অদম্য বাংলাদেশের বিজয়কেতন উড়ছে ওই!

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 6 March 2016, 12:25 PM
Updated : 6 March 2016, 12:25 PM


নববর্ষ ও বৈশাখ আসতে এখনও সোয়া মাস বাকী। তবু এই মাঝ বসন্তে এক ভিন্নধারার বোশেখী ঝড়ো হাওয়া বয়ে চলেছে দেশব্যাপী। এ ঝড় চ্যালেঞ্জের, নিজেকে প্রমাণের, ক্রিকেটামোদকে হিমালয়ের চুড়ায় অধিষ্ঠানের। বিশ্বের অন্যতম ক্রিকেট পরাশক্তি ভারতকে আমরা আমাদের সাথে মল্লযুদ্ধে লড়বার আহবান জানাচ্ছি। আজ মিরপুরের শেরেবাংলা কুরুক্ষেত্রের ২২ গজ হয়ে উঠুক 'কেউ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান'…!

আজকের এশিয়া কাপ টি-২০ ক্রিকেট ফাইনালে ভারত বাংলাদেশ দ্বৈরথ নিয়ে দেশের টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত চলছে টান টান উত্তেজনা। এমন আবেগের, এমন উৎসবের আর এমন উন্মাদনার দিনটিইতো আমরা এতোদিন চেয়ে এসেছিলাম ক্রিকেট বিধাতার কাছে। ১৯৯৭ সালে মালেশিয়ায় আইসিসি ট্রফির ফাইনালে কেনিয়াকে হারিয়ে আমাদের যে ক্রিকেটযাত্রার শুরু, টি-২০ তে এশিয়া শ্রেষ্ঠ শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের দেয়াল টপকে আজ তা ভারতীয় চ্যালেঞ্জের রণসম্মুখে দন্ডায়মান। আমাদের অকুতোভয় অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা'র বীর ব্যাঘ্র বাহিনীর প্রতি ভালোবাসা, আস্থা, বিশ্বাস আর অকুন্ঠ সমর্থনে আজকের বসন্তের রঙিন দিনটা আরো বহুবর্ণিল উঠুক না!

চুড়ান্ত সমরে নামবার আগে নিজের শক্তি, সামর্থ্য ও মনোবলের শেষ বিন্দু দিয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়া মাশরাফি 'দল বাংলাদেশ'কেই তাঁর শক্তি বলে মানছেন। তার ওপর বাঙালি ভক্তের ভালোবাসাই সেই শক্তিতে সুপার টনিক সোনায় সোহাগা ওঠবে নিশ্চয়। অন্যদিকে ভারতের অধিনায়কও বাংলাদেশকে চ্যালেঞ্জ মানছেন। তবে ভারত দলের পরিচালক রবি শাস্ত্রী বাংলাদেশকে পাত্তা দিতে চাইছেন না। কারণ কাগজে কলমে তারা নাম্বার ওয়ান আর আমরা কেবল এগার থেকে দশে পা রেখেছি। অতি অহংকার যদি পতনের মূল হয় বা দর্প চূর্ণের কারণ হয়ে উঠে তাহলে আনন্দের শেষ বানভাসি হাসিটা কেবল আমাদেরই অধর ওষ্ঠের লীলাকীর্তন হয়ে উঠবে না, তা কে বলতে পারে প্রিয় রবি শাস্ত্রী?

শাস্ত্রী মহাশয় আপনাদের সতীর্থ শ্রীনিবাসজিও গেল বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে আমাদের ছিটকে ফেলে দিয়েছিল। সেই শ্রীনি এখন নিজেই হামবড়া আইসিসি'র উঠোন থেকে বিতাড়িত। তবুও মাথামোটা আইসিসি'র নির্বুদ্ধিতার ঘোর এখনও কাটেনি। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের এশিয়া কাপ ফাইনাল আজ। বাংলাদেশ দলের সব ধ্যানজ্ঞান এখন ওই ম্যাচ ঘিরেই। অথচ আইসিসির হিসাবে বাংলাদেশের গতকাল থাকার কথা কিনা ধর্মশালায়! টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রস্তুতি ম্যাচে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ হওয়ার কথা ছিল হংকং! কিন্তু এশিয়া কাপের ফাইনালে উঠা লাল সবুজ বাংলাদেশ দলকে হিসাবে না ধরা আইসিসির হঠকারি সূচিটাকেই কিনা আমাদের মাশরাফিরা বানিয়ে দিয়েছে হাস্যকর। তাই একথা বলাই যায়, আমাদের আজকের ক্রিকেট ম্যাচটা আইসিসি'র সেইসব কর্তাব্যক্তির বিরুদ্ধেও। কারণ আজ তাদের ভাষায় বিগ থ্রি'র অন্যতম পরাশক্তি ভারতের পক্ষে দ্বাদশ প্লেয়ার হয়ে তারাও মাঠে নামতে পারেন বোধ করি।

কিন্তু আমাদের অজেয় মাশরাফির এসবের পরোয়া করলে কি চলে? আমরা জানিই কাঁটা বিছানো পথেই আমাদের হাঁটতে হয়। সাত সমুদ্র তেরো নদীর সহস্র উত্থান পতন পাড়ি দিয়ে জয়ের সুবর্ণ বন্দরে ক্রিকেটিয় তরি নোঙ্গর করতে হয়। আর এভাবেই আমরা হোয়াইট ওয়াশ করি জিম্বাবুয়ে, নিউজিল্যান্ড বা পাকিস্তানকে। সিরিজ হারাই ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে। অস্ট্রেলিয়া আমাদের বাজিয়েই দেখল না, তাই তাদের ললাট লিখন জানা হলো না। ক্রিকেটের আলোকিত ভোরবেলায় আমরা যতবার ক্রিকেটের অনিন্দ্য সুন্দর গান গেয়ে আইসিসি'র ঘুম ভাঙাতে যাই ততবারই তাদের বাতায়ন থেকে অপমানের ঢেলা খেয়ে চলেছি। ওদের জন্যইতো সেই কবে কবিগুরু স্বর্ণকমলে লিখে রেখেছিলেন, তোমারে কি বারবার করেছিনু অপমান/ঘুম ভাঙাইলে ব'লে মেরেছিনু ঢেলা।

কিন্তু যাদের মাশরাফির মতো বুক পেতে দেয়া সর্বংসহা অধিনায়ক থাকে তাদের অপমানে কিইবা যায় আসে। ছয়/সাতবার সার্জনের ছুরির নিচে ফালা ফালা হয়েছে যে মাশরাফির হাঁটু। সেখান থেকেই বারবার ফিরে এসে দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সাকিব, মুশফিক, তামিম, সৌম্য, সাব্বির, আল আমিন, মাহমুদউল্লাহ, মুস্তাফিজসহ সব ছেলেকে বুকে আগলে রাখছেন। খেলার ক্রান্তিকালে নিজে দায়িত্ব নিয়ে বদলে যাওয়া নতুন বাংলাদেশের ক্রিকেটকাব্যের সাফল্য পাখায় বাহারি পালক সাজিয়ে চলেছেন। তাইতো আমরা ১৬ কোটি বাঙালিই সুখে দুঃখে, জয় পরাজয়ে এই মাশরাফিরই সারথি। আমাদের হয়েই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নোবেলজয়ী গীতাঞ্জলি কাব্যে যেমনটা লিখেছিলেন,
নম্রশিরে সুখের দিনে
তোমারি মুখ লইব চিনে,
দুখের রাতে নিখিল ধরা
যেদিন করে বঞ্চনা
তোমারে যেন না করি সংশয়।

ভারত বাংলাদেশের আজকের ফাইনালের এই মাহেন্দ্রক্ষণে সেই মাশরাফি ও তাঁর শার্দুল বাহিনীর শুভ কামনায় আমরা এই একটা দিন মনে করব যে, আমাদের শিশুরা খুব নিরাপদে আছে, মানবিকতা ও বিবেকরা এখনও ভালোমতোই বেঁচে আছে, নির্বিচারে কেউ গুম বা খুন হয়ে যাচ্ছে না, ঘুষের জন্য অধিকর্তার টেবিলে ফাইল আটকে থাকছে না, শ্রমের তুলনায় বেতন কম বলে শৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ ট্রাকের কাছে ভিক্ষুকের মতো হাত পেতে টাকা নিচ্ছে না, কারো মুখের কথা কেড়ে নেওয়ার হুমকি দেয়া হচ্ছে না, গোপন লোভ বা প্রাপ্তির ঘেরাটোপে সাংবাদিকের প্রতিবাদ বা লেখনি থমকে যাচ্ছে না, হাসপাতালে নানা ছুতোয় ডাক্তাররা রোগীর পকেট কাটছেন না, রাজধানীতে একদম যানজট লাগছে না, কোথাও ধর্ষিতা মা বোনের আহাজারিতে পরিবেশ ভারি হয়ে উঠছে না, আমাদের শ্রমিকেরা ন্যায্য মুজুরি পাচ্ছেন, কোথাও কোনো দুঃখ, বেদনা বা কান্নার রোল নেই। কি ধনী, কি গরিব, কি গেঁয়ো, কি নগরবাসী, সবখানেই সুখের বাড়াবাড়ি, আনন্দ হইহল্লোড়! এমন দিনে আবারও সমস্বরে গাইব না কেন, জয় বাংলা, বাংলার জয়!

আমাদের একতা, শক্তি, নিষ্ঠা, সাহস, ক্ষিপ্রতা, তেজ, প্রজ্ঞা, ত্যাগ ও দৃপ্ত মনোবল দিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে বীরের মতো লড়াই করে দেখিয়ে দেব, আমরাই এশিয়া শ্রেষ্ঠ। অদম্য বাংলাদেশের বিজয়কেতনই উড়াবো আজ সমুদয় ক্রিকেটবিশ্বে!

লেখকঃ সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
০৬ মার্চ ২০১৬
twitter.com/fardeenferdous
facebook.com/fardeen.ferdous.bd