অসহায় অভিবাসী: আমাদের রক্ষা করো নতুবা গুলি করে মারো

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 27 Nov 2015, 01:35 PM
Updated : 27 Nov 2015, 01:35 PM

ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদচর্চাকারী পশ্চিমা দেশগুলোর ভুল যুদ্ধনীতিকে বাজি রেখে পুরো পৃথিবীকে নিজেদের হাতের মুঠোয় রাখবার যে দুরভিসন্ধি, তারই খেসারত দিতে হচ্ছে যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া বা বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের অভিবাসন প্রত্যাশী নিরীহ সাধারণ মানুষদের। ২০০১ সালের ১/১১ এর পট পরিবর্তনের পর পশ্চিমা মদতপুষ্ট আলকায়েদা, তালেবান বা হাল আমলের বর্বর আইএস নামের দুষ্ট চক্রের ফাঁদে ফেলে বিশ্ব মুসলিম সমাজ বা তাদের উদারনৈতিক চেতনাকেই আজ শাখের করাতের ওপর ফেলে দেয়া হয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যের অশুভ যুদ্ধ নিয়ে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার কিংবা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ বা বারাক ওবামাদের পূর্ব ভূলের স্বীকারোক্তি থাকলেও এই ভুল শোধরানোর নিদান কারো জানা নাই। সম্প্রতি প্যারিসে জঙ্গি হামলার পর উদারমনা মুসলিমদের আর কেউ বিশ্বাস করছে না। ইউরোপে এখন নানা ছুতোনাতায় মুসলিমদের ওপর প্রতিপক্ষের হামলা ৩০০ গুণ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। অথচ যে বিশ্বাস ভেঙ্গে দেয়ার প্রকৃত দায় সেইসব ধনতান্ত্রিকদেরই। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কিংবা বিপ্লবী ফিদেল ক্যাস্ট্রোর ভাষায়, 'ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ও মার্কিন সিনেটর জন ম্যাককেইন ষড়যন্ত্র করে আইএস গঠন করেছে। যে দলটি এখন ইরাক এবং সিরিয়ার অনেক এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে।'

তাই আইএস'র তান্ডবে পড়ে কেন বিশ্বব্যাপী মানুষদেরকে নিজেদের মাতৃভূমি ছেড়ে মানবেতর জীবন মেনে নিয়ে, অমর্যাদা আর অনিশ্চয়তায় ভরা অভিবাস নামের আগ্নেয়গিরিতে ঝাপ দিয়ে মরতে হয়, তার জবাব জানবার কথা কেবল সেই সাম্রাজ্যবাদিদেরই। লুটেরা ধনতান্ত্রিক মুনাফাখোরদের শত বছরের লোভের আগুনে পুড়ে আমরাই কেন আত্মাহুতি দিয়ে যাব। আমরা কেন অর্থলোলুপ ওদের চালাকি বা চতুরতার ঘুটি হতেই থাকব!
চাপিয়ে দেয়া অসম যুদ্ধের বিষে আজ আমরা জর্জরিত। আমাদের আর পেছনে যাওয়ারও উপায় নেই, সামনের দিকেও কাঁটাতার ও সীমান্ত বাহিনী। আর সমুদ্র তো মরণের ফাঁদ। বাধ্য হয়েই আমরা গ্রিসের মেসিডোনিয়া সীমান্তে রেলপথ অবরোধ করে বলে চলেছি, 'আমাদের গুলি করে মেরে ফেলো, আমরা কখনোই ফিরে যাব না'। যদিও আমাদের নাম 'অর্থনৈতিক অভিবাসী'; কিন্তু ইরাক বা সিরিয়ায় অনৈতিক যুদ্ধাবস্থার জন্যই আমাদের কপাল পুড়েছে। তাই হয়ত গুলিটাই আমাদের প্রাপ্য। এমনই কপাল আমাদের তৃতীয় বিশ্বের!

এএফপি বা রয়টার্স নামের প্রভাবশালী পশ্চিমা গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে, ইউরোপের উন্নত দেশগুলোতে যাওয়ার লক্ষ্যে অনেক বিপৎসংকুল পথ পাড়ি দেওয়ার পর 'সীমান্ত কড়াকড়িতে' গ্রিস-মেসিডোনিয়া সীমান্তে আটকা পড়েছে অনেক বাংলাদেশি। যুদ্ধপীড়িত দেশগুলোর শরণার্থী ছাড়া বাকি শরণার্থীদের প্রবেশের ক্ষেত্রে ইউরোপের কয়েকটি দেশ সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশিসহ আরো অনেক দেশের শরণার্থী প্রচন্ড ঠান্ডায় মারাত্মক দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। পশ্চিম ইউরোপে যেতে দেওয়ার দাবিতে ওই অভিবাসীরা সম্প্রতি সেখানে দুই দেশের মধ্যে চলাচলের একটি রেলপথও অবরোধ করে।
এই অবরোধে বাংলাদেশি অভিবাসীদের একটি দলও অংশ নেয়। তাঁদের বুকে লেখা ছিল, 'আমাদের গুলি করে মেরে ফেলো, আমরা কখনোই ফিরে যাব না', 'আমাদের গুলি করে মেরে ফেলো অথবা আমাদের রক্ষা করো। দয়া করে বাংলাদেশকে রক্ষা করো' ইত্যাদি স্লোগান। যদিও মানবাধিকারকর্মীরা ইউরোপের দেশগুলোর এই কঠোর নীতির বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁরা বলছেন, জাতীয়তার ভিত্তিতে নয়, বাস্তব অবস্থার ভিত্তিতেই আশ্রয়ের অনুমতি দিতে হবে।

দুঃখজনক হলেও সত্যি, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অথবা প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে এখনো তাদের কথার ফুলঝুড়িপূর্ণ মুখটি খোলেনি।
অথচ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী গেল জুন মাসে মহান সংসদে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সব সময় বিদেশে বিপদগ্রস্ত বাংলাদেশি নাগরিকদের (জেলে আটকসহ) দেশে প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সকল প্রকার ব্যবস্থা করে থাকে। বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশ মিশনসমূহ প্রতিনিয়তই সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা ও আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উক্ত দেশের কারাগারে থাকা বাংলাদেশিদের দেশে প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করে যাচ্ছে।

এ বছরের ২৭ আগস্ট বৃহস্পতিবার প্রায় ৫০০ যাত্রী নিয়ে ইঞ্জিনচালিত দুটি নৌকা অবৈধ অভিবাসীদের নিয়ে লিবিয়া থেকে ইতালির উদ্দেশে রওনা হয়েছিল। কিন্তু লিবীয় উপকূলেই নৌকা দুটি ডুবে যায়। আর নৌকাডুবিতে মারা যাওয়া মানুষদের ২৪ জনই হচ্ছে বাংলাদেশী। এদের মধ্যে তিন জন শিশু রয়েছে। ডুবে যাওয়া নৌকা দুটিতে মোট ৭৮ জন বাংলাদেশি ছিলেন। এ ঘটনায় ১৭৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। তার মধ্যে ৫৪ জনই হচ্ছে বাংলাদেশী। ২০১১ সালে গ্রিস উপকূলে ১০ বাংলাদেশি সমুদ্রে ডুবে মারা যান। গত আগস্টে গ্রিসের কুস দ্বীপে ২০০ বাংলাদেশি অভিবাসীর আটকে পড়ার খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আসে।
কিন্তু আমাদের মুখে খই ফুটা করিৎকর্মা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এসব বিপদে পড়া অভিবাসীদের জন্য আক্ষরিক অর্থেই কিছু করেছে এমন নজির মাইক্রোস্কোপ দিয়েও খুঁজে পাওয়া যায় না।

বিশ্ব মোড়লদের চাপিয়ে দেয়া আরোপিত যুদ্ধ, অন্ন, বস্ত্র বা বাসস্থানের সংকট ও যান্ত্রিক বিশ্বায়নের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে আমরা যারা ঊনমানুষ হয়ে উঠছি, আমাদের ওপর যারা নব্য ঔপনিবেশিকতা ফলিয়ে মজা লুটছেন, তাদের বিবেক না হয় নির্বিকার নির্লিপ্ত থাকতেই পারে! কিন্তু আমাদের মানুষ বাঁচাতে আমাদেরই আধিকারিকদের কি দূরদর্শী বা মানবিক কিছুই করার থাকতে নেই? যুদ্ধতাড়িত শরণার্থী বা অর্থনৈতিক অভিবাসীতায় নাম লিখতে বাধ্য হয়ে বিশ্ব নিয়ন্ত্রকদের মিলিয়ন ডলারের আদম পাচারের বলি হওয়া আমাদের বঞ্চিত পোড়ামুখো মানুষদের জন্য সাম্রাজ্যবাদিরা তাদের দায় এড়ানোর ভাণ করতে পারে, কিন্তু আমাদের হর্তাকর্তারাও নিজেদের বিবেক বোধ মোড়লদের ঘরেই বন্দি রাখেন কি করে? তবে আমাদের যাওয়ার জায়গা আসলে আর কোথায়?

আমাদের এবার ভিন্নকিছু ভাববারও সময় এসেছে। বাংলাদেশেতো সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়ার পরিস্থিতি বিরাজমান নয়। তারপরও কোন প্রেক্ষিতে আমাদের অভিবাসীদের নিজের দেশে ফেরার চেয়ে গুলি খাওয়াকেই শ্রেয় মনে হয়! অতি লাভ বা লোভের গুড় পিপীলিকায় খেয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির বারোটা বাজাচ্ছে না, তা কে বলতে পারে। বোঝার সময় এসেছে, সাইট ইন্টেলিজেন্স, রিটা কাৎজ, আমেরিকা, মোসাদ, সিআইএ, এফবিআইরা বাংলাদেশে আইএসের খেলাফত প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে-এটা প্রমাণ করতে উঠে পরে লেগেছে কেন?

তাছাড়া এবছরের মাঝামাঝি সময়ে বঙ্গোপসাগর থেকে শুরু করে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার জঙ্গলে যখন শত শত বাংলাদেশির গণকবর আবিষ্কৃত হয়েছিল, তখনো সরকার কিছু না জানার ভান করেছিল। কিন্তু যে নাগরিকটি বিদেশে মালিকের শত অত্যাচার সয়ে, গোলামীর জীবনযাপন করে, জলদস্যুদের গুলির মুখে সমুদ্রে ভেসে ভেসে সোনার ডিম পাড়া হাঁস হয়ে আমার দেশকে অর্থনীতির মধ্যম আয়ে পৌছে দিতে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে যাচ্ছে বা পাঠানোর স্বপ্ন দেখছে তাদের ব্যাপারে আমরা আর কত উদাসীন হয়ে থাকব হে সরকার বাহাদুর?

আমাদের আয়ের প্রধান উৎস বৈদেশিক রেমিট্যান্স। গত অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল এক লাখ ১০ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। অন্যদিকে এক গত ১০ বছরে দেশে এসেছে প্রায় ২০ হাজার প্রবাসী শ্রমিকের লাশ। এই লাশগুলোর দায় কেউ নেয়নি। এই মৃত্যুগুলোর একটা বড় অংশই অস্বাভাবিক। কর্মস্থলের নিরাপত্তা সংক্রান্ত দুর্ঘটনা, অতিরিক্ত কাজের চাপ, অসুস্থতা, বাসস্থান ও খাদ্য সংকট, কর্মস্থলে শারীরিক নিপীড়ন মৃত্যুর সারিকে বড় করেছে। কিন্তু এই অপমৃত্যু বা দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে কোনো মানবিক পদক্ষেপ নিতে আমাদের কর্তাবাবুরা তাদের সময় ব্যয় করবার ফুরসৎ পেয়েছেন, এমনটা জানা যায় না।

উন্নাসিক সেই পুঁজিবাদের সর্বশেষ তোলপাড় করা বলি তুরস্কের তিন বছরের শিশু আয়লান কুর্দি। যে শিশুটি আসলে নিজের প্রাণ দানের মাধ্যমে আক্ষরিক অর্থেই মানবতাকে ভাসিয়ে দিয়েছিল সাগরতীরে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ থেকে বাঁচতে যে আয়লান কুর্দি সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে তুরস্কের বোদরাম সৈকতে মুখ মাটির দিকে করে পড়ে থাকে। এর মধ্য দিয়ে বিশ্ব মানবতাই যেন মুখ থুবড়ে পড়ে। এরপর অবশ্য অভিবাসী নীতিতে পরিবর্তন আনে ইউরোপের নাক উঁচু রাষ্ট্ররা।

কিন্তু গ্রিস মেসিডোনিয়া সীমান্তে আটকে পড়া আমাদের আয়লান কুর্দিদের জন্য বাংলাদেশি বিবেক তথা বিশ্ববিবেকের কোনো হেরফের কি হবে না?
দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়িত হচ্ছে, ঢাকা শহরে রংবেরঙের ফ্লাইওভার হচ্ছে, পদ্মা নদীতে সেতু হবে, মেট্রোরেল, মনোরেল হবে, মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত হবে, দেশ মধ্যম থেকে উচ্চ আয়ে পৌছে যাবে, এর সবই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু যে মানুষের জন্য এতো আয়োজন, এতো কঠিন সাধনা, জীবনপণ ব্রত সেই মানুষেরা কেন বিদেশ বিভূঁইয়ে গুলি খেয়ে মরতে চাইবে? এর জবাব আমরা কার কাছে চাইব?

লেখকঃ সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
২৭ নভেম্বর ২০১৫।
twitter.com/fardeenferdous
facebook.com/fardeen.ferdous