পহেলা বৈশাখঃ অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 9 April 2016, 06:15 PM
Updated : 9 April 2016, 06:15 PM

নতুন প্রাণের জয়গান ও নতুন দিনের আহ্বানে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম উচ্চারণ করেছিলেন, তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ ঐ নূতনের কেতন ওড়ে/ কাল-বোশেখির ঝড়। এটা ছিল কবির শ্বাশ্বত বৈশাখি বন্দনা। কিন্তু এখন বেঁচে থাকলে এইসময় আমাদের সেই বিদ্রোহী কবি এমনভাবে কথাগুলো নিশ্চিত বলতে পারতেন না। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁকে বলা হতো, বৈশাখের বাতাস অনুভব করবার পর থেকেই জবান বন্ধ করে দিয়ে আপনি ঘরে বসে থাকবেন। মন চাইলে পান্তা ইলিশ খেতে চুপি চুপি রাষ্ট্র নির্ধারিত রেস্টুরেন্টে যেতে পারবেন বটে, তবে ভুলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় বৈশাখ বিষয়ক কোনো পোস্ট দেবেন না; তাতে যুবাদের মাথায় বৈশাখি ভূত চাগাড় দিয়ে উঠতে পারে। যুবাদের যেই ভূত সুশৃঙ্খলভাবে নিয়ন্ত্রণের সামর্থ রাষ্ট্র রাখে না। অতএব এসেছে বৈশাখ; খামোশ থাকুন কথকতার কবি!

১৪২২ বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখে নারী নিপীড়নকে কেন্দ্র করে গেল এক বছরজুড়েই দেশে হাজারটা মেলোড্রামা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বর্ষবরণে যৌন নিপীড়নের ঘটনায় হাইকোর্টের রুল থাকবার পরও নৌমন্ত্রীর মতো কিছু শাসক শ্রেণির ব্যক্তিত্বরা যৌন হয়রানিকে 'বিষয়ই না' বলে উল্লেখ করে গেছেন। এমনকি আরক্ষা প্রধানের মতো দায়িত্বশীল আধিকারিকরা পর্যন্ত ঐ ঘটনাকে 'বর্ষবরণে এমন একটু আধটু ঘটতেই পারে' বলে বাচনিক প্রহসন মঞ্চস্থ করে গেছেন। এছাড়া ঐ বর্ষবরণের দিন যৌন হয়রানির ঘটনায় ৮ নিপীড়ক চিহ্নিত করার কথা জানিয়ে লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েও সরকারের তরফে শুভঙ্করের ফাঁকিটাই সারবত্তা হিসেবে দেখা গেছে।

এমন বাস্তবতায় ১৪২৩ বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখ সমাগত প্রায়। অসাম্প্রদায়িক বাংলার আকাশে বাতাসে ধীরলয়ে ধ্বনিত হতে শুরু করেছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই অমর পঙক্তিমালা, এসো হে বৈশাখ, এসো এসো/ তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।
কিন্তু আমাদের সেই স্বতঃস্ফুর্ত বৈশাখি আনন্দকেই কিনা রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধের বেড়াজালে আটকে দেয়া হলো। উদযাপনে আরোপ করা হলো কড়াকড়ি!

সরকারী ঘোষণা এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের জবানিতে ইতোমধ্যেই জানা হয়ে গেছে যে, বাংলা পঞ্জিকার নতুন বছরের প্রথম দিন সন্ধ্যা ৬টার পর 'রাস্তা পরিষ্কার করতে' মাঠে নামানো হবে পুলিশ। সুতরাং ৫টার পর ঘরের বাইরে থাকা মানা। মুখোশে মুখ ঢেকে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ এবং ভুভুজেলা বা বিকট আওয়াজের বাঁশি ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকবে। ইলিশের আকালের দিনে বাড়িতে পান্তা ইলিশ নয়, ঢাকার অভিজাত হোটেলসহ জেলা পর্যায়ের হোটেলগুলোতেও ঐতিহ্যবাহী বাংলা খাবার পরিবেশনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। খানাখাদ্যির পর্বটা সেখানেই সারতে হবে। মঙ্গল শোভাযাত্রায় বাঙালি কৃষ্টি ও সংস্কৃতির পরিচয়বাহী মুখোশ ব্যবহারেও কড়াকড়ি আরোপের কথা বলা হয়েছে।
মজার ব্যাপার হলো, এইভাবে শাক দিয়ে মাছ ঢেকে অথবা মাথা ব্যথায় মাথা কেটে ফেলবার যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে কীভাবে যৌন নিপীড়কদের নিবৃত্ত করা হবে তা কেউ বলছে না! বৈশাখে যদি নিজের স্বাধীনমতো কাঁচা-লঙ্কা-পেয়াজ, আলু ভর্তা এবং ইদানিংকার ঐতিহ্য ইলিশ ভাজা দিয়ে পান্তা ভাতই না খেতে পারে; যদি মনের আনন্দে বৈশাখি সাজে সজ্জিত হয়ে শোভাযাত্রায়ই অংশ নিতে না পারে তবে ঐ বর্ষবরণ দিয়ে আসলে বাঙালি মন কতটা ভরবে তা কে জানে?

তবে চিরায়ত বৈশাখ উদযাপনে নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে আনন্দপিয়াসী মানুষকে হোটেল রেঁস্তোরার ঘুপচি ঘরে ঠেলে দিয়ে মুক্তচিন্তার দামামা আর কেউ বাজাতে পারবেন না। বরং মুখ ফুটে সরকার বাহাদুরের বলবার সময় এসেছে, যে উগ্রবাদী গোষ্ঠী বৈশাখি উতসবকে অনৈসলামিক বা বিজাতীয় সংস্কৃতি বলে দূর দুর ছাই ছাই করে গলা ফাটায়, দাবার ঘুঁটিটা তাদের ঘরে ঠেলে দিয়ে জাত গেলে জাত গেল বলে এক মহারণ খেলবার সুযোগই অবশেষে দেয়া হলো। তার ওপর সরকারের এমন সিদ্ধান্তে গেল বাজেটে ঘোষিত সরকারী চাকুরেদের মূল বেতনের ২০ ভাগ নববর্ষ ভাতা দেয়ার ঘোষণায় বৈশাখকে যতোটা তাৎপর্যমন্ডিত করা হয়েছিল, তা পুরোমাত্রায় নস্যাৎই করা হলো বলে মনে করা যায়।


৫০০ বছর আগে ভারতবর্ষের শাসক আকবরের আমলে রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য যে বর্ষগণনা পদ্ধতির প্রবর্তন করা হয়েছিল। কালক্রমে সেই বাংলা বর্ষের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ বাঙালির সার্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। গত চার দশক ধরে রাজধানীতে বর্ষবরণের মূল আয়োজন হয়ে উঠেছে রমনা বটমূলে ছায়ানটের প্রভাতী অনুষ্ঠান। আর চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা এই উৎসবের অন্যতম প্রধান আয়োজন। সকল সম্প্রদায়ের সহজাত সম্মিলনের এমন স্বতঃস্ফূর্ত কার্নিভাল বাংলাভূমে আর দ্বিতীয়টি নেই।

হাজার বছরের কষ্টিপাথরে নিখাদ হতে হতে যেকোন জাতিগোষ্ঠির আপন সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। বাঙালির বর্ষবরণও তেমনি একটি সাংস্কৃতিক উৎসব। সেই সর্বজনবিদিত স্বাজাত্য উৎসবের টুটি চেপে ধরে বাঙালি মানসিকতায় এক উন্নাসিক বিকারকে আহ্বান করা হচ্ছে না তো? যেখানকার মানুষেরা অসাম্প্রদায়িক বুদ্ধিবৃত্তিকে পরিত্যাগ করে হয়ে উঠতে পারে সাম্প্রদায়িক দাঁতাল। এর পরিণতি কতোটা শুভ হতে পারে প্রিয় সরকার বাহাদুর? বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করবার অসামর্থতাকে নিবৃত্তের অন্ধকারে ঠেলা দেয়া আপনাদের অধিকার নয়। বরং আমাদের ইচ্ছেঘুড়ির উড়বার মতো করে আনন্দ উৎসব আর হৈ হুল্লোড়ের মধ্য দিয়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা, নারী-পুরুষ বা শিশু নির্বিশেষে মুক্তপ্রাণ নিয়ে বর্ষবরণ আয়োজনে অংশ নিতে দিন। মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যবোধ জেগে উঠবার সুযোগ দিন। বৈশাখি চেতনায় বাঙালি মানুষকে একসূত্রে গাঁথা থাকবার প্রেরণা দেয়া হোক। চিহ্নিত কিছু অসভ্য অযাচারি মানুষের দূরাচারকে জুজু বানিয়ে বর্ষবরণকে নিষেধাজ্ঞার বলি বানিয়ে আপন সংস্কৃতির মৃত্যুঘন্টা বাজাবেন না।

মহান একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সেই দুর্বিষহকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথিতযশা কন্ঠশিল্পী আপেল মাহমুদ গেয়ে উঠতেন, বৈশাখেরই রুদ্র ঝড়ে/ আকাশ যখন ভেঙে পড়ে/ ছেঁড়া পাল আরও ছিঁড়ে যায়/ তবু তরী বাইতে হবে।। শত প্রতিকূলতার মাঝেও তীর হারা ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিয়ে তাঁরা নিজেদের তরী পাড়ে ভেড়াতে ভুলেননি। আমরা এভাবেই একটা স্বাধীন সোনার দেশ পেয়েছিলাম। সেসময় মুক্তিযোদ্ধারা পেরেছিলেন। আর আমরা পারব না পারি না ইত্যাদি বলে নানা বিধিনিষেধের ভয়ঙ্কর জাল বুনে চলেছি। শকুন শ্বাপদের ভয়ে ভীত হয়ে পিছিয়ে গিয়ে আর কতোটা অন্ধকার হাতড়ে আলোকিত পথের দিশা খুঁজব বলতে পারেন শাসকগোষ্ঠী?

আজ সময় এসেছে অন্ধকারের সারথিদের অকর্ম বা কুকথায় পাত্তা না দিয়ে ভয়কে জয় করবার। আমাদের নবীণ প্রজন্মকে বন্দিত্বের গুহাবাসের মধ্য দিয়ে ভীতি রাজ্যের গিনিপিগ বানাবেন না প্লিজ। তাদেরকে মুক্ত বিহঙ্গের মতো ডানা মেলতে দিন। তাদের হাত ধরেই আসুক অধিকতর বর্ণিল সোনালি দিন। নিষেধাজ্ঞার ঘেরাটোপে বৃত্তবন্দি পহেলা বৈশাখকে মুক্তি দিন। অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক। বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক। মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা। মানুষের স্বনির্ভরতা ও সম্প্রীতিতে দেশটা এগিয়ে যাক আর হাজার বছর বেঁচে থাকুক পহেলা বৈশাখ!

লেখকঃ সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
২৭ চৈত্র ১৪২২
facebook.com/fardeen.ferdous.bd
twitter.com/fardeenferdous