আমার বন্ধু খান সরফরাজ বাংলাদেশ আরক্ষা বাহিনীর একজন পদস্থ কর্মকর্তা। পেশাগত সাফল্যের কারণেই রোজ টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকায় তাঁর মুখ দেখা যায়। মুখনিঃসৃত অমৃত বচন শোনা যায়। গর্বে বুক ফুলে উঠে আমাদেরও। ভৌগোলিকভবে একই বেল্টের হওয়ায় প্রায়শঃ বন্ধুর সাথে দেখা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কথাও হয়।
সেদিন ব্যস্ত মহাসড়কের পাশে বড়ইতলায় বসে চা খেতে খেতে দেশ, ধর্ম ও রাজনীতিসহ নানা বিষয়ে কথা হচ্ছিল ওর সাথে। হঠাৎ প্রায় চিৎকার করে ও বলতে থাকেঃ
ফী নারে জাহান্নামা খালেদীনা ফীহা। শয়তান তুই চিরকালের মতো নরকে ঢুক।
আমি বললাম, কে মারা গেল?
ভুবন স্যার।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, আমাদের হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ভুবন কুমার সাহা?
হ্যাঁ! খুব ভালো মানুষ ছিলেন। ভালো পড়াতেন। আমাদের ইংরেজি ও গণিত শেখার গোড়াপত্তনতো স্যারের হাতেই। এক নিঃশ্বাসে বলে গেল সরফরাজ।
আমি বললাম, আমাদের আবাল্যের সবচে' প্রিয় স্যারকে তুই জাহান্নামে ঢুকতে বললি যে!
আরে দূর! ধর্মে আছে, বলতেই হবে! এটা নিয়ম।
আচ্ছা কোনো অমুসলিম ডাক্তার যদি তোর অসুস্থ্য মৃতপ্রায় হৃৎপিন্ডকে সার্জারির মাধ্যমে সুস্থ্য করে তুলে নতুন জীবন ফিরিয়ে দেয়, তারক্ষেত্রেও কি তুই ঐ বাক্যই বর্ষণ করবি।
অফকোর্স! মুসলিম হিসেবে এটা আমাকে করতেই হবে। বলল, সরফরাজ।
আমি বললাম, যুক্তিবাদ প্রয়োগ করে একটু লিবারেল কি হওয়া যায় না?
নো! মুসলিম দুই প্রকারঃ প্র্যাকটিসিং মুসলিম, নন প্র্যাকটিসিং মুসলিম। লিবারেল টাইপ মাঝামাঝি কোনো অপশন নাই।
আচ্ছা! একের পর এক চাপাতির কোপে অভিজিত রায়ের মতো মুক্তচিন্তার লেখকরা মারা পড়ছেন। উগ্রবাদীরা দায়ও স্বীকার করছে। এ ব্যাপারে তোর ভাবনা কি?
দুই পক্ষই উগ্রবাদী। দুই পক্ষকেই কিক আউট করা দরকার।
কি বলিস! বেগম রোকেয়া, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, সুফিয়া কামাল ও শহীদ জননী জাহানারা ইমামরা প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তমনা ছিলেন বলেই না যুগে যুগে তাঁরা লাখো মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন।
আমার বন্ধুটি চুপ করে থাকে।
আচ্ছা বাংলাদেশের সংবিধানে তো চিন্তার ও অভিব্যক্তি প্রকাশের স্বাধীনতাও নিশ্চিত করেছে, সেক্ষেত্রে কি বলবি?
এ কথার কোনো জবাব না দিয়েই, আজ যাইরে বলে আমার বন্ধু বাই বাই বলে দিল।
সেদিন রাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শিক্ষায় সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী সরফরাজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের টাইম লাইনে ঢু মারলাম।
সেখানে তাঁর অপর্দানশীন পারিবারিক ফটোশ্যুটের বাইরে রেডিও সঙ্গী, রেডিও মুন্না প্রচারিত হাজার বছর আগের হাজী, হাজার বছর আগের কাবা, পয়গম্বরের বদনা বা জুতা মুবারকের ছবি এবং জাকির নায়েকের মৌলবাদীতার পক্ষে যুক্তি ছাড়া আর কিছু নাই।
আমার বন্ধুটি খুব ধার্মিক। আমি তাঁকে অশেষ শ্রদ্ধা জানাই।
পাশাপাশি আমার এই বন্ধুটি চরম সাম্প্রদায়িক সেজন্য ভীষণ আহতও হই।
এমন একজন সুশিক্ষিত ও সরকারের দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিই যদি এতোটা সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী ভাবাপন্ন হতে পারে, সেখানে সাধারণ মাদ্রাসা পড়ুয়াদের দোষ দিয়ে কী লাভ?
ওদেরতো জন্ম থেকেই শিক্ষা দেয়া হয়, মুসলমান ছাড়া পৃথিবীর আর কেউ মানুষই না!
কিন্তু আমাদের স্বাধীনতার মহানায়কেরা, জীবনদেয়া মুক্তিযোদ্ধারা বা সম্ভ্রম হারানো বীরমাতারা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলেন? যেখানে একমাত্র মুসলমানিত্ব বা ধর্মের ভিত্তিতেই পরিচিত হবে মানুষ!
স্বাধীনতা পূর্ববর্তীকালে ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত হাজারো লাঞ্ছনা গঞ্জনা, জুলুম নির্যাতন সয়ে জাতীয়তাবাদ ও অসাম্প্রদায়িকতার চেতনায় এদেশের মানুষ এক হয়েছিলেন। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ খ্রিস্টান, আদিবাসী নির্বিশেষে সবার সমান মর্যাদা ও সমঅধিকারের চেতনায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে দেশ এনে দিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ধর্মব্যবসায়ী জিয়া ও এরশাদের হাত ধরে দেশটার সেই সম্প্রীতিতে আগুন লেগেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় এখন সামগ্রিকভাবে দেশের ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত কট্টর মুসলিম সম্প্রদায়েরই কেবল অবাধ বিচরণ। বাকীদের দেশান্তরী হওয়ার পথ দেখিয়ে দিচ্ছে সাম্প্রদায়িক দন্ডমুন্ডের কর্তাব্যক্তিরা।
স্বৈরশাসক এরশাদের ক্ষমতা টেকানোর বড় অস্ত্র ছিল ধর্ম। সেই এরশাদ আজও বহাল তবিয়তেই আছে। কাজেই এখনও সেই ধর্মবিদ্বেষই মুক্তচিন্তা বা জ্ঞানচর্চার অজুহাতে মানুষ মারা রাজনীতির পুঁজি হবে, এতে অবাক হওয়া চলে না।
নৃশংসভাবে একের পর এক ব্লগার খুন হওয়ার পর ধর্মের নামে সন্ত্রাস করতে দেয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আমাদের সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনানুযায়ী তাঁর রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্যকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। ঠিক এমন সময় প্রধানমন্ত্রীর আওয়ামীলীগের সহসংগঠন ওলামালীগ নাস্তিকের জন্য মৃত্যুদণ্ডের আইন তথা ব্ল্যাসফেমি অ্যাক্ট চান।
প্রধানমন্ত্রী ধর্মনিরপেক্ষ, উদার ও সহনশীল বাংলাদেশ চান। আর তাঁর ওলামালীগ চায় দেশটা উগ্রবাদী পাকিস্তান হোক। ধর্ম অধর্ম নিয়ে এমন টানাহেচড়ায় আমরা আসলে একজন নায়ক খুঁজে ফিরি, যিনি অন্ধকার সরিয়ে সত্য সুন্দর আলোর পথ দেখাতে পারেন।
দলে-উপদলে, নগরে-গ্রামে, আধিকারিক-ভৃত্যে এবং সমাজ সংসারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যাওয়া এই কুৎসিত মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক বিষ যেন সারাতে পারেন সেই বীর ওঝা?
ব্লগার এবং এক্টিভিস্ট নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় মর্মান্তিক মৃত্যুর পর পুলিশ বাহিনীর প্রধান এ কে এম শহীদুল হক ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার মতো লেখা না লেখার পরামর্শ দেন মুক্তমনাদের।
ধর্মের ভাষায় সীমালঙ্ঘন না করার নির্দেশও দেন তিনি।
কিন্তু তিনি বলেন না, ধর্মের নামে মানুষ খুন পাপের কাজ, রাষ্ট্রীয় আইনবিরুদ্ধ কাজ। পুলিশ যেকোনো অযাচার খুনের বিরুদ্ধে।
উল্টো কারও লেখা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার মতো হলে সে ক্ষেত্রে পুলিশকে তা জানানোর পরামর্শও দেন তিনি। যাতে লেখকের যথোচিত শাস্তি নিশ্চিত করা যায়। এর সাথে সুর মেলান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও।
এটা যেন উল্টো ভিকটিমকেই দোষ দেওয়া। সেই সাথে এ ধরনের বক্তব্য লেখক এবং ধর্মীয় উগ্রবাদীদের একটা ভুল মেসেজ দিতে পারে ওলামালীগের সুরে কথা বলা পুলিশ প্রধানকে তা কে বুঝাবে?
জাতিসংঘসহ বিশ্বের সকল শান্তিপ্রিয় সম্প্রদায় যেখানে মুক্তবাক রুদ্ধ করার বিরুদ্ধে গিয়ে এসব অকাল মৃত্যুর আশু সুরাহা করতে অনুরোধ করেন, সেখানে আমাদের ধর্মাচারী পুলিশেরা প্রকারন্তরে আনাসারুল্লাদেরই পক্ষে থাকেন। অথচ ধর্মের নামে খুনীদের বিরুদ্ধে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারির পর আইজিপি'র দায়িত্ব ছিল মুক্তমনাদের ওপর চলে আসা এমন প্রাণঘাতী ঘটনাকে দ্ব্যর্থহীনকণ্ঠে নিন্দা জানানো এবং অপরাধীদের সনাক্ত করতে আন্তরিক ও উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সর্বোচ্চ পর্যায়ের এমনধারার অপরিনামদর্শী এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন মন্তব্য চরমপন্থিদের আরও উস্কে দিতে পারে, এটা তাঁর পক্ষে আসলে কিভাবে বুঝা সম্ভব, যিনি কিনা তেঁতুল হুজুর খ্যাত চরম মানবতা বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী আল্লামা শফিকে যেচে অনুরোধ করতে যানঃ
হুজুর, আপনি শৃঙ্খলা ভঙ্গ করবেন না, মিছিল করবেন না!
আমরা সব নাস্তিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি!
যেই শফি কিনা ভিন্নমতের মানুষকে প্রকাশ্যে কল্লাকাটার ঘোষণা দিয়েও গভঃমেন্টের পক্ষ থেকে রেলের জমি উপহার পেয়ে পুরো অধর্মের ধানক্ষেতটাই নিজের করে নিয়েছে! অথচ তার বিরুদ্ধে কোথাও কোনো টু শব্দটি পর্যন্ত নেই।
এমন অবস্থায় মানবতা, স্বাধীকার বা মুক্তবাকের পক্ষে শক্ত মনোবল ও দৃঢ়চেতা আরক্ষাবাহিনী কি আর পাওয়া সম্ভব?
খ্রিস্টান জগতে মৌলবাদ নিয়ে তর্ক শুরু হয়েছিলো ঊনবিংশ শতাব্দির শেষ দিকে। বিংশ শতাব্দির দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত প্রবল প্রতাপে তা চালু ছিলো।
তর্কের শিকড় ছিল এমনটাঃ
বাইবেলে যা লেখা আছে সে সব আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করে মান্য করতে হবে, নাকি পরিবর্তিত পৃথিবীর বাস্তব প্রেক্ষাপট ও মানব ইতিহাসের অগ্রগতির নিরিখে এবং যুক্তিবাদ প্রয়োগ করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পর মান্য করতে হবে?
মৌলবাদীরা আক্ষরিক অর্থের সব কিছু গ্রহণ করে থাকেন।
আমাদের মুসলমান মৌলবাদীরাও ঠিক তদ্রূপ। এদের কাছে যুক্তিবাদের কোনো স্থান থাকতেই নেই। আমাদের সকল মহলেও ধর্মীয় মৌলবাদ আরও সর্বগ্রাসী ভয়াবহ থাবা বিস্তার করেছে। কারণ এই মৌলবাদের রাজনৈতিক রূপের উদ্দেশ্য রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষমতা দখল।
আর সেই মানবতাবিধ্বংসী ক্ষমতা দখলের অংশই যে,
ধারাবাহিকভাবে চাপাতিতে মুক্তচিন্তার বিনাশ, তা বুঝবার সাধ্য আছে কার?
পাদটীকাঃ
আইএস, আলকায়েদা, তালেবান, আনসারুল্লাহ, ওয়াহাবি, মওদুদি, জামায়াতি বা হেফাজতির ধর্ম ব্যবসার বিরুদ্ধে আরও কথা বলবেন!
আপনার টুটি চেপে ধরবার সব বন্দোবস্ত করা হয়েছে!
অতএব সাধু সাবধান!
……
তবে যৌক্তিক কথাবার্তায় মানা নাই। শুধু মনে রাখতে হবে, সীমালঙ্ঘন বা যুক্তির মাপকাঠি যৌথভাবে নির্ধারণ করবেন তেঁতুল হুজুর ও তার ভাবশিষ্য আরক্ষা প্রধানরাই!
ফারদিন ফেরদৌসঃ লেখক ও সাংবাদিক
১১ আগস্ট ২০১৫
https://www.facebook.com/fardeen.ferdous
https://twitter.com/fardeenferdous