নিপুণ জালের বুনন কারিগর মাকড়শা!

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 29 Oct 2015, 08:39 AM
Updated : 29 Oct 2015, 08:39 AM

ছেলেবেলায় ইংরেজি ভাষায় রবার্ট ব্রুসের গল্প প্রায় সবারই জানা। স্কটল্যান্ডের বীর যোদ্ধা রবার্ট ব্রুস তাঁর প্রতিপক্ষ শত্রুর কাছে বারবার পরাজিত হচ্ছিলেন। শেষটায় একদম নিরাশ হয়ে রাজ্যের আশা ছেড়ে দিয়ে এক পাহাড়ের গুহায় লুকিয়ে পড়েন। এসময় তিনি দেখেন যে, একটা পরিশ্রমী মাকড়শা একখানি সুতো ধরে বারবার গুহার মুখটাতে বেয়ে উঠবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। প্রায় সাতবার চেষ্টার পর সে ঠিকমত উঠতে পারল। তা দেখে রাজা ববার্ট ব্রুসের মনেও ভরসা এল। তিনি ভাবলেন, আর একবার চেষ্টা করেই দেখা যাকনা। এবং সে চেষ্টার ফলে তিনি জয়লাভ করে আবার তাঁর প্রিয় রাজ্য ফিরে পেয়েছিলেন।

আর একালে স্ট্যানলী ও স্টিভ ডিটকো'র কমিক সিরিজ সুপার হিরো অবলম্বনে নির্মিত ইংলিশ মুভি স্পাইডারম্যানে প্রধান চরিত্র টোবি ম্যাগুয়েরের দুর্দান্ত কারিকুরি দেখে মুগ্ধ হননি এমন ছেলেবুড়োর খোঁজ মেলা ভার!

বাস্তবে মাকড়শার দুরন্তপনা এতোটা না থাকলেও ম্যাগুয়েরের চেয়ে ওরাও কম যায় না!
মাকড়শা অমেরুদন্ডী শিকারী কীট বিশেষ। এটি একটি আট পা ওয়ালা অ্যারাকনিডা শ্রেণির সন্ধিপদ প্রাণি। এদের শরীর মাথা ও ধড় দুটি অংশে বিভক্ত, আটটি সন্ধিযুক্ত পা আছে, ডানা নেই। এদের মাথা ও বুক একসাথে জুড়ে সেফালোথোরাক্স বা মস্তক-বক্ষ গঠন করে। মাকড়শার সবচে' বড় ও বিশেষ গুণ হল, এরা জাল তৈরি করে এবং জালের মাধ্যমে অন্যান্য কীট-পতঙ্গ ইত্যাদি শিকার করে নিজেদের জীবনধারণ করে।
অনেক রকম মাকড়শা হয়, কেউ জাল বোনে, কেউ লাফিয়ে শিকার ধরে। সব মাকড়শারই একজোড়া বিষগ্রন্থি আছে। তবে সবাই প্রাণঘাতী না হলেও, এদের অনেকের কামড় খুব বিষাক্ত।

মাকড়শারা প্রথম স্থলচর প্রাণিদের অন্যতম। অপেক্ষাকৃত প্রাচীন মাকড়শারা জাল বোনে না, এরা নিঃসঙ্গ শিকারী। লাফিয়ে শিকার ধরে।
একটি মাকড়শার জাল হলো তার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। মাকড়শার কথা ভাবলে তার জাল আর সেই জালে ধরা পড়া বেচারা পোকার কথা সবার আগে মাথায় আসে। মাকড়শা আমিষভোজী এবং অন্যান্য পোকামাকড় খেয়ে সে উদরপূর্তি করে সেটা জানা কথা। তবে বিজ্ঞানীদের মতে, মাকড়শা কিন্তু আমিষ খাবারের পাশাপাশি কিছুটা নিরামিষও খেয়ে থাকে? অর্থাৎ আমরা মানুষেরা খাবারের পাশে যে একটু করে সালাদ বা সবজি খেয়ে থাকি, সে একই ধরণের কাজ করে মাকড়শাও। গবেষক বেঞ্জামিন এগস এবং ডার্ক স্যান্ডার্স এর এই সংক্রান্ত গবেষণার ফলাফল বিজ্ঞান জার্নালগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে। অর্ব উইভার স্পাইডারের মাঝে এই অভ্যাসটা দেখা যায়। তাদের পাতা জালে ধরা পড়ে অনেক রকমের পোকা যা কিনা আমিষের ভালো উৎস। আর এর পাশাপাশি আরও ধরা পড়ে বিভিন্ন ফুলের পরাগ, ধুলোবালি আর ছত্রাকের রেণু। এগুলোকে ময়লা ভেবে ফেলে দেয়না এই মাকড়শা। বরং এই সবকিছু মিলিয়েই সে চমৎকার একটা 'ব্যালান্সড' ডায়েট বজায় রাখে।

শুধু অর্ব উইভার স্পাইডার নয়, ইউরোপিয়ান গার্ডেন স্পাইডার এবং এমন আরও অনেক মাকড়শা আছে যারা নিজেদের খাবারের মাঝে এমন কৌশলে যুগপৎ ভেজ ও ননভেজ অবস্থাটা বজায় রাখে। এদের সবাই নিজেদের রেশমি জালটার ব্যবহার করে এর জন্য। শিকার ধরার পরে এই জালটাকে ফেলে না দিয়ে বরং খেয়ে ফেলে। এই প্রোটিন তাদের তন্তু তৈরির গ্রন্থিতে চলে গিয়ে নতুন জাল তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। আর এই কাজ করার সময়েই জালের সাথে আটকে থাকা নিরামিষ সব উপাদানগুলোও তার পেটে চলে যায়।

ইদানিং বিজ্ঞানীরা মাকড়শা জালের তন্তু থেকে বর্ম বানানোর পরিকল্পনার কথাও জানাচ্ছেন! যুদ্ধের ময়দানে বর্মের কোনো বিকল্প নেই। প্রতিপক্ষের আক্রমণ থেকে গা বাঁচাতে প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন উপাদানে বর্ম তৈরি করা হতো। পৃথিবীজুড়ে যুদ্ধ চলছে এখনো, কিন্তু ভারি ধাতব বর্মের দিন হয়ত শেষ হয়ে এসেছে, কারণ এখন মানুষের প্রাণ বাঁচাতে আসছে মাকড়শার জালের তৈরি বর্ম!
প্রাকৃতিক বিভিন্ন তন্তুর মাঝে অন্যতম শক্ত তন্তু হলো মাকড়শার জাল। হালকা এবং নমনীয় এই তন্তু ইস্পাতের চাইতে শক্ত বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে! উড়ে যাওয়া একটি পোকার গতি থামিয়ে দিতে পারে মাকড়শার জাল। এটা প্রাকৃতিকভাবে লম্বা হতে থাকে আর শুষে নেয় আটকা পড়া পোকার শক্তি। বৃহৎ পরিসরে চিন্তা করলে অনেক বড় এমন একটি জাল হয়তো একদিন থামিয়ে দিতে পারবে ধ্বংসাত্মক মিসাইল!

শুধু বর্মই নয়, অস্ত্রোপচারের সুতোর মতো বস্তু বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করা হতে পারে এ দিয়ে। মিশিগানের ক্রেইগ বায়োক্র্যাফট ল্যাবরেটরিতে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে জন্ম দেওয়া হয়েছে এমন সব রেশম পোকা যারা কিনা তৈরি করবে মাকড়শার তন্তু। আর এই তন্তু দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এমন সব দস্তানা যাদের দৃঢ়তাও কিনা হবে অতুলনীয়; বলছেন বিজ্ঞানীরা।

এই আইডিয়া নিয়ে যে আগে কাজ করা হয়নি তা নয়। কিন্তু মাকড়শার তন্তু থেকে বর্ম তৈরির কাজটি নেহায়েত ছেলেখেলা নয় আর অনেক প্রতিষ্ঠান এতে ব্যর্থ হয়ে ইতোমধ্যেই রণে ভঙ্গ দিয়েছে। কিন্তু ক্রেইগ বায়োক্র্যাফট রেশম পোকা ব্যবহারের মাধ্যমে নিয়ে আসতে পারে সাফল্য। কারণ জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে জন্ম নেওয়া এসব রেশম পোকা তাদের সন্তান-সন্ততির মাঝেও এমন তন্তু উৎপাদনের ক্ষমতা রেখে যাবে ফলে সম্ভব হবে বাণিজ্যিকভাবে এই তন্তুর উৎপাদন। ধারণা করা হচ্ছে, বাণিজ্যিক পর্যায়ে যাবার পর এই তন্তুর প্রতি কেজি উৎপাদনের জন্য খরচ পড়বে ১৫০ ডলার বা তারো কম। প্রথমে এই তন্তু দিয়ে তৈরি মজবুত রেশমি কাপড় বাজারে ছাড়া হতে পারে এবং আশা করা হচ্ছে তা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। ঠিক কখন এই তন্তু দিয়ে সেনাবাহিনীর জন্য বর্ম জাতীয় পোশাক তৈরি করা হবে তা এখনো নিশ্চিত নয়। তবে অবশ্যই এই তন্তু ব্যবহার করে আঘাত প্রতিরোধের ওপরে আরও পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হবে।

মাকড়শার জাল শুধু মাত্র তার আবাশ স্থল হিসেবে ব্যবহার হয় তা নয় বরং তার শ্রবণ মাধ্যম হিসেবেও কাজ করে। ভোর বেলার কুয়াশা আচ্ছাদিত মাকড়শার জাল প্রকৃতি প্রেমী ও ফটোগ্রাফির জন্য সব সময় প্রাধান্য পেয়ে থাকলেও এবার বিজ্ঞানীরা সেই জালের মাঝে এক সাংকেতিক ভাষা খুজে পেয়েছে যা মাকড়শা প্রতিনিয়ত ব্যবহার করে চলেছে। যাকে অন্য ভাবে বিজ্ঞানীরা মাকড়শার একুইস্টিক গীটার বলছেন। সত্যি এক অনন্য পর্যবেক্ষণ এই বিজ্ঞানী দলের।

মাকড়শার জাল অনেক উঁচু মানের ও নিখুঁত শব্দের ফ্রিকোয়েন্সি তৈরি করতে পারে। আর এই শব্দ তরঙ্গ মাকড়শাকে তার রাজ্য (জাল) সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য অনবরত দিয়ে যায় এবং তার শিকারের অবস্থান নির্ভুল ভাবে নিরুপণ করতে সাহায্য করে বলে বিজ্ঞানীদের মত।

মাকড়শার জালের বুনন শৈলী সত্যি অসাধারণ। একই সাথে এই জালের শক্তি ক্ষমতা এবং এর নমনীয়তা বিজ্ঞানীদের বরাবরই ভাবনায় ফেলে দেয়। মাকড়শা তার এই তরঙ্গ কৌশল ব্যবহার করে কারণ সে চোখে খুবই কম দেখে যার ফলে এই তরঙ্গ দিয়ে সে তার জাল এবং শিকারের নিয়ন্ত্রণ রাখে। মাকড়শার আটটি পা এই শব্দ তরঙ্গকে নিরুপণ করে থাকে।

প্রকৃতির এই বিস্ময়কর উপাদান মাকরশা জাল নিয়ে এযাবৎ বিস্তর গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। এই জালের নকশা ও কারিগরি জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে ঝুলন্ত ব্রিজসহ নানা ইঞ্জিনিয়ারিং ডিজাইন।

মানুষের চুলের চেয়েও বহুগুণ সুক্ষ এই প্যাঁচানো ফাইবারের তন্তুগুলো সরু হলেও অত্যন্ত শক্ত ও নমনীয়। আর এই জালই এই পৃথিবীতে মাকড়শার টিকে থাকবার প্রধান অবলম্বন।

বিস্ময়কর সুন্দর এই মাকড়শা জাল নিয়ে আমাদের আব্রাহামিক পুরাণে সবচে' চমকপ্রদ কাহিনী রয়েছে। পবিত্র কোরআন শরীফের ২৯ নাম্বার সুরার নাম আল আনকাবূত বা মাকড়শা। ওই সুরার ৪১ নাম্বার আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, যারা আল্লাহ ছাড়া বহু অভিভাবক গ্রহণ করে, তাদের দৃষ্টান্ত মাকড়শার ন্যায়, যে ঘর বানায় এবং নিশ্চয় সবচাইতে দুর্বল ঘর হলো মাকড়শার ঘর, যদি তারা জানত। একই সুরার ৪৩ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলেন, আর এসব দৃষ্টান্ত আমি মানুষের জন্য পেশ করি; আর জ্ঞানী লোকেরা ছাড়া কেউ তা বুঝে না। আর এভাবেই উদাহরণ হিসেবে আল্লাহতায়ালা মাকড়শাকেও তাঁর পবিত্র গ্রন্থে স্থান দিয়েছেন।

আজ থেকে ১৪৩৭ বছর আগে মক্কার কাফিররা ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মুহাম্মাদ (সা.)কে হত্যার ষড়যন্ত্র করলে ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ই সেপ্টেম্বর আল্লাহর নির্দেশে মক্কা হতে মদীনায় হিজরত করেন তিনি।
ভোরবেলা কাফির ঘাতকরা যখন রাসূল (সা.)কে হত্যা করতে উদ্যত হয় ততক্ষণে মুহাম্মদ(সা.) আশ্রয় নেন মক্কা থেকে বেশ দূরে অবস্থিত 'সুউর' নামক গিরি গুহায়।
একদল কাফির মুহাম্মাদ (সা.)'র পায়ের চিহ্ন অনুসরণ করে এই গুহার কাছে গিয়ে দেখতে পায় যে, গুহার মুখে রয়েছে মাকড়শার জাল এবং একটি কবুতর সেখানে ডিম পেড়ে রেখেছে। এইসব দৃশ্য থেকে কাফিররা ভাবল যে খুব সম্প্রতি এখানে কেউ আসেনি এবং তারা হতাশ হয়ে চলে যায়। বিপদ কমে গেলে মহানবী (সা.) মদীনার দিকে যাত্রা অব্যাহত রাখেন এবং মদিনায় হিজরতের পরই ইসলামের আলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ বা ১৫ জুলাইয়ের সূর্যাস্তের সময়কে হিজরী সন শুরুর সময় হিসেবে নির্ধারণ করার ১৭ বছর পর থেকে তৎকালীন মুসলিম শাসক হযরত ওমর হিজরী সন গণনা শুরু করেন।

হাজার বছর ধরে তাই নিপুণ জালের অভাবনীয় বুনন কারিগর মাকড়শার বন্দনাই চলে আসছে ধর্মপুস্তকে, শিল্প সাহিত্যে বা বাস্তবিক মানবীয় আখ্যানে। নিদারুণ জালের অশেষ সৌন্দর্যকে সারথি করে বেঁচে থাকুক প্রকৃতির অবাক অনুষঙ্গ মাকড়শা!

লেখকঃ সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
৩০ অক্টোবর ২০১৫
twitter.com/fardeenferdous
facebook.com/fardeen.ferdous