প্রতিবাদের দীপ্ত শক্তি : সাংবাদিক প্রবীর সিকদার

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 19 August 2015, 07:05 PM
Updated : 19 August 2015, 07:05 PM

দেশের সীমান্ত ও সমুদ্রজয়ী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোনো নিজস্ব বাড়ি ঘর নেই, তাঁর সেরকম লোভও নেই। যাও ছিল, তা রাষ্ট্রীয় স্মৃতি জাদুঘর করে দিয়েছেন। তাই নিজ কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে বাড়ি জাতীয় কিছু উপহার দিতে পারবেন না মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। এটা জেনে বুঝেই পুতুলের শ্বশুর ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন ছেলে আর ছেলে বৌকে বাগানবাড়ি করে দিবেন বলেই হয়ত ফরিদপুরের ঝিলটুলিতে ঐতিহ্যবাহী গুহ পরিবারকে বাস্তুচ্যুত করে, ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদেরকে ইন্ডিয়ায় ভাগিয়ে দিয়ে নামমাত্র মূল্যে ২০ কোটি টাকা দামের ৮ বিঘা জমির বাড়ি বাগিয়ে নিয়েছিলেন।

অরুণ গুহ মজুমদারের বাড়ি ও জমি জবরদস্তিমূলক দখল-ক্রয়ের বিরোধিতা করেছিলেন খন্দকার মন্ত্রীর এপিএস সত্যজিৎ মুখার্জি। মন্ত্রী বাহাদুরের অঙ্গুলি হেলনে এজেন্সির লোকেরা পিছু নেয় সত্যজিতের। বেচারা পালিয়ে চলে যায় ভারতে। গ্রেফতার করা হয় সত্যজিতের মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে। চার মাস ধরে সে বেচারা জেলে। একজন মুক্তিযোদ্ধার এই গ্রেফতার নিয়ে ফেসবুকে ছবিসহ একটি পোস্ট দিয়েছিলেন আমাদের প্রিয় সাংবাদিক প্রবীর সিকদার। তাঁর সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফের বিরোধের প্রকাশ সেই থেকেই।
ঐ পোস্ট দেখেই ফরিদপুরের বাসায় একজন সাংবাদিককে সম্প্রতি মন্ত্রী বাহাদুর বলেছিলেন, 'মালুর বাচ্চা মালু প্রবীর সিকদার, ওরে কী আদর করা যায় খুঁজতেছি'!

গত তিনদিন আমরা সেই বিশেষ আদর নাটকের অসফল মঞ্চায়ন দেখলাম। আর এই লজ্জাকর নাটকের কুশীলব পুলিশ, আইনজীবি, বিচারক, মন্ত্রীর পাধরা সাংবাদিক, নেতা পাতি নেতাদের প্রতি করুণাই হচ্ছে। সেকালে শেখ সেলিমের বেয়াই ধনাঢ্য মুসা বিন শমসেরকে রাজাকার নুলা মুসা হিসেবে আবিষ্কার করায় প্রতিবাদী সাংবাদিক প্রবীর সিকদার এক পা ও এক হাত খুইয়েছিলেন মুসার সন্ত্রাসীদের কাছে। একালে খন্দকার মন্ত্রীকে হিন্দু নির্যাতনকারী হিসেবে আবিষ্কার করায় মন্ত্রীর বশংবদ ফরিদপুরের পুলিশেরা প্রবীরের আরেক পা খেয়ে দুই হাতেই ক্রাচ ধরিয়ে দেওয়ার পণ করেছিলেন।

কিন্তু সবার ওপরে মহান অধীশ্বর আছেন এ বিষয়ে অত্যাচারীদের স্মৃতি বিভ্রম ঘটেছিল নিশ্চয়।
সেই অধীশ্বরের সদিচ্ছায় আমাদের প্রবীর সিকদার মন্ত্রীর ইঙ্গিতের রিমান্ড পাবার পরও ২৪ ঘন্টার মধ্যেই জামিনে মুক্তি পেলেন।

ফেইসবুকে লেখালেখি করে হুমকি পেয়ে ঢাকার শেরেবাংলা থানায় সাধারণ ডায়েরি করতে গিয়েছিলেন উত্তরাধিকার ৭১ নিউজ এবং দৈনিক বাংলা ৭১ নামের পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক প্রবীর সিকদার। কিন্তু বাংলাদেশের পুলিশ জিডি নেয়নি জানিয়ে গত ১০ আগস্ট নিজের ফেইসবুক পাতায় একটি স্ট্যাটাসে জীবন নিয়ে ঝুঁকির কথা লিখেছিলেন এই সাংবাদিক।

'আমার জীবন শংকা তথা মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী থাকবেন' শিরোনামের ওই স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন- "আমি খুব স্পষ্ট করেই বলছি, নিচের ব্যক্তিবর্গ আমার জীবন শংকা তথা মৃত্যুর জন্য দায়ী থাকবেন : ১. এলজিআরডি মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন এমপি, ২. রাজাকার নুলা মুসা ওরফে ড. মুসা বিন শমসের, ৩. ফাঁসির দণ্ডাদেশ প্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী বাচ্চু রাজাকার ওরফে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ এবং এই তিন জনের অনুসারী-সহযোগীরা।"

এই লেখার মাধ্যমে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণের অভিযোগ তুলে ১৬ আগস্ট রোববার রাতে ফরিদপুর সদর থানায় মামলা করেন মন্ত্রীর ফেউ আইনজীবী স্বপন পাল। একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং স্বাধীনতা যুদ্ধকালে যার চোখের সামনে তার পরিবারের ১৪ জন লোককে হত্যা করা হয়েছিল- তাকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে কণ্ঠরোধ করতে চেয়েছিলেন খন্দকার মন্ত্রী। জুজু হিসেবে সামনে রেখেছিলেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা।

৫৭ ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্রের ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ৷ এই অপরাধের দণ্ড সর্বোচ্চ ১৪ বছর এবং সর্বনিম্ন ৭ বছর কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা জরিমানা।

প্রবীর সিকদারকে গ্রেপ্তার করিয়ে ডুগডুগি বাজানো এই মন্ত্রী সরল স্বীকারোক্তি দেন, ৫৭ ধারায় মামলা হলে গ্রেফতার করা ছাড়া কোনও উপায় থাকে না!

কিন্তু গ্রেপ্তারের তিনদিনের মাথায় এবং রিমান্ডে নেয়ার ২৪ ঘন্টার মধ্যে বাংলাদেশের বিবেকবান মানুষের সম্মিলিত প্রতিবাদের মুখে, ন্যায়নিষ্ঠ দাবির মুখে জামিন পেলেন প্রবীর সিকদার।

এই জামিনের পেছনের সেই অদৃশ্য জাদু বাস্তবতা যদি হন, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, তবে তাঁকে প্রাণান্ত অভিবাদন; তিনি সাধারণ মানুষের সুরটি বুঝতে পেরেছেন।

কিন্তু কথা হলো- এখন যেহেতু প্রবীর সিকদার জামিন পেলেন, তবে কি ৫৭ ধারা লঙ্ঘিত হচ্ছে না? এখন খন্দকার মন্ত্রীর ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে না?
এর সোজাসাপ্টা মানে হলো- প্রবীর সিকদার ফেসবুকে এযাবৎ যা যা বলেছেন, তা সর্বৈব সত্য। হিন্দুকে দেশান্তরি করে, তার প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে একজন বশংবদ হিন্দুকে দিয়েই মামলা করিয়ে আবার হিন্দুদেরই জেলে পুড়ে মন্ত্রী প্রমাণ করলেন; তিনি কেবল লোভী সাম্প্রদায়িক নন! সাম্প্রদায়িকেরও বাপ।

একজন নিরীহ সাংবাদিক যিনি শেখ সেলিমের বেয়াইয়ের হাতে নির্যাতিত হয়ে পা হারিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বদান্যতায় কৃত্রিম পা নিয়ে অন্তত হাঁটতে পারেন। তাঁর প্রতিবাদের কলম সচল রাখতে পারেন। যিনি একাত্তরে সব স্বজন হারিয়ে বঙ্গবন্ধুকেই পিতা বলে মানেন। যিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই বোন বলে মানেন। সেই তিনি যখন অশুভ ইঙ্গিতে গ্রেপ্তার হয়ে পুলিশের হাতে নাজেহাল হন- তখন স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে আগের দিন যে পুলিশ এই নির্যাতিত এক পা বিহীন নিরীহ সাংবাদিকের ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন, তারাই আজ রিমান্ড দরকার নেই বলেন। যে বিচারক আগের দিন তাঁকে ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন সেই বিচারকই আজ তাঁর জামিন মঞ্জুর করেন! এ কেমন আইনের শাসন! এ কেমন বিস্ময়কর বিচার ব্যবস্থা? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ সাংবাদিক প্রবীর সিকদারকে মুক্ত করার নির্দেশ দেয়ায়। সবার সম্মিলিত প্রতিবাদে আপনি সাড়া দিয়ে প্রবীরের স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দেবেন, অনিতা বৌদি বা সুপ্রিয়দের আহাজারি দূর করবেন, এমন ভাবনা, এমন প্রত্যাশা আমাদের ছিলই।

কিন্তু সারাজীবন কি এভাবেই আপনি অসহায় প্রতিবাদকারীর সম্বল হয়ে উঠতে পারবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী? এই দেশের ক্ষমতাবানেরা যে, ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত কেবল শক্তিমানের দাসানুদাস থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সাধারণের অধিকার, ইচ্ছার, চিন্তা বা চেতনার দাম তাদের কাছে নেই। তাই আপনি ক্ষমতায় থাকতেই আইনের কঠোর শাসন ফিরিয়ে দিন। তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাক ও চিন্তার স্বাধীনতার পরিপন্থী হওয়ায় আরেকবার বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।

সবকিছু ভেঙ্গে পড়ার আগে ভাই বেয়াইদেরও সামলে রাখুন, দ্বার বন্ধ করে ভ্রমটাকে রুখবেন না প্লিজ।
এটাই প্রবীর সিকদার ও আমাদের প্রাণের দাবি।

আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও যেমনটি বলেছেনঃ
দ্বার রুদ্ধ করে দিয়ে ভ্রমটাকে রুখি
সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?

ফারদিন ফেরদৌসঃ লেখক ও সাংবাদিক
১৯ আগস্ট ২০১৫
https://www.facebook.com/fardeen.ferdous
https://twitter.com/fardeenferdous