রুল অব ইগনোর‍্যান্ট…

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 25 July 2015, 06:08 PM
Updated : 25 July 2015, 06:08 PM


গণতন্ত্রের সাথে মহান ঈশ্বরের সবচেয়ে বড় যোগাযোগ চিরকাল ছিল এবং আছে। পৃথিবীর সব ধর্মের ঈশ্বররাই অন্য সব ধর্মের মানুষজনদেরও দেখে শুনে রাখেন, খাওয়ান, ঘুম পাড়ান, প্রেম প্রীতি, বাচ্চা উৎপাদনের লাইসেন্সসহ জীবন ও মৃত্যু উপহার দেন। তাই রব, প্রভু, গড ও ভগবানরাই যে সবচে বেশি গণতান্ত্রিক তা না বললেও বুঝে নেওয়া যায়।

ঈশ্বরের রাজ্য মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির সবচেয়ে শানদার গ্রহ নীল পৃথিবীতে খ্রীস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীতে গণতন্ত্র নিয়ে চিন্তাশীল পাশ্চাত্য পন্ডিত প্লেটো, এ্যারিস্টটল এবং বিংশ শতাব্দীর প্রাচ্য পন্ডিত মহাত্মা গান্দীজী প্রয়াত হওয়ার পর তাদের তিনজনকেই লাল গ্রহ মঙ্গলে স্থান দিয়েছেন মহান সেই ঈশ্বর। পৃথিবীর এতো মঙ্গলামঙ্গলের সাথে জড়িত ছিলেন যারা, মঙ্গল ছাড়া আসলে তাদের অন্য কোথাও থাকা মানায় না। সেখানে পলিটিক্যাল থট নিয়ে অন্যান্য যারা এ যাবৎ কাজ করে দেহাতীত আত্মাপ্রাপ্ত হয়েছেন তেমন বেশ কয়েকজন পন্ডিতেরও স্থান হয়েছে। মঙ্গলে পানি নেই। না থাকুক, মৃতদের পানির প্রয়োজনও নেই। ওই পন্ডিতদেরকে জীবৎকালে পৃথিবীতে দেশ, রাজা, রাজত্ব ও জনগণ নিয়ে ভাবনার প্রভূত সুযোগ করে দিয়েছিলেন ঈশ্বর। এখনও মঙ্গলে ঈশ্বর তাদের ভাবনার সুযোগ দেন এবং নিজেও তাদের পান্ডিত্য নিয়ে খুবই ভাবেন এবং ভাব দেখান এই বলে যে, দেখরে কি মনুষ্যই না আমি সৃষ্টি করেছিলাম!

প্রাচীন গ্রীক রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তায় স্বাধীনতা, সাম্য ও সমানাধিকারের দাবির ভিত্তিতে যে গণতান্ত্রিক ধারণার উৎপত্তি, তা বিংশ শতাব্দীতে গান্ধীজীর মধ্য দিয়ে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রতত্ত্বের বৃহত্তর ও মহান আদর্শে পরিণত হয়েছে। প্লেটো এ্যারিস্টটল ও গান্ধীজীরা ওই ভাবধারা নিয়ে সমূহ চিন্তা করেছেন। ইদানিং সেই আদর্শ গণতন্ত্র নিয়ে প্রাচ্যের বঙ্গভূমে বিপুল টানাহেচড়ায় স্বয়ং ভগবানেরও টনক নড়েছে। নানা জটিলতা আর ঘূর্ণাবর্তে পড়া বাংলাদেশের দিকে মহান রব এবার একটু মনোযোগ দিতে চান।
গান্ধীজী, প্লেটো ও এ্যারিস্টটলের কাছে প্রভু জানতে চাইলেন বাংলাদেশে আসলে কোন ধরণের গণতন্ত্র চলছে। যদি গণতন্ত্র হয়, তাহলে সেটা কতোটা জনহিতকর বা অহিতকর?

প্লেটো ও এ্যারিস্টটল জানালেন, গণতন্ত্র হলো পলিটি'র বিকৃত রূপ। জনতার শাসন ব্যবস্থা বা জনতাতন্ত্র গণতন্ত্র হিসেবে প্রচলিত হয়েছে। আমরা গণতন্ত্রকে আদর্শ শাসন ব্যবস্থা হিসেবেই দেখেছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে সার্বিক অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, গণতন্ত্র একটা নিকৃষ্ট শাসন ব্যবস্থা।
নিকৃষ্ট! বিস্মিত হলেন প্রভু। প্লেটো ও এ্যারি সেই নিকৃষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে তোমরা 'দি রিপাবলিক' ও 'দি পলিটিক্স' নামে বই লিখে ফেললে। অবাক হলাম।

আমরাও অবাক হচ্ছি প্রভু। সেই নিকৃষ্ট শাসন ব্যবস্থা গণতন্ত্রকেই আধুনিক যুগের মানুষেরা উদারনৈতিক গণতন্ত্র নাম দিয়ে সর্বোচ্চ মর্যাদায় আসীন করেছে। আমেরিকা বা ভারতবর্ষের কথা বলব না। প্রভু ভালো করে দূরবীন দিয়ে বাংলাদেশের দিকে তাকান, দেখবেন আমাদের কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলছে বাংলাদেশে। আমরা সার্থক।
বুঝিয়ে বলো। বললেন ঈশ্বর।

আমি আমার প্লেটো'স এ্যাকাডেমিতে শিক্ষার্থীদের একটা কথাই বারবার শিখিয়েছি। গণতন্ত্র হচ্ছে সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট প্রকৃতির সরকার। গণতন্ত্র অপেক্ষাকৃত অধিক পরিমাণে অজ্ঞ ও স্বার্থপর। গণতন্ত্রের প্রতি আমার চরম বিদ্বেষভাব, কারণ এটা মুর্খের শাসন। বললেন প্লেটো।
বাংলাদেশে জনগণকে নিয়ে ক্ষমতাবানরা যেমন খুশি নাস্তানাবুদ করতে পারছে। জনতা সেখানে একমাত্র খেলার ঘুটি। জনতাকে শাসন ও শোষণ করবার জন্য বাংলাদেশ আদর্শ স্থান। সন্দেহাতীতভাবে বলা যায় বাংলাদেশে গণতন্ত্রের নামে চরম মুর্খদের শাসন চলছে। তাই আমাদের সমস্ত বিদ্যা বুদ্ধির প্র্যাকটিক্যাল সূতিকাগার হলো বাংলাদেশ, একথা জোর গলায় বলতে পারি। যোগ করলেন প্লেটো।

এবার এ্যারিস্টটল মুখ খুললেন। আমি আমার লাইসিয়ামে শিষ্যদের শিখিয়েছি যে, গণতন্ত্র বিকৃত এবং নিকৃষ্টতম সরকার। আমার গুরু প্লেটোর সাথে অনেক বিষয় নিয়ে আমার দ্বিমত রয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্র বিষয়ে আমরা একমত। প্রভু আমার কথা শোনবার আপনার কোন দরকার নেই। কেবল বর্তমান বাংলাদেশের দিকে তাকান আমার কথার চেয়েও বেশি প্রমাণ আপনি নগদে পাবেন। বাংলাদেশের বর্তমান গণতন্ত্রের নমুণা দেখে আমরা রীতিমতো লজ্জায় পড়ে যাচ্ছি। আমাদের প্রাচীন গ্রীসের ঐতিহাসিক থুসাইডিডেস ও হেরোডোটাস কোন দু:খে যে, এই গণতন্ত্র শব্দবন্ধ আবিষ্কার করেছিলেন? প্রভু আপনি সব জানেন!

গান্ধীজী দীর্ঘক্ষন চুপ মেরে ছিলেন। এবার কিছু কথা না বললে ব্যাপারটা অতিরিক্ত কৃচ্ছতা সাধন পর্যায়ে চলে যাবে। ভগবান কি আর বলব। আমি চেয়েছিলাম প্লেটো আর এ্যারিস্টটলের জোর প্রতিবাদ করব আমি। কিন্তু সব কেমন যেন মিলে যাচ্ছে। গণতন্ত্রে এভাবেই বুঝি সব মিলে যায়। আমি জীবনভর 'সর্বোদয়' ধারণার মাধ্যমে অহিংস সংগ্রাম ও সত্যাগ্রহের কথা বলে এসেছি। পরার্থে আত্মত্যাগ সর্বোদয়ের মূল আদর্শ। আত্মসুখের পরিবর্তে অপরের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বিধানই হবে প্রত্যেকের আদর্শ। অপরের স্বার্থে দান করে যাব, গ্রহণ করব না। দেখুন প্রভু আমার কথা বাংলাদেশে কি সুন্দর ফলে যাচ্ছে। মনির, মিলন ও নজরুলরা রাজরাজরার স্বার্থে আগুনে ঝলসে দেদার জীবন দিচ্ছে । রহিমা বা রহমানরা পরার্থে চোখ বিলিয়ে দিচ্ছে। আদুরীরা জীবনমৃত হয়ে ডাস্টবিনে পড়ে থাকলেও কি সুন্দর নিশ্চুপ থাকে। হরতাল অভিশাপেও বীর জনতা চরম ধৈর্য্যের পরাকাষ্ঠা দেখায়। আমার সর্বোদয় তত্ত্ব বাংলাদেশে চরম সার্থক হে ভগবান।
তার মানে তোমরা বলছ, তোমাদের গণতন্ত্র তত্ত্ব বঙ্গভূমে ভীষণ জনহিতকর বটে।

না না না প্রভু তাই কি বলেছি? গণতন্ত্র বড় ফলবান বাংলাদেশে। হিত অহিত আপনি দেখবেন। চাইলে দেশের গণতন্ত্রের প্রধান দুই নারী প্রতিভূ শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার সাথে আপনি সরাসরি যোগাযোগ করে দেখতে পারেন। বললেন প্লেটো।
গণতন্ত্রে মানুষ সবকিছুই করতে চায় কিন্তু আসলে কিছুই করতে সক্ষম হয় না। দেখুন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সর্বদলীয় সরকারের দাওয়াত দিয়েও বিরোধী নেতাকে দাওয়াত কবুল করাতে পারলেন না। অন্যদিকে বিরোধী নেতাও তত্ত্বাবধায়ক চেয়েও কাউকে মনের কথা বুঝাতেই পারলেন না। এদিকে জনগণও নানা কারণে বারবার ফুঁসে উঠতে চায়, কিন্তু পারে না। তিন হাজার বছর আগে বলে যাওয়া আমার কথার এমন মিল দেখে আনন্দই হচ্ছে ঈশ্বর। যোগ করলেন প্লেটো।
এসময় এ্যারিস্টটল মনে করলেন তাঁর পাশে বসা সতীর্থ পন্ডিত ক্লিওনের কথা। গণতন্ত্র নিয়ে তোমার বিখ্যাত কথাটা প্রভুকে শুনিয়ে দাও।
ক্লিওন বললেন, গণতন্ত্র হলো জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণের শাসন। তিনহাজার বছর পরে আমার এই বক্তব্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন মেরে দিয়ে বিখ্যাত হলেন আর আমি আড়ালেই রয়ে গেলাম। এটাও গণতন্ত্রের একধরণের ধর্ম। এখানে চুরি চামারি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। বাংলাদেশে দেখেন টাকা আবুলেও চুরি করে, তারেকও চুরি করে। কেউ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান।
প্লেটোর পাশে বসা লাস্কিকে কিছু বলতে বললেন এ্যারিস্টটল।Political democracy is meaningless without economic democracy – অর্থনৈতিক গণতন্ত্র ব্যতিরেকে রাজনৈতিক গণতন্ত্র অর্থহীন। বললেন অধ্যাপক লাস্কি।

আমি আগেই বলেছিলাম গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা হচ্ছে অরাজকতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আর যেখানে অর্থের গণতন্ত্র থাকবে, সেখানে অরাজকতা আরও প্রকট হবে এ কথা বলাই বাহুল্য। বললেন প্লেটো।
২৩ কোটি বিলিয়ন ডলার এখন বাংলাদেশের রিজার্ভ। সেই অর্থ নিয়েই চলছে টানাটানি দলাদলি ও হাড়হাড্ডি লড়াই। আামাদের গণতন্ত্র ফর্মুলা আরও সার্থক। হে বঙ্গ নেতাবৃন্দ! তোমাদেরকে মঙ্গলীয় সালাম। যোগ করলেন প্লেটো।
ম্যাকিয়াভেলির সাথে আমি বরাবর দ্বিমত পোষণ করে এসেছি, তার কথাও ঈশ্বর শুনতে পারেন। বললেন গান্ধীজী।
রাষ্ট্রের মূল বিষয় ক্ষমতা। ক্ষমতা অর্জন ও সংরক্ষন করবার জন্য যে কোন ধরণের কলা কৌশল, ছলচাতুরী, ন্যায় অন্যায়, প্রতারণা ও ছলনা অবলম্বন করা শাসকের জন্য বৈধ। রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব, নিরাপত্তা, সম্প্রসারণ ও সংরক্ষনের জন্য পরাক্রমশালী শাসকের প্রয়োজন- যিনি হবেন সিংহের মতো বলশালী ও শৃগালের মতো ধূর্ত। বললেন ম্যাকিয়াভেলি।

হাহাহাহ মিলে গেল। বাংলাদেশের দুই বিবদমান নেতাই নিজেদেরকে মহা ধূর্ত বলে দাবি ও প্রমাণ করবার চেষ্টা করেন। বললেন এ্যারিস্টটল।
এবারের হরতাল আন্দোলন শেষ হওয়ার আগের দিন ঈশ্বর দূত নভোযান ডিসকভারির সিগন্যাল ব্যবহার করে আলাদা আলাদা ভাবে সজীব ওয়াজেদ জয় ও তারেক রহমানের সাথে স্কাইপে কথা বললেন, তাদের মাদারস অর্গানাইজেশনের চেয়ারপার্সনদের সাথে মহান প্রভুর টেলি কনফারেন্স করিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তারা ভেটু দিলেন। আমরা এখানে ঈশ্বরের শাসন চালাই না। ঈশ্বরের সাথে কিসের আলাপ আমরা ঠিক ধরতে পারছি না। আমাদের দেশ মহাগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ।
অগত্যা ঈশ্বর দূত সরাসরি শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার সাথে থ্রিজি নেট ব্যবহার করে ভিডিও কনফারেন্সে মহান ঈশ্বর ও তাঁর মঙ্গলীয় সতীর্থদের সাথে মিলিয়ে দিলেন।
ঈশ্বরের প্রথম প্রশ্ন শেখ হাসিনার কাছে। আসলে আপনারা কতোটা গণতান্ত্রিক?
জ্বী। আমরা আসলে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক। যখন যেমন খুশি তেমন সাজতে পারি।
আমার সতীর্থরা বলছিলেন, আপনি নাকি তাদের বচনবাণী অক্ষরে অক্ষরে কখনো কখনো তারও বেশি মেনে চলছেন। প্রশ্ন করলেন ঈশ্বর।
আমি কারো কথায় কান দেই না। আমি নিজের পথে ও নিজের মতেই চলি। দৃঢ়ভাবে বললেন শেখ হাসিনা।

আমার এবারকার প্রশ্ন ম্যাডাম খালেদা জিয়ার কাছে। আমার চারপাশে প্লেটো, এ্যারিস্টটল ও গান্ধীজীসহ অন্য সতীর্থরা বসে আছেন। আপনি নিশ্চয় এদের ভালো করে চেনেন।
প্লেটো আর কি কি যেন নাম বললেন, তা উনারা কারা? সবিস্ময়ে উল্টো প্রশ্ন করলেন খালেদা জিয়া।
ঈশ্বর সতীর্থদের মধ্যে পান্ডিত্যপূর্ণ হাসির রোল। হাসতে হাসতে বড় পন্ডিত প্লেটো ঈশ্বরকে উদ্দেশ্য করে বললেন।
হা ঈশ্বর! আমি আগেই বলেছিলাম। গণতন্ত্র মানে-
Rule of Ignorant …!

ফারদিন ফেরদৌসঃ লেখক ও সাংবাদিক
২৬ জুলাই ২০১৫
https://www.facebook.com/fardeen.ferdous
https://twitter.com/fardeenferdous