
বৌমার এমন আহ্লাদপনায় বাপুজি ও আম্মু যুগপৎ মুগ্ধ ও বিস্মিত হন।

এতরাতে কোনোমতেই বাবা মাকে গ্রামে ফিরতে দেবে না এই অসাধারণ বৌমা। অফিসের গাড়িতে করে বাবা মাকে নিয়ে সোজা সেনানিবাসের বাসায়। যেতে যেতে মায়ের শরীর নিয়ে সেকি টেনশন। মা আপনার শরীর এত শুকনো হলো কেন? আপনি ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া করেন কিনা? আপনি এখনও গরুর পেছনে বেশি সময় দেন কিনা? আপনি না থাকলে আমাদের কী হবে? বাবা আপনি কেন এত অসুস্থ্য মাকে নিয়ে পাবলিক বাসে ঢাকায় আসতে গেলেন? আগে জানালে এখান থেকে গাড়ি পাঠিয়ে দিতাম। আপনাদের এত ভোগান্তি পোহাতে হতো না। বাবার কাছে বৌমার এন্তার অভিযোগ।

বাসায় গিয়ে ছেলের দেখা পেলেন না বাপুজিরা। সে তখনও স্টাফ কলেজে ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের ব্রিলিয়ান্ট মেজর ভাইটি স্টাফ কলেজে ডিফেন্স সাইন্সে মাস্টার্স করছে। তাই রাত দিন দম ফেলবার ফুরসৎ নেই তাঁর। রাতে বাসায় ফিরে বেশ কয়েকমাস পর বাবা মাকে একসাথে দেখে অতিশয় আনন্দিত যতোটা হলো; তার চেয়ে বেশি মন খারাপ করল। বাবা মা এতো কষ্ট করে দিনমান না খেয়ে না দেয়ে ঢাকার শহরে ঘুরেছে তাই।
বাপুজি কোনো কৈফিয়ত দিতে পারেন না।

ভেবেছিলাম তুমি ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত থাকো, বৌমা বেসরকারী ফার্মের কর্মব্যস্ততায় থাকবে। তাই তোমাদেরকে জানাতে চাইনি।
বাবা এটা কোনো কথা হলো। বাবা মায়ের কাছে সন্তানের কোনো ব্যস্ততা থাকতে আছে? আমাদের ভাই আর বৌটি একসাথে বলল। বাপুজি আর আম্মুর চোখে জল। আহা! এ জীবন সার্থক। এতোটা যত্ন, এতোটা ভালোবাসা। এ যে আশার চেয়েও বেশি। ওদের জন্য আশীর্বাদের ফেনিল শুভ্রতা উথলে উঠে বাপুজি ও আম্মুর মনের ঘরে ।

বাবা, তোমার মনে আছে, সেই যে ক্লাস সিক্সে পড়াকালীন জয়দেবপুরের সৃষ্টি বিদ্যানিকেতনে ক্যাডেট কোচিং করতাম। তুমি তোমার ৫ হাজার টাকা বেতনের ৩ হাজার টাকাই আমাকে দিয়ে আসতে। হল সুপারকে টাকা দিতে হতো আমি ছোট মাছ খেতে পারতাম না; তাই শিং মাছ কিনে খেতে হবে বলে। বাবা তুমি সময়ে অসময়ে অফিস শেষে ঢাকা থেকে ছুটে আসতে তোমার ছেলেকে দেখতে যাতে সে হোমসিক না হয়ে পড়ে। বাবাকে এক নিঃশ্বাসে বলে যাচ্ছিল আমাদের ভাইটি।
বাবা! মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে চান্স পেলে তুমি যে কী খুশি হয়েছিলে। মনে হয়েছিল আমাদের পরিবার, বাবা মায়ের অনিদ্রা, যৌথ শ্রম বা প্রত্যয় যেন সার্থক হলো। একদিন কলেজে যেতে লেট করেছিলাম বলে আমার সামনেই প্রিন্সিপাল স্যার তোমাকে কী যে অপমান করেছিল। আমি অষ্টম শ্রেণির ছোট্ট খোকাটি হয়েও তোমার জন্য খুব কষ্ট পেয়েছিলাম বাবা। আহা! আমার জন্য, আমার মানুষ হয়ে উঠবার জন্য তোমাকে কী অপমানই না সহ্য করতে হলো।
বাপুজি ও আম্মু শুনছেন। মাঝে মাঝে চোখ মুছছেন। এযে কৃতজ্ঞতা নয়, বাবা, মা ও সন্তানের সংসার যাত্রার মধুরতম স্মৃতি রোমন্থন।

বাবা! তোমার মনে থাকবার কথা, আমি এইসএসসির পর বুয়েটসহ দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলেও কেবলমাত্র আইএসএসবিতে গিয়েই প্রথমবার স্ক্রিন্ড আউট হলাম। তোমার সে কি মন খারাপ, কারণ তুমি মাঝারি মানের সরকারী চাকুরে হয়ে বরাবরই চেয়েছিলে ছেলে আর্মি অফিসার হবে। দ্বিতীয়বারে তোমার স্বপ্ন পূরণ ঠিকই করেছিলাম কিন্তু আমার জন্য এক সুপিরিয়রকে সুপারিশ করতে গিয়ে চরম অপমানিত হয়েছিলে তুমি। তোমাকে সারমেয় জাত তুলে গাল দিয়েছিল সেই সুপিরিয়র।

নারে বাবা! সন্তানের সুখ কামনায় হাজার গলা ধাক্কাতেও অপমান হতে নেই। এ এক মানবতার যুদ্ধ বটে। মনুষ্য ভবিষ্যত টিকিয়ে রাখবার ক্লিষ্টকর সংগ্রাম। লক্ষ অপমান সেখানে সব বাবারই গা সওয়া।
বাবার দার্শনিক কথায় ভাবনায় পড়ে আমাদের ভালো বৌমা ও তার যোগ্যতম বর।

আমাদের বাপুজি বরাবর অভিজাততন্ত্র এড়াতে চান। লিও তলস্তয়ের মতো তিনিও মনে করেন সভ্যতা মানেই দাসত্বের শৃঙ্খল। সমাজ নিজের প্রয়োজনে এসব শৃঙ্খল সৃষ্টি করে নিয়েছে। কাজেই তথাকথিত সভ্য সমাজ থেকেই যাবতীয় গরল উত্থিত হয়ে মনুষ্যত্বকে গ্রাস করেছে। এ সমাজ বেশকিছু মিথ্যা মূল্যবোধ দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে আছে। তাই মানুষের ভেতরকার খাঁটি ভালো গুণগুলো স্ফূরিত হতে পারছে না। সরল, সত্য ও সুন্দর হারাতে বসেছে সমাজ থেকে। তাই মর্যাদা বা ঐশ্বর্যের মেকি বাগাড়ম্বরতা সর্বদা এড়াতে চান বাপুজি।
কিন্তু বাপুজি অবাক হয়ে দেখলেন, ছেলের সংসারে ঐশ্বর্য বা মর্যাদা ঠিকই আছে তারপরও এখানকার মানুষেরা যেন খাঁটি সোনা।

আম্মু সেইরাত নির্ঘুম কাটালেন। অধ্যাপক ডাক্তার সাহেব গলার অসুস্থ্য গ্লান্ডটি টিপে দেখার পর অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। সেই থেকেই তিনি ব্যথায় ভুগছেন। সারারাত আমাদের এই বৌমাটি মাকে পাহারায় নিজেও নির্ঘুম রাত কাটালো। রাতে কয়েকবার গরম পানির ছ্যাকা, রসুন দিয়ে সরিষার তেল গরম করে মালিশকরাসহ নানাভাবে মায়ের উপশমের আয়োজন করল। এই পা টিপছে। এই মাথা টিপছে। আহা! ব্যথাটি যেনবা তারই নিজের। এমন সেবায় মা তার ব্যথার তীব্রতা ভুলে থাকবার চেষ্টা করলেন। ভাবনার ঘরে আলো জানালেন, হায় মানুষ এত ভালো কেমনে হয়? বৌমা যেন নিজের আত্মজার চেয়েও বেশি কিছু।

পুত্রের ব্যস্ততায় পরদিন অফিসে ফোন করে বৌমা ছুটি নিয়ে সারাদিন শাশুড়ি মাকে নিয়ে ছুটাছুটি করল। পরীক্ষার রিপোর্ট বের করা। সময়মতো ডাক্তারকে দেখানো। প্রয়োজনীয় ওষুধ কেনা। সবটা একা সামলাল বৌমা। এর ফাকে শ্বশুর শাশুড়িকে হাজীর বিরিয়ানি খাওয়ানো, সংসদ ভবন, লালবাগের কেল্লা, বুড়িগঙ্গা নদী, প্নানেটরিয়াম ঘুরিয়ে দেখানো সবই হলো। সবশেষে বসুন্ধরা সিটি শপিং সেন্টারে গিয়ে বিকালের নাস্তা। পরে বৌমার ইচ্ছায় বাপুজি আর আম্মুর পছন্দে পাঞ্জাবি ও শাড়ি শপিং। শেষে স্যামসাং আউটলেটে গিয়ে বাপুজির জন্য স্মার্ট ফোন। কারণ বাপুজি আজকাল ফেসবুকে টুইটারে তাঁর দিনপঞ্জি লিখতে ভালোবাসেন। আমাদের বাপুজি ও আম্মু বাধ্য ছেলে মেয়ের মতো ভালো বৌমার নির্দেশ মান্য করে গেলেন।

মঙ্গলবার সকালে বনানী স্টেশনে নিজে গিয়ে আমাদের বৌমা একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রাইভেট কারে উঠিয়ে দিল বাবা মাকে। বারবার বলতে থাকল, বাবা, মা খুব অসুস্থ্য আমার সাথে যাওয়াটা খুব উচিত ছিল, কিন্তু অফিসের কাজে যেতে পারলাম না। মাফ করবেন বাবা। সাবধানে যাবেন। বাড়ি পৌছেই ফোন দেবেন। শেষবেলায় বৌ শাশুড়িতে বিগ হাগ হলো। যেনবা জন্ম জন্মান্তরের বন্ধন; কখনও শেষ হবার নয়।
এ অবস্থায় বাপুজি ও আম্মুর চোখে যেন ময়লা পড়ে? দুইজনেই একসাথে টিস্যুতে চোখ মুছেন।

বাপুজি ও আম্মু গ্রামের বাড়ি ফিরে সেই যে বৌমার গল্প করে বেড়াচ্ছেন। সেখানে পৃথিবীর তাবৎ গল্পই পুরো পরাস্ত। আমার বাপুজি বৌমা সম্বন্ধে সাত খন্ড রামায়ণ কাব্য বর্ণনা করতে লাগলেন। হাটে, মাঠে ও ঘাটে। আমাদের বৌমাটি ঢাকায় মানুষ। এক বড় অভিজাত পরিবারে জন্ম। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ ডিগ্রিধারী। কৃত্রিম সাজগোজ ছাড়াই দেখতে অনিন্দ্য সুদর্শনা। ভালো রবীন্দ্র সঙ্গীতও গায়। কিন্তু আচরণে মাটির মানুষ। কী উদার! কাজের মানুষের সাথে কী অমৃত ব্যবহার! ওরা যেন নিজের পরিবারেরই কেউ একজন। বৌমার পা সবসময় মাটিতে থাকে। কী অসাধারণ কেয়ারিং সবার প্রতি। সংসার সন্তান সামলিয়েও আবার নিজের অফিস সামলানো। কথা বলে মেপে মেপে বুদ্ধিদীপ্তভাবে। বিনয়ের অবতার যেন এই বৌমাটি। এতোটুকু অহংবোধ নেই নিজের মধ্যে। সাজপোশাকে অনাড়ম্বর; কিন্তু ব্যক্তিত্বে ষোলআনা পারফেক্ট। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত আমাদের বৌমাকে নিয়েই লিখেছেন,
আপনাকে বড় বলে বড় সে নয়,
লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়।

কামিনী রায়ের সুখ কবিতাটাও বুঝি আমার বৌমাকে নিয়ে লেখা,
আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবনী 'পরে,
সকলের তরে সকলে আমরা,
প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।

কঠিন বাস্তবের ঢাকা শহরে অন্যের খোঁজখবর নেয়ার মত মানুষের সংখ্যা নেই বললেই চলে। তবে আমাদের বৌমা ঠিক ব্যতিক্রম বটে। ঢাকা শহরে থাকা তাঁর নিজের বাবা মা ভাইয়ের দেখভাল করেও যেভাবে অন্যের বিপদে এগিয়ে যায়, তাতো আজকাল দেখাই যায় না। সমাজ সংসারে বৌ শাশুড়ির ঝগড়ার বিস্তর কেচ্ছা কাহিনী জানা যায়। কিন্তু আমাদের এই বৌমার মুখের দিকে যতবার তাকানো যায়, ঠিক ততবারই মনে হয়, একজন ভাল মানুষ কি করে হতে হয়, তার কাছ থেকেই শেখা উচিৎ। এই বৌমার ব্যতিক্রম ভালোবাসা, উদারতা বা মহানুভবতা নিয়েইতো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গীতাঞ্জলিতে বলেছেন,
আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার
চরণধুলার তলে ।
সকল অহংকার হে আমার
ডুবাও চোখের জলে ।

আমাদের এই সুদর্শনা বৌমাটি সাত সকালে হারমোনিয়ামে সুর তোলে,
অন্তর মম বিকশিত করো
অন্তরতর হে।
নির্মল করো, উজ্জ্বল করো,
সুন্দর কর হে।
বাপুজির মতো শ্রোতার মনোবীণায় তখন স্বয়ং রবি কবি গেয়ে উঠেন
তুমি কেমন করে গান কর যে গুণী ,
অবাক হয়ে শুনি , কেবল শুনি ।

বাপুজির প্রিয় বৌমা উপাখ্যান বর্ণনা মাঝে সেদিন তাঁকে একালের দুজন ভালো মানুষের গল্প শুনালাম।
এক বিত্তহীন উদারচিত্তের লোক চীনের বেই ফ্যাংলি। ১৯৮৭ সালে বয়স যখন ৭৪, রিকশা চালানোর কষ্টদায়ক পেশা ছাড়তে বাধ্য হন ফ্যাংলি। তেইজিন শহর ছেড়ে ফিরে আসেন নিজ শহরে। এখানে এসে দেখতে পান অনেক শিশু স্কুলের খরচ যোগাতে না পেরে মাঠে কাজ করছে। এ ঘটনা তার হৃদয়ে প্রবল নাড়া দিলো। ৭৪ বছর বয়সেই আবার ধরলেন রিকশা। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা রিকশা চালিয়ে যা পেতেন সেখান থেকে কোনোমতে খেয়ে পরে প্রায় সব টাকাই খরচ করে দিলেন তিয়ানজিন ইয়াওহোয়া মিডল স্কুলের ৩০০ দরিদ্র শিশুর লেখাপড়ার জন্যে। ওরা স্কুলে পড়তে পারছে এতেই তৃপ্তি এ বৃদ্ধের। ২০০১ সালে বয়স যখন ৯০, শেষবারের মতো তিনি টাকা নিয়ে গেলেন। বললেন, আর পারছি না রে। সব শক্তি শেষ। স্কুলের শিক্ষার্থী আর শিক্ষকরা চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না। এই ১৭ বছরে স্কুলের ওই শিক্ষার্থীদের জন্যে ফ্যাংলি দিয়েছিলেন সর্বমোট ৩ লাখ ৫৪ হাজার ইউয়ান যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪৩ লাখ ৮৭ হাজার ৮০৪ টাকা।

অপরদিকে রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে একটি সাধারণ অভিযোগ, 'ক্ষমতায় পা রাখতে না রাখতেই বিলাসে গা ভাসিয়ে দেন তারা।' তবে সবাইকে যে এক পাল্লায় মাপা যায় না তারই প্রমাণ হচ্ছেন উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট হোসে মুজিকা। প্রেসিডেন্টের জন্য বরাদ্দ করা বিলাসবহুল বাসভবন ছেড়ে তিনি বাস করেন রাজধানীর মন্টিভিডিওর বাইরের স্ত্রীর মালিকানা সূত্রে পাওয়া একটি জীর্ণ খামারবাড়িতে। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে প্রাপ্ত বেতনের ৯০ ভাগই তিনি দান করেন দেশের সামাজিক সেবামূলক বিভিন্ন কার্যক্রমে। সাইকেল চালিয়ে গিয়ে অফিস করেন তিনি। তবে বেশিরভাগ অর্থ দান করে দেয়ার পর তার মাসিক ১২ হাজার ডলার বেতনের মধ্যে অবশিষ্ট থাকে কমবেশি ৭৭৫ ডলার। আর এই অর্থ দিয়েই তিনি নিজের এবং পরিবারের জীবিকা নির্বাহ করেন। এজন্যই তাকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে 'গরিব' প্রেসিডেন্ট। তাঁর এ দারিদ্র্য সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, 'আমাকে বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র প্রেসিডেন্ট বলা হয়। কিন্তু আমি নিজেকে দরিদ্র মনে করি না। যারা বিলাসবহুল জীবনযাপন করে, যাদের চাহিদার কোনো শেষ নেই, আসলে তারাই দরিদ্র।'

আমি বাপুজিকে বললাম, ফ্যাংলি বা মুজিকার চেয়েও কী আপনার বৌমা বেশি ভালো মানুষ? বাপুজি উৎফুল্ল হয়ে বললেন, জানিনা। তবে শেষ যেদিন ওদের সেনানিবাসের বাসায় ছিলাম, সেদিন আমার হৃৎপিণ্ডের প্রোব্লেমের কথা বলেছিলাম। বৌমা সহাস্যে বলেছিল, আমার হৃদয়টা বাবাকে দিয়ে দেব। বাবার মধ্যেই না হয় আমি বেঁচে থাকব।
বাপু, এমন মানুষের অন্তরেই বুঝি ঈশ্বর থাকেন। আমাকে বললেন বাপুজি।

আমি বাপুজিকে কোনো উত্তর দিলাম না। কেবল মিস্টিক কবি লালন ফকিরের সেই মানবিক গানটাই অস্ফুটে গলার সুরে অনুরণন তুলল যেন।
মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।

ফারদিন ফেরদৌসঃ লেখক ও সাংবাদিক
১১ জুন ২০১৫
facebook.com/fardeen.ferdous
twitter.com/fardeenferdous