বিভীষণ বিভীষিকা অথবা ভীষণ বিভীষণ

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 18 July 2015, 09:04 AM
Updated : 18 July 2015, 09:04 AM

অত্যধিক অমোঘ ব্যক্তিত্ব ব্যাধি (Obsessive–compulsive personality disorder) একটি স্নায়বিক রোগ ডাক্তার মাত্রই তা জানেন। এই রোগ হলে রোগীর সার্বক্ষনিক অনাকাঙ্ক্ষিত, অবাঞ্ছিত ও পীড়াদায়ক চিন্তা মাথার মধ্যে আসে। এই অনাকাঙ্ক্ষিত চিন্তার জন্য রোগীর মনে অস্বস্তি, আশঙ্কা, ভয় অথবা বিষণ্ণতা সৃষ্টি হয়। অনেক  সময় বিষণ্ণতা থেকে সাময়িক মুক্তির জন্য রোগী এক কাজ বার বার করে থাকে। এর ফলে অনেক সময় অবসেশন ও কম্পালসন দুটোই সৃষ্টি হয়। বার বার কোন কিছু পরীক্ষা করা, একই কথা বারবার বলা এ রোগের লক্ষ্মণ। মূলত, অত্যধিক অমোঘ ব্যক্তিত্ব ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীদের কাজকর্ম একধরণের মানসিক বৈকল্য ও স্নায়বিক বিকারগ্রস্ত। রোগীরা রোগের অযৌক্তিকতা বুঝতে পারে এবং তারা প্রায়ই এই বাস্তবতা উপলব্ধি করে মানসিক যন্ত্রণায় ভোগে। সাধারণতঃ কোন দেশের মোট জনসংখ্যার এক ভাগ লোক এই মনোবৈকল্য রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে কীজানি কী কারণে আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের শতভাগই এই রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে।

অবসেশনে আক্রান্ত হয়ে আমাদের পলিটিশানরা এক কাজ বারবার করার সূত্র মেনে একে অপরকে ঘায়েল করতে উপর্যুপরি বিভীষণ পয়দা করার কারখানা খুলে বসেছে। এসব বিভীষণদের ক্যাটাগরিটাও বিচিত্র। কেউ খ্যাতিমানের কন্যা, কেউ মুক্তিযুদ্ধের আধা অধিনায়ক, কেউ সাতঘাটের জল খাওয়া আইনজীবি আবার কেউবা মন্ত্রী উপদেষ্টা। বাল্মীকি রামায়ণ মতে পুরাকালে রাবণের কণিষ্ঠ ভ্রাতা ও রাম রাবণের যুদ্ধে স্বপক্ষ ত্যাগকারী রামের ভক্ত হলেন বিভীষণ। তবে সেকালে নিজভ্রাতা রাবণকে শায়েস্তা করতে বিভীষণ মোটের উপর একজনই ছিলেন। পুরাকালে এখনকার মতো মহামারী আকারে অবসেসিভ ডিসর্ডারটা ছিল না যে।

আমাদের কালে রাজনীতির মাঠকে বিভীষিকায় মাখামাখি করতে আজকের লন্ডন শহরের বিলাসবহুল এলাকা সারের কিংসটনেই নাকি বিভীষণ তৈরির বিশাল কারখানা গড়ে উঠেছে, দুর্মুখোরা এমনটাই দাবি করেন। সেখানেই বিভীষণ কারিগর ও বীর পুরুষ তারেক রহমান লুকিয়ে থাকেন যে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য রফিকুল ইসলাম মিয়া যেমনটা বলেছেন, তারেক রহমান গতানুগতিক রাজনীতিক নন। তাঁর মধ্যে 'স্টেটসম্যান' হওয়ার যোগ্যতা আছে। একদিন সে সুযোগ আসবে। তারেক রহমান এখন দেশের বাইরে পড়াশোনা করছেন। দেশ নিয়ে ভাবছেন। মানুষের অধিকার কীভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়, তা নিয়ে ভাবছেন। সুস্থ হলেই তিনি দেশে ফিরে আসবেন। রফিকুল ইসলাম মিয়ার গলায় সুর মিলিয়ে বলা যায়, তারেক রহমান এখন মনোবৈকল্য রোগে অসুস্থ্য আছেন, তাই দেদারছে বিভীষণ পয়দা করে চলেছেন। সুস্থ হয়ে দেশে ফিরলে এমনটা নাও করতে পারেন।

এবার লন্ডনজাত বিভীষণদের চায় চেহারা একে একে দেখে আসা যাক। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমামকে নিজেদের লোক বলে দাবি করেছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান। গেল ২২ নভেম্বর শনিবার দুপুরে এক আলোচনায় মারুফ কামাল এ কথা বলেন। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের জন্মদিন উপলক্ষে স্বেচ্ছাসেবক দল রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ওই আলোচনার আয়োজন করে। আলোচনা সভায় মারুফ কামাল খান দাবি করেন, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম তাঁদের লোক। বিএনপির বাইরে বিএনপির এমন আরও বিভীষণ শ্রেণির লোক আছেন। তাঁরা সত্য বলতে শুরু করেছেন। এইচ টি ইমামের গায়ে হাত না দিতেও তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। সোজাসাপ্টা কথা হলো এসব বিভীষণদের বিরুদ্ধে কোনো পক্ষেরই গায়ে হাত তোলা মানা।

মানুষ ভুলের উর্ধ্বে নয়, কিন্তু বাঙালি মাত্রই সেসব ভুলের সমালোচনার মুখে ভয়ংকর ভীতু। বঙ্গবন্ধুর ঘণিষ্ঠ সহচর তাজউদ্দিন কন্যা শারমিন আহমদ 'নেতা ও পিতা' এবং মুক্তিযুদ্ধের উপঅধিনায়ক একে খন্দকার '১৯৭১: ভিতরে বাইরে' বই লিখে কী সুন্দর প্রতিপক্ষের বিভীষণ অস্ত্রে পরিণত হয়ে গেলেন। এসবই বুঝি লন্ডনি কারখানা উৎসারিত বিভীষণ ম্যাজিক। মুখখোড়া মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীও মারাত্মক অবসেশনে ভুগছিলেন। অবচেতনে যেইনা বড়দের সমালোচনায় মুখর হলেন, অমনি মহা বিভীষণে পরিণত হয়ে গেলেন। সমালোচনা বড়, কিন্তু দেশের সম্পদ লুন্ঠণকারীর খাতায় তাঁর নাম লেখা থাকল না।

এসব বিভীষণ বিভীষিকায় এমনতর প্রচুর অ্যাবস্ট্রাক্ট কেচ্ছা কাহিনীই রয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডিগবাজ ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ 'কারাগারে কেমন ছিলাম ২০০৭-০৮' নামে নিজের একখানা আত্মকথন রচনা করলেন। সেখানে ম্যাডাম জিয়ার রাজনৈতিক কৌশলগত ভুল ভ্রান্তি নিয়ে সরস আলোচনা আছে। আর যাবেন কোথায়, আওয়ামীলীগের মাহবুবুল আলম হানিফ গংরা দাবি করে বসলেন মওদুদ বিভীষণ যে তাঁদেরই মহাআবিষ্কার। মারুফ কামাল খানের মতো করে হানিফ গংরা মওদুদের গায়ে হাত না তোলার হুমকি না দিলেও ম্যাডাম জিয়া মওদুদ বিভীষণের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। বিভীষণদের প্রতি ক্ষমাশীল হতে হয় এমন শিক্ষাটা হয়ত খালেদা ম্যাডাম প্রেসিডেন্ট জিয়া কর্তৃক একাত্তরের রাজাকার বিভীষণদের প্রতি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিকোণ থেকে পেয়ে থাকতে পারেন।

বিভীষণ কেচ্ছায় সবশেষে একটি সত্যি ঘটনা। ২০১৩ সালে ০৩ ডিসেম্বর বিভীষণগিরির অভিযোগে উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উনের প্রভাবশালী 'ফুফা' চ্যাং সং থায়েকের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। আমাদের দেশে অবশ্য এমনটা হবার জো নাই। এখানকার বিরাটকায় বিভীষণরা আত্মকথনজাত বই উদগীরন করে মাল কড়িসমেত যারপরনাই খ্যাতিমান হয়ে উঠেন।
এবার দেশের সবচেয়ে বড়, ঐতিহাসিক ও গৌরবময় বিভীষণনামা পুস্তকখানা লন্ডন থেকে প্রকাশের অপেক্ষায় থাকা যাক। বিভীষণ পুস্তকের অন্ধকারচ্ছটায় ভীষণ বিভীষিকাময় হয়ে উঠুক আমাদের রাজসিক রাজনৈতিক জীবন।

ফারদিন ফেরদৌসঃ লেখক ও সাংবাদিক
২৩ নভেম্বর ২০১৪
https://www.facebook.com/fardeen.ferdous
https://twitter.com/fardeenferdous