জানথিপি তোমার জন্য টক ঝাল মিষ্টি ভালোবাসা

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 3 Feb 2016, 06:34 PM
Updated : 3 Feb 2016, 06:34 PM


১২ বছর ধরে আমি এক অসাধারণ আগ্রাসী, বোল্ডওয়ালা ও ম্যাজিক্যাল বাঘিনী সাধনায় দার্শনিকে রূপান্তরিত হওয়ার আগে একই পদ্ধতিতে আড়াই হাজার বছর আগে প্রাচীন গ্রীসে সক্রেটিস নামের মহামুনিও দার্শনিক বনেছিলেন। সক্রেটিসের বউয়ের নাম জানথিপি। 'জানথিপি' মানে হলো হলুদ ঘোড়া। ইংরেজি অভিধানকারক নিন্দুক ও নারীবিদ্বেষীরা অবশ্য জানথিপির মানে করেছেন, ill tempered wife বা shrewish woman. তো এই জানথিপি নাকি একবার উত্তেজিত হয়ে সক্রেটিসের মাথায় জল ঢেলে দিয়েছিলেন। সক্রেটিস তখন বলেছিলেন, গর্জনের পরেই নামে বারিধারা। কথিত আছে সক্রেটিসকে তাঁর বউ যখন ঝাড়ুপেটা করছেন, আর সক্রেটিস কিনা শান্তভাবে বই পড়ে যাচ্ছেন। এহেন জানথিপি'র কাছ থেকে উচিৎ শিক্ষা নিয়েই সক্রেটিস বলতেন, বিয়ে করবে। তোমার বউ ভালো হলে সুখী হবে, আর খারাপ হলে হবে দার্শনিক।

আমার বউকে আমি কখনও হলুদ ঘোড়া বলব না। আমার জানথিপিকে আমি বাঘিনী বলেই ডাকি। এই বাঘিনীর সংসারে আমি সুখী কি অসুখী তা বলব না। তবে আমিও এখন সক্রেটিসের মতো প্রবাদবাক্য বলা শিখে গেছি। এই যেমন, তুমি যদি কিছু শিখতে, জানতে বা বুঝতে চাও, তবে বই পুস্তক, গুরুজি বা গুগল মামার দ্বারস্ত হওয়ার কোনো দরকার নাই। ঘরে একজন প্রফেসর বউ ধরে নিয়ে এসো, তবেই কেল্লাফতে।

পন্ডিত সক্রেটিস ছিলেন আমার মতো দেখতে অসুন্দর। জানথিপি ছিলেন ঠিক এর বিপরীত। আধুনিককালে লণ্ডনের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির গবেষকরা নারী পুরুষের মধ্যে জরিপ চালিয়ে দেখেছেন, সুন্দর দেখতে পুরুষেরা ভীষণ স্বার্থপর হয়ে থাকে। গবেষণা থেকে বোঝাই যাচ্ছে, আমি ও সক্রেটিস নিঃস্বার্থ গরীবের বন্ধু। আসলে জানথিপিরা আমাকে বা সক্রেটিসকে পেয়ে হয়ত ধন্য হয়ে গেছেন বা গিয়েছিলেন।

জানথিপির বংশ মর্যাদা ছিল সক্রেটিসের বংশ মর্যাদার চাইতে ভালো। তাই তাদের প্রথম ছেলের নাম রাখা হয়েছিল জানথিপির বাবার নামে। আর আমার একমাত্র কন্যার নাম হেরা। আর আমার বাঘিনী জানথিপির মায়ের নাম কাগজে কলমে ছাহেরা।

সক্রেটিসের বউকে সবাই যখন বদমেজাজি ও কলহপ্রিয় বলে ভর্ৎসনা করত, সক্রেটিস তখন জবাব দিতেন, জানথিপির তর্ক করার স্পিরিটের জন্যই তাঁকে আমি ভীষণ পছন্দ করি। আমিও তাই বলি, তর্কই জীবন, তর্ক না থাকলে জীবন পানসে। পানসে জীবন বইবার শক্তি আমার নাই। অতএব আমার বেঘো জানথিপিকেও আমি খুব ভালোবাসি। কারণ ওর গর্জনের পরও নামে বারিধারা। আর সেই বারিধারায় আমি বেঘোরে স্নান করে বেহুশ হই।

এখন নিশ্চয় এই আখ্যানের প্রারম্ভে বলা আমার দার্শনিক হয়ে উঠবার বৃত্তান্ত আপনারা অনুধাবন করতে পারছেন। তবে আমি যখন ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ কথাবার্তায় আমার দর্শনতত্ত্ব ওর মাঝে ছড়াতে চাই, ও বাজখাই গলায় বলে উঠে, আঃ মলো, মিনসে আমার দার্শনিক না ছাই। আসলে তুমি একটা ধার্ষণিক। জানেন, আমি ওর কথায় খুব ইম্প্রেসড হই। কিন্তু ওকে বুঝতে দেই না। 'বল বীর, চির উন্নত মম শির' এর মতো কোন স্বামী না তাঁর সোহাগী স্ত্রীর কাছে ধার্ষণিক হতে চায়, বলুন? আহা! সোনা বউ যখন এমন করে কথা বলে, স্বামীকে মাথায় তুলে নাচে, তখন কি আর সেই বউয়ের জ্বালাতন বা নির্যাতনে অতিষ্ঠ হওয়া কোনো সুপুরুষেরও সাজে। আসলে সব পুরুষই লাজ লজ্জার মাথা না খাওয়া স্ত্রৈণই। আমি আর আমার গুরুজি সক্রেটিস নাহয় একটু বেশিই।

সক্রেটিস যেমনটা বলতেন, যে মানুষ খাওয়া-পরায় অল্পতেই সন্তুষ্ট, সহজভাবে সরল কথায় সৎচিন্তায় সময় কাটায়, সেই সুখী—আধপেটা খেয়েও সুখী; মানুষের নিন্দা অত্যাচারের মধ্যেও সুখী। সক্রেটিসের বউ সক্রেটিসকে খুব মেপে মেপে টাকা পয়সা খরচ করতে দিতেন। পুরুষ মানুষের মন, অতিরিক্ত টাকা পেলে কোথায় না আবার কি করে বসে। আমাদের জানথিপিও তাই। মাসের শুরুতেও আমার মানিব্যাগ ফাঁকা, আর মাসের শেষে আরও ফাঁকা। তাই আমিও সক্রেটিসের মতো খাওয়া-পরায় অল্পতেই সুখী।

তবে আজকে এক যুগ পার করা বিয়ে বার্ষিকীর দিনে আমার জানথিপি খুব বিনয়ী আহ্লাদী হয়ে উঠেছিল। বলছিল, এমন একটা মাইল ফলকের দিনে তুমি আমায় কি দিলেগো। আমি বললাম, বাঘিনী তুমি এতো চাই চাই করোনাতো। আমিইতো তোমার সব। আর কী চাই! বউ খেপে গেল। কি, তুমি আমাকে বাঘিনী বলছ। নাকের পানি, চোখের পানি এক করে সব কথা ওর মা বাবাকে পাস করে দিল। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, দাঁড়াও তোমাকে বাঘ দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি। বাঘের অভয়াশ্রমে তোমাকে ছেড়ে দেব, তুমি বুঝবে কে আসলে রাক্ষুসে বাঘ আর কে তোমার অতি আপন বউ।

আমি বললাম ঠিক আছে, পরিবারের সবাই গেলে রণে বনে জঙ্গলে যেতে আমি রাজি আছি। ওর মা বাবা ও আমার মা মেয়ে সহযোগে ঘুরতে গেলাম বাঘের বাজারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে। কোর সাফারি পার্কে ঢুকে জীপ ভ্রমণে বের হলাম। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় হলো, দূরে জঙ্গলে বাঘের আবছা ছায়া দেখতে পেলেও বাঘ আমাদের জীপের ধারেকাছে ভিড়ল না।

আমার নমস্য শ্বশুর মহাশয় ও শাশুড়ি আম্মাকে বললাম, বাবা, মা এখন বুঝলেনতো কে আসলে বাঘিনী। ওকে দেখে বনের বাঘও ডর পায়। আর আমিতো সক্রেটিসের শিষ্য সাধারণ মানুষ মাত্র।

আপনারা জানেন না এই বেঘো জানথিপি'র হালুম হুঙ্কারের জন্য আমি ১২ বছরেও ভাজা মাছটি উল্টে খেতে শিখিনি। এবার আমার ওয়েডিং ডে ট্রাজিক আখ্যানের বিমোক্ষণ পর্ব। আমার বউয়ের সেকি কান্না। ওর স্বজনদেরও আখি ছলছল। এমন সময় আমার প্রাণের সখা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসে মনের আয়নায় দাঁড়ালো। বলল, এই গাঁধা, বহুত হয়েছে। যথাসময়ে থামাটাও একটা আর্ট। থামতে জানতে হয়। তোর জন্য একটি গান লিখেছি। নে, এই আনন্দের দিনে তোর বউ জানথিপিকে গানটা ডেডিকেট কর।

বধু কোন আলো লাগল চোখে
বুঝি দীপ্তিরূপে ছিলে সূর্যালোকে!
ছিল মন তোমারি প্রতীক্ষা করি
যুগে যুগে দিন রাত্রি ধরি,
সুন্দর হে, সুন্দর হে…

ফারদিন ফেরদৌসঃ জানথিপি'র দার্শনিক স্বামী।
০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬
facebook.com/fardeen.ferdous.bd
twitter.com/fardeenferdous