ভালোবাসা অফুরান : ফ্রম ইওর ভালেন্টাইন

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 13 Feb 2016, 04:23 AM
Updated : 13 Feb 2016, 04:23 AM

ভালোবাসার দিনে কোনো কথা হবে না! কোনো কিছু প্রাপ্তির আশা বাদ দিয়ে শুধু নৈঃশব্দের অপার অনুভবে চোখে চোখ রেখে হৃদয়ে হৃদয় মিলিয়ে দয়িত বা দয়িতার সাথে অমৃত ভাব বিনিময় হবে সারাবেলা। কথার জাদুতে গড়া প্রেমের কারিগর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমনটা বলেছেন,
অনেক কথা যাও যে ব'লে কোন কথা না বলি।
তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি।।
অন্যদিকে ইংরেজ কবি ও নাট্যকার শেকসপিয়র বলেছেন,
Speak low, if you speak love!

ভালোবাসার বরপুত্রদ্বয় উইলিয়াম শেকসপিয়র ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর খোদ ভালোবাসা নিয়ে যতই কম কথা বলার উপদেশ দিন বা প্রিয়স্পদের ভাষা না বোঝার আশা জলাঞ্জলি দিন। আসলে ভালোবাসার সকল ব্যথা, সকল কথা, আশা নিরাশার যত দোলাচল তার সবটাই বলে গেছেন এবং সবটাই বোঝে গেছেন তাঁরা।

১৪ ফেব্রুয়ারি। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস বা ভ্যালেন্টাইনস ডে। ২৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমের সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াসের আমলে চিকিৎসক ও খ্রিস্ট ধর্মের প্রচারক কারাগারে বন্দি সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের সাথে কারারক্ষীর অন্ধ মেয়েও দেখা করতে আসত। একসময় তাঁর চিকিৎসায় মেয়েটি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলে তাঁদের মধ্যে ভালো লাগার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আর এ অপরাধেই ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। ভ্যালেন্টাইন তাঁর লেখা শেষ চিঠিতে প্রেয়সীকে লিখেছিলেন 'ফ্রম ইওর ভ্যালেন্টাইন'। ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে পোপ প্রথম জুলিয়াস এ দিনটিকে ভ্যালেন্টাইনস ডে হিসেবে ঘোষণা করেন। আর আমাদের দেশে ভ্যালেন্টাইনস ডে উদযাপনের সুযোগ এসেছে নব্বইয়ের দশকে এক কচ্ছপপ্রাণ প্রেমিকপুরুষের রাজত্বকালে। আবার বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনের মৌসুমে ঐ ভেরি আনপ্রেডিক্টেবল বিশ্বপ্রেমিকের বিশাল গুণমুগ্ধ হয়ে ওঠেন আমাদের দেশের সর্বদা বিপরীতমুখো দুই মহান নেত্রী। কাজেই ভালোবাসা দিবস প্রচলনের কৃতিত্ব মহিয়ষী নেত্রীদের ওপরও বর্তায় বটে। তবে মাঝখানে এক নিপুণ অনুঘটক ছিলেন লাল গোলাপের বিখ্যাত এক প্রেমিক সওদাগর।

ভালোবাসা একটি অতি আনন্দদায়ক মানবিক অনুভূতি যেটা একজন মানুষ অপর আরেকজন মানুষের প্রতি অনুভব করে। এমন একটি আবেগকেন্দ্রিক অভিজ্ঞতায় কারো প্রতি অতিরিক্ত যত্নশীলতা, নিঃস্বার্থতা, বন্ধুত্ব, মিলন বা আকাঙ্ক্ষা অনুভূত হয়। তবে এই ইচ্ছাটা কেবল যে, মনুষ্য হয়ে মনুষ্য প্রজাতির প্রতিই দুর্নিবার হয়ে দেখা দেয় বিষয়টা এমনও নয়। আপনার ভালোবাসাটা তেঁতুল জাতীয় দ্রব্য চিন্তায় জিভে লালা ঝরা, ককটেল বা পেট্রোল বোমায় গরীবের জীবন ছাড়খার করা, হাতে বড় হুজুরের চুমু খেয়ে থুথু লাগিয়ে চুটিয়ে গলফ খেলতে যাওয়া বা সংবিধানকে প্রভুত কাটাছিড়া করে আপন খায়েশ মেটানো জাতীয় বিষয়াবলীর প্রতিও অনুভূত হতে পারে। ভালোবাসার প্রকাশটা অনেকটা নানামুখী আপেক্ষিকতার ওপর নির্ভরশীল।

মনে রাখলে ভালো কিংবা কারো ক্ষেত্রে হতে পারে অতিশয় মন্দ! ভালোবাসায় কবি পুর্ণেন্দু পত্রীর, 'কালকে তোমার ডাল ভেঙ্গেছি, ফুল ছিড়েছি/ ঝাপ দিয়েছি সর্বনাশের গোল আগুনে/ ঝাপ দিয়েছি উপোস থেকে ইচ্ছা সুখের লাল আগুনে'র মতো যৌনবাসনা কিংবা শারীরিক লিপ্সা একটা গৌণ বিষয়। তবে মানবিক আবেগটাকে গুরুত্ব দিয়ে কল্পনাবিলাসিতায় গা ভাসানোর উৎকৃষ্ট ক্ষেত্র মহান ভালোবাসা।
আসুন এবার এই ভালোবাসা দিবসে কল্পনাবিলাসিতা বা রোমান্টিসিজমে আমরা গা ভাসাই প্রিয়তমেষুর হাতে হাত ধরে ও নয়নে নয়ন রেখে। আজ এই মুহুর্ত থেকে ভালোবাসার ঋনাত্বক অনুভূতি ঘৃণাকে আমরা প্রচন্ডভাবে ঘৃণা করতে শিখি।

আমাদের মহান দুই নেত্রীর এতো বাদ বিসংবাদ, ঝগড়াঝাটি কিংবা একে অপরকে গোলাপী বা গোপালী বলে বকঝকা করার যুদ্ধংদেহী জোশ সবটাই ভালোবাসার জন্য। রুলিং পার্টির নেত্রী হাজার জনমভরে আম আদমীকে ভালোবাসতে চান। সেই চুইংগাম সদৃশ ভালোবাসাটাকে আরো পুক্ত করতে পাশে ধরে রাখতে চান বিশ্বপ্রেমিক গলফারকে। অন্যদিকে তারও অধিক আমজনতাকে ভালোবাসতে চান কূটচালে ধরাশায়ী সংসদের বাইরে থাকা বিরাট পার্টির নেত্রীও। সেই ভালোবাসাকে মজবুত ও জোরদার করতে গরুর যেমন জোয়াল তেমন করে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখতে চান বিশ্ব পাকিপ্রেমিদের। বিশ্বপ্রেমিক ও পাকিপ্রেমির ছায়াদানকারী এহেন বটবৃক্ষদের অমৃত প্রেম আপনারা প্রত্যাখ্যান করবেন সেই দুঃসাহস যেন কস্মিনকালেও না ঘটে।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি'র নিতাইয়ের মুখের সেই অমোঘ বাণী, ভালোবেসে মিটিল না সাধ/কুলাল না এক জীবনে/ হায়রে জীবন এত ছোট কেনে? এর মতো করে রুলিং পার্টির নেত্রীর ভাবনা জগতেও আজ ভালোবাসার দিনে কেবল একটাই কথা, আমি ষোল কোটি বাঙালিরে আরও বেশি প্রাণভরে ভালোবাসিবারে চাই। সময় এতো ছোট কেনে?

অন্য দিকে বিরাট পার্টির নেত্রীর মনটা জুড়েও আজ উথাল পাথাল ঢেউ'র ছড়াছড়ি। হায় কীভাবে কোন উপায়ে বাংলাদেশি বীর জনতাকে আরও বেশি ভালোবাসিবারে পারি। ভালোবাসা কেন যে এতো যন্ত্রণা দেয়? রবীন্দ্র সঙ্গীত ভালো না বাসলেও ঐ ভিনদেশি কবি কোলেই আশ্রয় খুঁজতে হয় তাঁর। রুলিং পার্টিকে হটিয়ে পাল্লায় ভারি ভালোবাসায় ষোলকোটি বাংলাদেশিকে মাখামাখি করতে না পারার শোকে বিরাট পার্টির নেত্রীর মনোবীণায় আজ করুণ সুর মূর্ছনা। সখী ভালোবাসা কারে কয়?/ সে কি কেবলই যাতনাময়?/ সে কি কেবলই চোখের জল/ সে কি কেবলই দুখের শ্বাস/ লোকে তবে করে কী সুখেরই/ তরে এমন দুখের আশ।

মহান ভালোবাসার দিনে উন্মনা অতি সাধারণ আপনার জন্য এতো পাগলপণ ভালোবাসা যে দেশমাতা নেত্রীদের বক্ষজুড়ে তাদের জন্য প্রাচীন গ্রীক ভালোবাসার ফর্ম মেনে ফ্যামিলারিটি, ফ্রেন্ডশিপ বা রোমান্টিক না হোন, অন্তত ডিভাইন ভালোবাসার ডালি সাজাবেন না? আপনার জন্য যাদের এতো উছলে পড়া মাখোমাখো দরদের উপচে পড়া বাড়াবাড়ি তাদের দিকে নেক নজরে তাকাবেন না? কেবল আপনারই জন্য রবীন্দ্র সঙ্গীত কিংবা তারাশঙ্করের সত্য সুন্দরে আস্থা রেখেছেন যারা তাদের জন্য কবিগুরুর ভাষায় ভালোবেসে সখী, নিভৃত যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরের মতো করে না হোক, ইংরেজ কবি John Keats এর মতো করে 'Beauty is Truth, Truth Beauty'-that is all. উচ্চারণ করবেন না? নিশ্চয় তাদের ভালোবাসায় থাকবেন এবং ভালোবাসায় রাখবেন।

তাই আসুন বাঙালির বসন্ত বেলায় জীবনের সমস্ত বিরস ভাব দূরে সরিয়ে রেখে মহাসমারোহে উদযাপন করি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। সেইসাথে আমার প্রিয় বাংলা মাকে প্রাণান্ত ভালোবাসায় বুকের ঘরে রাখতে ও নিজেরা ভালো থাকতে মহান ভালেন্টাইনস ডে'তে পলাশ রাঙ্গা পত্রপটে সেই মহিয়ষী দুই নেত্রী'র উদ্দেশ্যে লিখে রাখি সবচে' সুললিত, সুন্দর ও চির সত্য বচন। আমিও তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি সুপ্রিয় খালেদা ও সুপ্রিয় হাসিনা।
'ফ্রম ইওর ভালেন্টাইন' আম জনতা।

লেখকঃ সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬