ইতিহাসে ছিটমহলঃ এ আমারই প্রিয় বাংলাদেশ

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 1 August 2015, 03:10 AM
Updated : 1 August 2015, 03:10 AM

নো ম্যানস ল্যান্ড বা না-মানুষি জমিনের মানুষ ও ভূ-প্রকৃতির বেদনাগাঁথা নিয়ে ক্লাসিক মুভি নির্মাণ বা শিল্প সাহিত্য রচিত হয়েছে নানা সময়ে।
মানবিক বোধসম্পন্ন লেখক বা পরিচালকের দরদে সেইসব মহাকাব্যিক শিল্পকর্মে উঠে এসেছে
ভূমি পরিচয়বিহীন মানবের অসহনীয় দুঃখ দুর্দশার বাস্তবানুগ গল্প।

বসনিয়ান লেখক ও পরিচালক ডেনিস তানোভিকের বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা যুদ্ধের ওপর নির্মিত ২০০১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'নো ম্যানস ল্যান্ড' শিরোনামে বসনিয়ান ছবিটির সাথে অল্প বিস্তর সবার পরিচয় আছে। যুদ্ধকালে ফ্রন্টলাইনে নো ম্যানস ল্যান্ডে এক পরিত্যক্ত ট্রেঞ্চে আহত অবস্থায় আটকা পড়ে বসনিয়ান চিকি ও সার্বিয়ান নিনো। ঐ ট্রেঞ্চেই একটি তাজা মাইন এর ওপরে আটকা পড়ে চিকির বসনিয়ান বন্ধু ছেরা। ইইউ'র তৈরী মাইনটা একটু অন্যরকম, চাপ পড়লে মাইনটা এক্টিভেট হয়, কিন্ত সঙ্গে সঙ্গে ফাটে না। মাইনটা ফাটবে চাপটা সরে যাওয়ার সাথে সাথে, মানে যে আহত লোকটা মাইনের ওপরে পড়েছে, সে যদি সরে যাওয়ার চেষ্টা করে তবে। ঘটনার টানাপোড়েনে রাগে ক্ষোভে চিকি নিনোকে মেরে ফেলে আর শান্তিরক্ষী বাহিনীর হাতে মারা যায় চিকি। কিন্তু মাইনের ওপর পড়ে থাকে চিকির বসনিয়ান বন্ধু সেই লোকটা। একসময় নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী মাইনের ওপরে পড়ে থাকা লোকটাকে উদ্ধার করা হয়েছে বলে প্রচারণা চালানোর পর মিডিয়া, শান্তিরক্ষী বাহিনী, কমান্ডার সবাই সন্ধ্যার দিকে জায়গাটা ছেড়ে চলে গেলে শুধু আহত মানুষটা একাকী পরে থাকে নো ম্যানস ল্যান্ডে তাজা মাইন এর ওপর, মৃত্যুর অপেক্ষায়।

অন্যদিকে আমাদের দেশের আনিসুল হকের উপন্যাস না-মানুষি জমিনের গল্পে দেখা যায়, একদল নারী-পুরুষ আর শিশুকে ধরে আনা হয়েছে সীমান্তে, তাদের ঠেলে দেওয়া হবে ওই পারে। সুযোগ বুঝে গভীর রাতে সীমান্তের রক্ষীরা তাদের ঠেলে দিল নো-ম্যানস ল্যান্ড বা না-মানুষি জমিনে। কিন্তু ওপারের সীমান্তরক্ষীরাও প্রস্তুত। কাউকে তারা তাদের পারে ঢুকতে দিল না, রুখে দাঁড়াল সিঙন উঁচিয়ে।
তীব্র শীত আর কুয়াশার মধ্যে খোলা আকাশের নিচে আটকে পড়ে রইল একদল মানবসন্তান। নানা বয়সী নারী-পুরুষের মধ্যে আছেন একজন গর্ভবতী নারীও। সে রাতেই প্রসববেদনা ওঠে তাঁর। কুয়াশার চাঁদরের নিচে সন্তান প্রসব করে মারা গেলেন সেই নারী। নো-ম্যানস ল্যান্ডেই পড়ে রইল সেই মানবশিশু। কী তার দেশ? কী তার পরিচয়? এখন কী হবে ওই শিশুর? যখন কেউই সেই মানবশিশুর দায়িত্ব নিল না, তখন একটি বানর এসে কোলে তুলে নেয় তাকে। না-মানুষি জমিন-এর গল্পটি দুই দেশের সীমান্তের মাঝখানে আটকে পড়া একদল মানুষের৷
শুধু গল্প সিনেমায় নয়, সত্যিকারভাবেই বাংলাদেশ ভারতও দীর্ঘ ৬৮ বছর ধরে বয়ে বেড়িয়েছে এমনি ধারার নো-ম্যানস ল্যান্ড বা না-মানুষি জমিন। যা ছিটমহল নামেই সাধারণ্যে ব্যাপক পরিচিত।

রাজনীতির সুমতিতে বাংলাদেশ ভারত দুই দেশের চুক্তি অনুযায়ী, দাশিয়ারছড়াসহ ভারতের ১৭ হাজার ১৬০ দশমিক ৬৩ একর আয়তনের ১১১টি ছিটমহল ১ অগাস্ট প্রথম প্রহর থেকে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের অংশ এবং একইভাবে ভারতের মধ্যে থাকা ৭ হাজার ১১০ দশমিক ০২ একর আয়তনের বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ভারতের অংশ হয়ে গেল। ভারতে সবগুলো ছিটমহলের অবস্থান পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলায়। আর বাংলাদেশে ছিটমহলগুলো পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারী জেলায়। এখন আর ভারতের সাথে বাংলাদেশের স্থল সীমান্তে দেশহীনতার অভিশাপ বলে কিছু রইল না। নিখাদ কন্টকমুক্ত সীমানার অধিকারী হলো বাংলাদেশ।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানে দেশ ভাগের সময় সিরিল রেডক্লিফ কমিশনের তাড়াহুড়োয় চিহ্নিত করা সীমান্তে ছিটমহল জটিলতার শুরু। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই সমস্যার অবসানে ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি হয়। এরপর তা কার্যকরে প্রোটোকল স্বাক্ষরিত হয় ২০১১ সালে। গত ৭ মে ভারতের সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ওই চুক্তি বাস্তবায়নের পথ তৈরি হলে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফরে অনুসমর্থনের দলিল হস্তান্তর হয়। নিজ নিজ দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে এসব ছিটমহলের সরাসরি কোনো যোগাযোগ না থাকায় রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ছিল না এতোদিন। আরেক দেশের সীমানার ভেতরে হওয়ায় হাসপাতাল, বিদ্যুৎ, স্কুল-কলেজ বা বিচার- প্রশাসনও ছিল না সেখানে। ফলে ছিটের বাসিন্দাদের ইচ্ছা থাকলেও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করানোর সুযোগ ছিল সীমিত। অনেকেই বাংলাদেশি বা ভারতীয় ঠিকানা ব্যবহার করে লেখাপড়া করলেও ছিটমহলের বাসিন্দা হওয়ায় চাকরির সুযোগ তাদের এতোদিন হয়নি।

১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর সেই পরবাসী মানুষগুলোর আজ দেশ হলো। ৬৮ বছর পার হয়ে গেলেও পৃথিবীর কোনো মানবাধিকারকর্মী বা শান্তি নোবেল বিজয়ী মানুষ তাদের দিকে ফিরেও তাকায়নি। ৭৪'র ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঐকান্তিকতায় দেশ পেল অন্তত ৫২ হাজার বঞ্চিত মানুষ।

১ আগস্ট মধ্যরাতের পর থেকে যাদের এই দেশহীনতার জ্বালা-অপবাদ ঘুচে গেল, যারা আমার মাতৃভূমির গর্বিত নাগরিক হবার বিরল সৌভাগ্য অর্জন করল তাদেরকে প্রাণান্ত অভিনন্দন। সেইসাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধী স্মরণেও অনিঃশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি।

আজ এইদিন মানুষের অভিশাপ ঘুচবার দিন। যুগের পর যুগ বয়ে বেড়ানো বুক ভরা যন্ত্রণা ও কষ্ট অবসানের দিন। দেশ পাওয়া এসব ভূমিতে মেঠোপথে হাঁটিহাঁটি পায়ে সকাল সকাল শিশুরা শিক্ষায়তনে যাবে বিদ্যাশিক্ষা লাভে। বিনা চিকিৎসায় কারো প্রাণ ওষ্ঠাগত হবে না। ওরা এবার শিক্ষক পাবে, ডাক্তার পাবে, চেয়ারম্যান পাবে, বিদ্যুৎ পাবে, বিচার পাবে, খবরের কাগজ পাবে, কাজ পাবে, চাকরি পাবে। দেশ তথা পৃথিবীর সাথেই সখ্যতা হবে ওদের। সকল ক্ষেত্রে সফল প্রিয় নায়কের মুখটিও দেখে অনুপ্রাণিত হওয়ার সুযোগও পাবে। নেতার আহ্লাদে আটখানা হবে ওরাও। কখনও দেশনায়কের মিটিং মিছিলেও ওরা এবার স্লোগানের সুর তুলতে পারবে। ভোট প্রয়োগ অধিকারে নেতাও নির্বাচন করতে পারবে। এ যে অবিস্মরণীয় অশেষ আনন্দ ওদের।
ওরা আজ থেকে প্রাণখুলে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারবে…
সুরে অমীয় সুধায় মন্ত্রমুগ্ধ হতে পারবে…
আনন্দধারা বহিছে ভুবনে।

এবার তবে ওদের প্রাপ্য সত্যিকারের আদর্শবান ও বোধ বিবেকসম্পন্ন মানুষ হয়ে উঠবার মন্ত্রণাটা দেবার বন্দোবস্ত হোক। তবেই মানবতার আসল মুক্তি।

আজ এই দিনে মধ্যরাতের আঁধার কেটে ৬৮টি ফানুস উড়ানের স্বাধীন সৌন্দর্য আর ৬৮ টি মোমবাতির আলোয় উদ্ভাসিত হলো একসময়ের বঞ্চনাযুক্ত অবহেলিত তুচ্ছ তাচ্ছিল্যে সম্বোধিত গ্রাম ছিটমহলের বন্দি ভূমি। দেশ পাওয়া এসব জনভূমির প্রতিটি বাড়িতে উঠল অহঙ্কারের জাতীয় পতাকা। ভারত বাংলাদেশের অমীমাংসিত মানচিত্র পেল নির্ঝঞ্জাট পূর্ণতা। স্বাধীনতার আস্বাদে ঘুচে গেল পরাধীনতার করূণ গ্লানি। নিজের পতাকা বহন করে গর্বের সায়রে আজ ডুবসাঁতারে মাতল দেশ পাওয়া মানুষেরা। ইতিহাসের পাতা ওল্টে নতুন ইতিহাসের সাক্ষী হলো আজ সেখানকার প্রান্তিকজন। আর তাই মুক্তির আবাহনে সেখানকার গুমোট প্রকৃতি ও মানুষেরা সমস্বরে হাঁক ছাড়ল,
আমরাও মানুষ,
এ আকাশ, জল, বাতাস আমারই।
এ আমারই প্রিয় বাংলাদেশ।
আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।

ফারদিন ফেরদৌসঃ লেখক ও সাংবাদিক
০১ আগস্ট ২০১৫
https://www.facebook.com/fardeen.ferdous
https://twitter.com/fardeenferdous