হে বিমুগ্ধ জননী, রেখেছ ছাত্রলীগ করে মানুষ করোনি

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 30 August 2015, 08:34 PM
Updated : 30 August 2015, 08:34 PM

মহান একাত্তরে হানাদার পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে শহীদ ফয়জুর রহমানের সুপুত্র ড. জাফর ইকবাল;
যাঁর লেখা পড়ে আবাল্যেই মুক্তিযুদ্ধকে আত্মস্থ করেছি,
৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা বোনের আত্মত্যাগের ট্রাজেডি'র সাথে নিজেকে একাত্ম করেছি।
যাঁর লেখা পড়ে নেতা ও পিতা বঙ্গবন্ধুর দেশ ভাবনাকে নিজের চিন্তার সারথি করেছি।
সেই আলোর কারিগর শিক্ষক ও তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী আজ জয় বাংলার অধীশ্বর, জয় বঙ্গবন্ধুর একচ্ছত্র মালিক বনে যাওয়া ছাত্রলীগ তথা নিজেরই ছাত্রের হাতে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিগৃহীত হলেন, লাঞ্ছিত হলেন।
খুব স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ ও দুঃখ ভারাক্রান্ত জাফর ইকবালের অনুভূতি এখনঃ
এখানে যে ছাত্ররা শিক্ষকদের উপর হামলা চালিয়েছে, তারা আমার ছাত্র হয়ে থাকলে আমার গলায় দড়ি দিয়ে মরে যাওয়া উচিৎ।

আমরা যারা জাফর স্যারকে দূর থেকেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধবিদ্যার শিক্ষক মানি, শত সহস্রবার শ্রদ্ধায় প্রণতি জানাই, এই আমাদেরও আজ গলায় দড়ি দিয়ে মরে যাওয়া উচিৎ। মরবার আগে দেশের মুক্তিযুদ্ধের ধারক বাহক নামধারী সরকারের মাননীয় এক নাম্বার ব্যক্তিটির কাছে প্রশ্ন রেখে যাওয়া উচিৎ অন্ধকারে হাবুডুবু খাওয়া ছাত্রলীগ তথা শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ সভাপতি সঞ্জীবন চক্রবর্তী বা সম্পাদক ইমরান খানের কাছে…
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ বিক্রিত অথবা বিকৃত হয়েছে কিনা?

আগের ইতিহাস পড়ে জেনেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচে' মেধাবী শিক্ষকটি ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে আসীন হতেন গণতান্ত্রিক নিয়ম মেনেই। আর আমাদের জামানায় দলদাস, দলকানা, চরমতম দলবাজ বা বুদ্ধি-বিবেক বর্জিত শিক্ষককেই সরকারী এজেণ্ডা বাস্তবায়নে লোকদেখানো কলাকৌশলী শিক্ষক প্যানেল নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারযন্ত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর বানান।
কিন্তু আমাদের জামানাও আমরা সুপারসনিক গতিতে ছাড়িয়ে এসেছি। এখন ভিসি হওয়ার এক ও অদ্বিতীয় দাওয়াই হলো ছাত্রলীগের দাসানুদাস হওয়া। আপনি যদি এখনকার বিকৃত ছাত্রলীগের কাছে আপনার দেহ মন সপে দেন, ভিসি হয়েও ছাত্রলীগের একজন চুনোপুটি বা ঠুনকো কর্মীর চেয়েও আপনি অধম হন, তবে জানবেন,
আপনি ভালো ভিসি।
আপনি যোগ্যতম মুক্তিযুদ্ধের ঘ্রাণওয়ালা আধুনিক ভিসি।

আমাদের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি অধ্যাপক আমিনুল হক ভূঁইয়া হলেন সেই মাত্রার ভিসি যিনি কুলাঙ্গার ছাত্রলীগের কষ্টি পাথরে যাচাইকৃত উৎকৃষ্টমানের ভিসি মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছেন ইতোমধ্যে।

এমন ধারার ভিসির মিথ্যা বলবার অপরাধে, শিক্ষকদের প্রতি অভব্য আচরণের প্রতিবাদে, অনিয়ম দুর্নীতির প্রতিবাদে, বিশ্ববিদ্যালয়কে বাঁচানোর প্রতিবাদে যদি 'মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক পরিষদের' ব্যানারে কোনো শিক্ষক আন্দোলন করতে যান, তবে সেইসব শিক্ষকদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ক্যাম্পাস ছাড়া করবার জন্য অসভ্য, দাঁতাল, হায়েনা, জংলি সেইসব ছাত্রলীগের সুবর্ণপুত্ররা বুক চিতিয়ে ভিসির পক্ষেই দারোয়ানগিরি করবে!

কী লজ্জা!
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা এখন নিজেরাই অস্পৃশ্য ছাত্রলীগ বনে গেছে। আজকালের যে ছাত্রলীগের হাতে কিনা মায়ের গর্ভের সন্তানও নিরাপদ নয়। যে ছাত্রলীগের কাছে কিনা অনাহারী শ্রমজীবির কচি প্রাণ তুচ্ছতায় পর্যবশিত। যে ছাত্রলীগের ধ্যান জ্ঞান কিনা, দখল, সন্ত্রাস, লুটপাট, খুনোখুনি আর অবৈধ অর্থের অনুসন্ধান! তাই এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগিও ভিসিরা, যে 'জয় বাংলা' স্লোগান দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, সেই স্লোগানে ভর দিয়েই সত্যিকারের প্রকৃষ্ট মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী, মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার বিজ্ঞান শিক্ষক ড. ইয়াসমিন হক কিংবা ড. জাফর ইকবালের উপর লাঞ্ছনার হাত প্রসারিত করে রাখবেন-
এতে অবাক হওয়ার কিছু কি আদৌ আছে?

নাগরিকের নীতি নির্ধারণ, আইন প্রস্তাবনা, প্রণয়ন ও তৈরির ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের অংশগ্রহনের সমান সু্যোগ থাকবে, যা সরাসরি বা নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে হবে, সাংবিধানিকভাবেই এমন গণতন্ত্র চাওয়ার মধ্য দিয়েই জাতি ধর্ম বর্ণ গোষ্ঠী নির্বিশেষে সকলের ঐক্যবদ্ধতায় একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এই বাংলাদেশ পেয়েছিলাম। কিন্তু উদারনৈতিক সেই গণতন্ত্র ছেড়ে গ্রিক পণ্ডিত প্লেটো'র মুর্খের শাসন বা Rule of Ignorant কে প্রাধান্য দিয়ে এই দেশে আজ চলছে এক অত্যাশ্চর্য শাসনতন্ত্র। এখানে রাজাকার শিরোমনি নুলা মুসা বা হিন্দুর জমি জবরদখলকারী খন্দকার মোশাররফরা বেয়াইর মর্যাদা পেয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করবার ক্ষমতা পান। পক্ষান্তরে অধ্যাপক জাফর ইকবাল স্যারদের ভাগ্যে জুটে লাথি, গলাধাক্কা, অপমান বা অসম্মান।
জুটে লেলিয়ে দেয়া শুয়োরদের ধৃষ্টতাপূর্ণ আস্ফালন।
একপাক্ষিক বেপরোয়া সরকারের সীমালঙ্ঘনের মাত্রা এমনকরে সীমা ছাড়ালেই বুঝি আঘাতের ক্ষেত্রে আপন পর ভেদ ভুলে যায়!

তো সরকারী গুন্ডাবাহিনী এহেন ছাত্রলীগ বা এর দাসানুদাস ভিসি আমিনুল হকরা জাতিকে কী দেবেন?
কী দিতে পারেন?

কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ এনে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে ১২ এপ্রিল থেকে 'মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষকবৃন্দ' ব্যানারে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষকদের একাংশ। আবার এই আন্দোলনকে বিশ্ববিদ্যালয় অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা হিসেবে আখ্যা দিয়ে সরকার-সমর্থক শিক্ষকদের একটি অংশ 'মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্ত চিন্তার চর্চায় ঐক্যবদ্ধ শিক্ষকবৃন্দ' ব্যানারে উপাচার্যের পক্ষে অবস্থান নেন। পাশাপাশি আন্দোলনরত শিক্ষকদের আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ানোর দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে আন্দোলন করছে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ।

গণতান্ত্রিকপন্থায় দাবি আদায়ে এমনধারার আন্দোলন আগেও ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের ছাত্রলীগ বনে যাওয়া কিংবা ছাত্রলীগকে পাহারাদার বানিয়ে নিজের অকাজের রাস্তা পরিষ্কার রাখার এমন নজির আর না আসুক।
শিক্ষায়তনে এমন অদ্ভুত রাজনীতিকরণের অপচেষ্টাকে ঘৃণা জানাই, ধিক্কার জানাই আমরা।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেন আমাদের আজকের বাঙালি ছাত্রলীগ বা এর সেবাদাস ভিসিকে উদ্দেশ্য করেই ক্ষুব্ধ কন্ঠে 'বঙ্গমাতা' কবিতায় বলেছিলেনঃ
পূণ্যে পাপে দুঃখে সুখে পতনে উত্থানে
মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে
হে স্নেহার্ত বঙ্গভূমি-তব গৃহক্রোড়ে
চিরশিশু করে আর রাখিয়ো না ধরে।

সাতকোটি সন্তানেরে, হে বিমুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে –মানুষ করোনি।

আমরা এই পংক্তিমালাকে আজকের অবস্থায় রূপান্তর করে বলতে পারিঃ
হে বিমুগ্ধ জননী, রেখেছ ছাত্রলীগ করে-মানুষ করোনি।

ফারদিন ফেরদৌসঃ লেখক ও সাংবাদিক
৩০ আগস্ট ২০১৫
https://www.facebook.com/fardeen.ferdous
https://twitter.com/fardeenferdous