নোবেল প্রাইজ কেন নোবেল নয়!

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 16 Feb 2016, 10:12 PM
Updated : 16 Feb 2016, 10:12 PM

পৃথিবীর বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফলতা, অনন্য সাধারণ গবেষণা, উদ্ভাবন এবং মানবকল্যাণমূলক তুলনারহিত কর্মকাণ্ডের জন্য নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের ১৮৯৫ সালে করে যাওয়া একটি উইল-এর মর্মানুসারে ১৯০১ সাল থেকে এই নোবেল পুরস্কার প্রচলন করা হয়। বর্তমানে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসা শাস্ত্র, অর্থনীতি, সাহিত্য এবং শান্তি এই ছয়টি বিষয়ে বহুমূল্যবান এই পুরষ্কার দেয়ার রীতি রয়েছে। নোবেল পুরস্কারকে এ সকল ক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক পদক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রতিবছর অক্টোবর-নভেম্বরে শুধুমাত্র শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয় অসলো, নরওয়ে থেকে।
বাকি ক্ষেত্রে স্টকহোম, সুইডেনে এই পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।

মানবকল্যাণে তুলনারহিত কর্মকান্ডের জন্য এই পুরষ্কার বলে প্রতিবছরই বিশ্বের সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে অসলো ও স্টকহোমে। এই পুরষ্কার যিনি পান তিনি যেমন সারপ্রাইজড হন, তেমনি না পেয়েও নিজেদের বিস্ময়বোধ আটকাতে পারেন না অনেক প্রথিতযশারা। এই কারণেই কোনো জাতিকে পরাভূত বা হেনস্থা করবার ফন্দিফিকির হিসেবে নোবেল পুরষ্কার নিয়ে গোপনে বা প্রকাশ্যে বিশ্ব মোড়লদের মাঝেও চলে নানামুখী গুটিবাজি খেলা। নোবেল কমিটির কর্তাব্যক্তিরা মনুষ্যপ্রাণি বলেই বিশ্ব মাতাব্বরদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে নিজেদের খেলোও করে বসেন হরহামেশা। হেনরি কিসিঞ্জার, দালাই লামা, জিমি কার্টার, শিমন পেরেজ ও সর্বশেষ বারাক ওবামাকে নোবেল শান্তি প্রাইজ দিয়ে নোবেল কমিটি যেমন নিন্দার মুখে পতিত হয়, তেমনি আবার আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়ার, নেলসন ম্যান্ডেলা, মাদার তেরেসা বা অমর্ত্য সেনদেরদের মতো ব্যক্তিত্বকে পুরষ্কারে ভূষিত করে ব্যাপক প্রশংসাও কুড়ায়। বলা যায়, বিশ্বব্যাপী সর্বোচ্চ মূল্যবান বা সম্মানজনক এই পদক প্রাপ্তি নিয়ে দুর্মর দোলাচল চলে সারা বছর ধরেই। যারা পান তাঁরা নিজেরা অপার বিস্ময়ে মুগ্ধ হওয়ার পাশাপাশি অপরের ঈর্ষার পাত্রও হয়ে উঠেন। সেই সাথে নোবেল নিয়ে সমান্তরালে চলে, রাজনীতি, কৌতুক, আলোচনা বা সমালোচনা।

প্রমথনাথ বিশির রচনা থেকে জানা যায়, আমাদের জাতীয় সঙ্গীত রচয়িতা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গীতাঞ্জলি কাব্যের জন্য নোবেল বিজয়ী হিসেবে মনোনীত হওয়ার পর ১৯১৩ সালের ১৪ নভেম্বর কোলকাতা থেকে একটি টেলিগ্রাম পান, Noble Prize confirmed for you, our hearty congratulation. হেমন্তের সন্ধ্যায় আলো আঁধারিতে তিনি পড়লেন সেই বার্তা। কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে, এই ভেবে তারবার্তাটি প্রথমে বিশ্বাস করেননি। শেষে ভ্রম ভাঙ্গা বিশ্বাস নিয়ে অত্যন্ত নিরাসক্তভাবে বার্তাটি অধ্যাপক নেপাল বাবুর হাতে তুলে দিয়ে নোবেল লরিয়েট রবি ঠাকুর বললেন, 'নিন, আপনার ড্রেন করার টাকা'। শোনা যায়, সেসময় শান্তিনিকেতনে পাকা নর্দমা বানানোর খরচ নিয়ে টানাটানি চলছিল।
বোঝাই যায় প্রকৃত প্রাজ্ঞজনের কাছে বিশাল বড় পুরষ্কারও নর্দমাসমান তুচ্ছাতিতুচ্ছ হতে পারে।

অন্যদিকে কখনও কখনও ভুল মানুষকে শান্তি পুরষ্কার প্রদান করে গভীর অনুশোচনায় নিজেদের ভোগান্তি বাড়ান নোবেল কমিটির লোকেরাই। সম্প্রতি জানা গেল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া ভুল ছিল বলে মনে করেন নোবেল কমিটির সদ্য সাবেক এক কর্মকর্তা। ২০০৯ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে এ শান্তি পুরস্কার দেয়ার জন্য অনুশোচনা করেছেন তিনি।
গায়ের লানডেস্টেড নামে ওই সাবেক কর্মকর্তা তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, কমিটি ভেবেছিল এই পুরস্কার ওবামাকে আরো উজ্জীবিত করবে। সেসময় এই পুরস্কার পাওয়া নিয়ে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই অনেক সমালোচনা হয়েছিল। ওবামা নিজেও বলেছিলেন, তিনি এ পুরস্কার প্রাপ্তিতে অবাক হয়েছেন।
লানডেস্টেড আত্মজীবনীতে লিখেছেন, তার সর্মথকেরাও ভেবেছিল এটা হয়ত কোনো ভুল হচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্টদের সাধারণত নরওয়ের রাজধানী অসলোতে গিয়ে পুরস্কার নেয়ার রেওয়াজ নেই। কিন্তু হোয়াইট হাউজ খুব দ্রুত বুঝতে পারলো তাদের অসলো যাওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। তিনি বলেছেন, বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে ওবামা অবদান রাখবেন এই আশা পূরণে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। লানডেস্টেড শান্তি কমিটির একজন প্রভাবশালী সদস্য হিসেবে ১৯৯০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন।
মজার ব্যাপার হলো, সারাবিশ্বে ভজঘট পাকিয়ে রাখবার বিশেষজ্ঞ হিসেবে, মধ্যপ্রাচ্যের আজন্মের অশান্তি জিইয়ে রাখবার কারিগর হিসেবে, সৌদি আরব বা ইসরাইলের বন্দুত্বের সাহচর্য নিয়ে মুসলমানদেরকে দাসানুসাদ বানিয়ে তাদের গায়েই সন্ত্রাসী তকমা স্থায়ীভাবে সাঁটিয়ে দেয়ার কৃতিত্ব হিসেবে, বিশ্বব্যাপী অস্ত্রবাজি বা মোড়লগিরির প্রধান অনুঘটক হওয়ার দাবিদার হিসেবে যদি কারও অশান্তি পুরষ্কার জুটে তা আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সর্বাগ্রে পাওয়ার কথা। সেই তিনি কিনা পেয়ে বসলেন শান্তি পুরষ্কার। তবে নোবেল কমিটি শেষাবধি তাদের ভুল অনুধাবন করতে পেরেছেন এটাই বড় কথা। আর তাদের এই অনুশোচনাকে বলা যায় বিশ্বের সেরা নোবেলোনুশোচনা!


ভেরা রুবিন, আমেরিকান পদার্থ বিজ্ঞানী। মহাবিশ্বের ডার্ক ম্যাটার বিষয়ে সবচে' শক্তিশালী প্রমাণ হাজির করেও নোবেল প্রাইজ পাননি কেবল নারী বলে!

ব্যালিস্টিক অস্ত্র তৈরির কারখানার মালিক রসায়নবিদ আলফ্রেড নোবেলের প্রস্তুতকৃত অস্ত্রে নিজের ভাই লুডভিগসহ বিপুল সংখ্যক প্রাণহানি দেখে অনুশোচনায় ভুগে নিজের সমস্ত সম্পত্তি উইল করে নোবেল পুরষ্কার প্রবর্তন করেন। অন্যদিকে পদার্থবিজ্ঞানে অবদান রাখা নোবেল পাওয়া বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের ভরের সমীকরণ সূত্র মেনে বানানো জাপানের হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত আমেরিকান পারমানবিক বোমার ধংসযজ্ঞ দেখে মারাত্মক অনুশোচনায় কুপিত হয়েছিলেন তিনি। জাপানে পারমানবিক বোমার ভয়াবহ বিধ্বংসী রূপ দেখে বিচলিত হয়েই আইনস্টাইন লিখেছিলেন, পারমানবিক শক্তি মানব জীবনে খুব তাড়াতাড়ি আশীর্বাদ হয়ে দেখা যাবে-সেরকম মনে হয় না। তবে এই শক্তি মানবজাতির জন্য ভীতি জাগানিয়া হলেও পরোক্ষে তা হয়ত ভালোই করবে। ভয় পেয়ে মানবজাতি তাদের পারস্পরিক সম্বন্ধের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নিয়ম-শৃঙ্খলা চালু করবে। ভয় ছাড়া মানুষ বোধহয় কখনোই শান্তির পথে অগ্রসর হতে পারবে না।
একজন অনুশোচনাপ্রবণ নোবেল বিজয়ীর এমন সত্য কথন অন্তত আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারত পাকিস্তানের ক্ষেত্রে প্রতিভাত হতে দেখছি। এটাও একধরণের নোবেলীয় সারপ্রাইজ বটে!

আলফ্রেড নোবেল শান্তি পুরষ্কার প্রদানের ক্ষেত্রে তাঁর বিখ্যাত উইলে লিখেছিলেন, এমন কাউকে নোবেল শান্তি পুরষ্কার দেয়া হোক যে কিনা বিশ্বের জাতিগুলোর মধ্যে 'ভ্রাতৃত্ববোধ' বাড়াতে, 'বর্তমান' সেনাবাহিনী রদ করতে বা সৈন্য সংখ্যা কমাতে এবং শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে আলোচনা এগিয়ে নিতে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছেন।
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো পৃথিবীতে শান্তির বাতাস বইয়ে দেয়া সবাই যে নোবেল পেয়েছেন এমন না, আবার ব্যাপক অশান্তির কুশীলব হয়ে বিশ্ব মানবতার মুখে চুনকালি মাখানো অনেকেই শান্তি নোবেল বাগিয়েছেন।

যেমন ভারতের জাতির জনক অহিংসবাদী মহাত্মা গান্ধী মোট পাঁচবার মনোনয়ন পেয়েও নোবেলওয়ালা সুইডিশদের সাথে গ্রেট ব্রিটেনের সম্পর্ক বিনষ্টের কারণ ঘটবার আশঙ্কায় শেষমেশ গান্ধীজীর ভাগ্যে নোবেল ভাগ্যের শিঁকে ছিড়েনি। যদিও গান্ধীজিকে নোবেল না দিতে পারায় পরবর্তীতে দুঃখ প্রকাশ করেই দায় সেরেছে নোবেল কমিটি।

অন্যদিকে চরম বাংলাদেশ বিদ্বেষী যে আমেরিকান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ভিয়েতনামে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়ে হাজারো মানুষের প্রাণহরণ করেন, সেই তিনি কিনা ভিয়েতনামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় নোবেল পীচ প্রাইজ পেয়েছিলেন।
নোবেল চক্রকে যথার্থ তোয়াজ না করতে পারা অথবা ওই চক্রের স্বার্থে ব্যবহৃত হওয়ার সক্ষমতা অর্জন না করায় পুরো শতাব্দি ধরেই বহু ডাকসাইটে বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, সাহিত্যিক বা শান্তিকর্মীদের নোবেল বঞ্চিত রাখা হয়েছে। আবার অন্যদিকে তিব্বতের বিচ্ছিন্নতাবাদী ধর্মগুরু দালাইলামাকে নোবেল প্রাইজে ভূষিত করা হয়েছে স্রেফ উদীয়মান পরাশক্তি চীনকে চাপে রাখতে!

নোবেল পুরষ্কারের এমন দৈন্যদশা, ক্রীড়নকতা বা অদূরদর্শীতা দেখে আলফ্রেড বেঁচে থাকলে কাঁদতেন নাকি হাসতেন তা হয়ত ঠাওর করে উঠতে পারতেন না।

এদিকে আমাদের দেশের নোবেল পুরষ্কারের ক্ষেত্রে সবেধন নীলমণি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদক প্রাপ্তির পেছনে বিপুল বিস্তারি রাজনীতির ঘ্রাণ খুঁজেছেন বিরুদ্ধবাদীরা।
ভিন্নমতাবলম্বীদের দাবি নোবেল পুরষ্কারের নিজস্ব রাজনীতি, অর্থনীতি বা মতাদর্শের পরীক্ষায় নানা প্রায়োগিক কৌশলগত কারনে উতরে গিয়েই ইউনূস এই পুরষ্কার বাগিয়েছিলেন। এদের দাবি বিশ্বের যেসব দামি পুরষ্কারে তিনি ভূষিত তাঁর প্রায় সব ক্ষেত্রেই নিজের দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে তাঁর বিশেষ শ্রেণির বন্ধুদের আনুকূল্যেই সেগুলো অর্জন করেছেন।
দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয়ে তাঁর অতি সরবতা বা গভীর মৌনতাই পুরষ্কারের আসল রাজনীতি মনে করিয়ে দেয়। তিনি কখনও ইজরাইলী আগ্রাসন, আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ, ধর্মীয় উগ্রবাদীতা বা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন এমনটা শোনা যায় না। তাই এই শান্তি নোবেল লরিয়েট আসলে মানবতার কোন আঙিনায় শান্তির নহর বইয়ে দিয়েছেন তা প্রশ্নসাপেক্ষই থেকে যায়। তবু নরওয়ের টেলিনর মোবাইল কোম্পানির ঘনিষ্ঠ মিত্র একজন নোবেল বিজয়ী বাংলাদেশি মুহাম্মদ ইউনুসের সাথেই আমরা থাকব হয়ত।

রাজনীতি, স্বার্থচিন্তা, বিশ্বব্যাপী ছড়ি ঘুরানো, পুঁজিবাদিতার মতো বিষয়গুলোর সাথে যুগে যুগে নোবেল প্রাইজের ব্যাপক বিস্তারী সম্পৃক্ততার কারণেই চির দুই বৈরি দেশ পাকিস্তান ও ভারতের নারীশিক্ষাকর্মী মালালা ইউসুফজায়ী বা শিশু অধিকারকর্মী কৈলাশ সত্যার্থীর নোবেল বিজয় নিয়েও প্রশ্ন উঠে নানা মহলে। আসলে নোবেল পুরষ্কার ও স্বার্থবাদিতা বরাবরই হয়ত সমার্থক শব্দ হয়ে উঠেছে। কিন্তু আলফ্রেড নিশ্চয় নিজের জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে বিখ্যাত উইলের মাধ্যমে সত্যিকার অর্থেই মানবকল্যাণ বা বিশ্বশান্তির স্বপ্নই দেখেছিলেন।

কিন্তু আমাদের চিন্তা, বোধ ও মনন দিয়ে নোবেলের সেই স্বপ্নকে এগিয়ে নিতে পারছি কি? তবু এবছর পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসা শাস্ত্র, অর্থনীতি, সাহিত্য এবং শান্তিতে যারা নোবেল পেয়ে যারপরনাই সারপ্রাইজড হলেন তাঁদের জন্য প্রাণান্ত অভিবাদন। আর যারা না পেয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে নোবেল কমিটির রাজনীতিকে শাপশাপান্ত করলেন তাঁদেরও অভিনন্দন।
তবু এগিয়ে চলুক মঙ্গলময় বিশ্ব সকলের যুথবদ্ধতায়।

ফারদিন ফেরদৌসঃ লেখক ও সাংবাদিক