অপূর্ণ হালখাতায় মুখ ও মুখোশের পহেলা বৈশাখ

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 13 April 2016, 01:01 AM
Updated : 13 April 2016, 01:01 AM

সেকালে পহেলা বৈশাখে নূতন বর্ষবরণে এতদাঞ্চলের ভূমি মালিকরা নিজ এলাকার অধিবাসীদের মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকায় পুরনো হিসাব বই বন্ধ করে এদিন হালনাগাদ হিসাবের হালখাতাও তৈরি করতেন। আর একালে বর্ধিত সুগারের জাতীয় উৎপাতের দিনে মিষ্টান্ন বা গ্রীষ্মের ফলাহারকে পেছনে ফেলে জায়গা দখল করেছে সানকির আদিখ্যেতায় পরিবেশিত কাঁচা লঙ্কা ও জলভাত। সাথে এরশাদীয় বাণিজ্যিক ভোগবাদীদের চালু করা জাতীয় মৎস ইলিশের অকাল আস্বাদ। তবে একদম বদলায়নি আম জনতার বঞ্চনার অপূর্ণ ইতিহাস। যার পাতে লঙ্কাভাতই জুটে আটেপক্ষে, সেখানে বৈশাখের ডামাঢোল তাঁর সাজে না।

এটা ১৯৭৪ সাল নয়; জাদরেল কবি রফিক আজাদও বেঁচে নেই। তবু ভাত দে…নইলে মানচিত্র খাবো'র মতো করে মাটির সানকি হাতে ভুখানাঙ্গা পাটকল শ্রমিকদের 'ভাত দেন প্রধানমন্ত্রী…নইলে সংবিধান খাবো' বলে এখনও শ্লোগান তুলতে হয়।

অতঃপর এবারের পহেলা বৈশাখের দু'দিন আগে আন্দোলনরত আমাদের পাটকল শ্রমিক ও কর্মচারীদের বকেয়া পরিশোধ ও পাট কেনার জন্য সরকার এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নেয়। বঞ্চিত শ্রমিকের লড়াই করবার দ্রোহ আর করুণ মুখের আর্তি মধ্য আয়ে প্রগলভ বায়োমেট্রিক সরকারের চেপে রাখা মুখোশ খসিয়ে দিতে পারে অবশেষে। অন্যদিকে এরও সপ্তাহখানেক আগে বাঁশখালীতে এস আলম গ্রুপের নির্মাণাধীন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রতিবাদ করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারায় স্থানীয় ৪ বিদ্রোহী ভূমিপুত্র। পরিবেশদরদি বিশ্ব যেসময় কয়লা বিদ্যুৎ বাদ দিয়েছে আর আমরা সেসময় তা লুফে নিচ্ছি। একে উচ্ছিষ্ট ভোগবাদিতার নড়বড়ে জাতীয়তাবাদ ছাড়া আর কীইবা বলা যায়? নিজের ভিটেমাটি বাঁচাতে নিঃশেষে প্রাণ দেয়া মুখগুলো তাদের স্বজনেরা আর কোনোদিন দেখবে না। এমনতর কিছুটা প্রাপ্তি ও আর গভীরতর অপূর্ণতার মধ্য দিয়েই বাঙালির বেদনার্ত হালখাতা পা রাখল নতুন বছরে। তাই আমাদের মতো আন্দোলনে বাঁচা ভুখা নাঙ্গাদের দেশে মুখ ও মুখোশের পহেলা বৈশাখ বরাবরই এক অপূর্ণ হালখাতা।

অথচ বৈশাখের আসবার কথা ছিল পুরোনোকে বর্জন করে নতুনের আবাহনের মঙ্গল গীতসম্ভার নিয়ে। বছরের যত আবর্জনা, যা কিছু মৃত, জরা, গ্লানি বৈশাখি বাতাসে কালের গহ্বরে মিলিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কবিগুরুর ভাষায়, তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে উড়িয়ে দিয়ে অগ্নিস্নানে শুচি হওয়ার কথা ছিল আমাদের। কবি নজরুল ইসলাম যেমন মহানিশার শেষে জরায় মরা প্রাণ লুকানো মুমূর্ষুদের বিনাশ কামনা করে অরুণ হাসির ঊষা উৎসবের স্বপ্ন দেখে জয়ধ্বনি করবার আহ্বান জানাতেন। কবি ভাবতেন, কালবোশেখির ঝড়ের সাথে মৃত্যু গহন অন্ধকূপের সিংহ দ্বারে ধমক হানা আগল ভাঙা প্রলয় নেশায় মত্ত বজ্র শিখার মশাল জ্বেলে কেতন উড়িয়ে এক ভয়ংকর নৃত্য পাগল নূতন আসবে। কিন্তু আমাদের বৈশাখের নবতর আগমনীরা আজ বিষাদসঙ্গীত! তার পেছনে ফেলে আসা বর্ষযাপন এক ট্রাজিক খেরোখাতা। তাই দুঃখ জাগানিয়া সেই বর্ষবরণে নিষেধাজ্ঞার বিনা ভুঁভুঁজেলা জ্বালা ধরাতে পারে, সাধ্য কি? আসলে প্রান্তিকজনের মুখে চারুকলার ঐতিহ্যিক মুখোশসমেত মঙ্গলশোভাযাত্রার আশীর্বাণী পৌঁছল কি পৌঁছল না তার খবর কেউ না রাখার কালে বৈশাখ উদযাপন নিয়ে আরক্ষাদের বাড়াবাড়ি, কড়াকড়ি বা গড়াগড়ির হেতু খুঁজবার আগে বরং ভিন্নকথা স্মরণ করি।

বর্ষবরণের নিরাপত্তার অংশ হিসেবে চিরায়ত মুখোশ বর্জন করবার আদেশ ইতোমধ্যে আমাদেরকে শিরোধার্য করতে হয়েছে। তবে চারুকলার বহুবর্ণিল মনুষ্য, প্রাণ, পাখি বা সংস্কৃতির চিহ্ন বহনকারী মুখোশেরা আমাদের হাতের শোভা বর্ধন করবার সৌভাগ্য অর্জন করেছে। মুখে মুখোশ পরা যাবে না, পরলে নাকি নারী নিপীড়কজাতীয় অপরাধীদের টিকিটিরও নাগাল পাওয়া যাবে না। তবে তার আগেই বৈশাখি হাওয়ায় বাঙালি মানসিকতার মুখোশগুলো যে খসে খসে পড়েছে, তার খবর কে না জানে?

লক্ষ্মীপুর জেলার কমলনগরে মতিরহাটে সোহেল রানা নামের এক ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে প্রায় ৪ লাখ টাকা মূল্যের ২০০ ইলিশ আত্মসাতের অভিযোগ উঠে। জেলা প্রশাসক কর্তৃক গঠিত কমিটির তদন্তে সেই ইলিশের বেশ কিছু অংশ পাওয়া যায় ঐ প্রশাসকেরই উমেদারের ফ্রিজে। বৈশাখ এসেছিল বলেই না আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট বাবুদের আদি আসল মুখটা দেখতে পাওয়া গেল।

চুয়াডাংগার দর্শনায় উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের কার্যালয় ও গবেষণাগার ভবন নির্মাণে লোহার রডের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে বাঁশের কাবারি। আহা! এমনকরে যদি পদ্মাসেতুতেও লোহার পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহার করে বাঙালি জাতিকেই বাঁশ দেয়ার পায়তারা করে কোনো জয় কনস্ট্রাকশন্স এর মতো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, তবে হয় আমাদের সাহেবদের বিএমডব্লিউ গাড়িগুলো নদীর অতল জলে ডুবসাঁতার খেলতে পারে, নাহয় আমরা গ্রিণ কনস্ট্রাকশনস বিষয়ে পরিবেশ পুরস্কারও জিততে পারি।

ঢাকা চিড়িয়াখানার কর্তৃপক্ষ গন্ডার কাঞ্চীর সঙ্গি হিসেবে নির্বাচিত করেছে এক নিরীহ ভেড়াকে। ভেড়া ও গন্ডারের সখ্যতায় আমাদের মনুষ্য চিড়িয়াদের চায়চেহারা কী সুন্দর বেরিয়ে এলো। সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশে এ যেন চিড়িয়াখানার পুরুষ কিউরেটরের শয্যাসঙ্গিনী হিসেবে কোনো এক লেডি তেলাপোকাকে শুইয়ে দেয়ার মতো ঘটনা।

মধ্যম আয়ের ডুগডুগিতে সুরলহরি বাজিয়ে যে মুহূর্তে আমরা গালভরা উল্লাস সংগীত গাচ্ছি, ঠিক সেই মুহূর্তেই শোনা যাচ্ছে, দেড় দশকের মধ্যে দেশে এখন বেকারের সংখ্যা সবচে' বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর খবর অনুযায়ী দেশের ২৬ লাখ ৩১ হাজার বেকারের ৭৪ শতাংশই তরুণ তরুণী। সরকারী ভাবুক বা সুশীল চিন্তকদের মুখে উন্নয়নের উড়ালসড়কে থাকবার গল্পের চেয়ে মুখোশটাই আজ বড় বেশি দেদীপ্যমান।

সৌদি আরবে কাজ করতে গিয়ে গত এক বছরে দেড় শতাধিক নারী শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যের খাঁটি মুসলমানদের অবাধ যৌনলিপ্সা থেকে জীবন বাঁচাতে ছাদ থেকে লাফ দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। অতিরিক্ত কাজের চাপ ও নির্যাতন সামলাতে না পেরে বিভিন্ন সময়ে পালিয়ে দূতাবাসের সেফ হাউসে আশ্রয় নিয়েছেন অন্তত ১৫০ জন। এরপরও আমাদের সরকার নির্বিকার বসে থেকে অদ্ভুতুরে সেইসব দেশে নানা প্রলোভনে নারী গৃহকর্মী পাঠিয়ে যৌনদাসীর প্রবাহটা সচল রেখেই চলেছে। সাচ্চা মুসলমানদের এমন মুখোশ খুলে পরবার পর লজ্জা বা ঘৃণায় কীভাবে নূতন বৈশাখ আমাদের মননে দোলা দিতে পারে?

নাটুকে মন্ত্রীরা বলে চলেছেন, অত্যাধুনিক মোবাইল নিরাপত্তা প্রযুক্তি বায়োমেট্রিক্স না মানলে তারা বিএনপি জামায়াত শিবির। অথচ আগে জানতাম যারা মেজর জিয়ার অনুসারী তারা বিএনপি আর যারা মওদূদী দর্শনে বিশ্বাসী তারা জামায়াতি। বৈশাখি চেতনা আমাদের মুখোশ এতোটাই খুলে দিচ্ছে যে, আমরা রাজনৈতিক দর্শনটাও আজ বায়বীয় বায়োমেট্রিক্সে গুলিয়ে ফেলতে শিখে গেছি। এখন মনে হচ্ছে মুখোশটা মুখে থাকাই ভালো ছিল। কেন তা খামোখা খসে পরতে গেল?

১৬ কোটি বাহুল্য মানুষের দেশে আধিকারিকদের ভাষায় ছিটেফোঁটা বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনায় সেনা নিরাপত্তা জোনে ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু কিংবা জনবহুল ঢাকার রাজপথে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমুদ্দিন সামাদের মতো কিছু প্রাণ যদি খুনির রোষানলে অকালে প্রাণ হারায়, তাতে হয়ত রাষ্ট্রের কিছু আসল গেল না। কিন্তু পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণের কালে আমাদের মতো বোধের কাঙালদের তানপুরায় এমন বিয়োগান্তক ঘটনাই যে কারুণ্যভরা অশ্রুবাষ্পের সুর ঝরায়। এসব ঘটনায় রাষ্ট্র যখন খুনি খুঁজবার ন্যূনতম সদিচ্ছা না দেখিয়ে ভিকটিমের ব্লগ হাতড়ে বেড়ায় কিংবা তনুদের কোনো বন্ধুকে গুম করে দিয়ে ইস্যুবদলের নীলনকশা আঁকে, সেখানে আসলে বৈশাখ আনন্দ আর মানুষের দ্বারে এসে হাতকড়া নাড়াতে পারে না! এমন বাস্তবতায় আমাদের গভীর নিদ্রাকালে প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ এসে বরং বিষন্নতার খবর দিয়ে ঘুম ভাঙ্গিয়ে যান।

বৈশাখের মাঠের ফাটলে
এখানে পৃথিবী অসমান।
আর কোনো প্রতিশ্রুতি নেই।

তবু প্রতিশ্রুতি না থাকবার এই সময়ে ভারতের পরাক্রমশালী সম্রাট জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবর প্রণীত ইলাহী সন বা ফসলী সন বা বঙ্গাব্দের ৫০০ বছরের ইতিহাসকে মুছে ফেলবার বা নিষিদ্ধ করবার দাবিতে যেসব ওলামা বা হেফাজতলীগরা শ্মশ্রু তাওয়ান, ধর্মশালার শ্লোক আওড়ান তাদের কথায় আসলে বিকারগ্রস্ত হওয়ার ফুরসতই নাই কারো। শত দু:খেও বাঙালিয়ানার রক্তস্রোতে অতল প্রবাহ আজ পহেলা বৈশাখ। আকবরের সভাসদের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জ্যোর্তিবিদ আমির ফতুল্লাহ শিরাজীর সৌর ও চন্দ্র বর্ষ মিলিয়ে সহজ ও বিজ্ঞানভিত্তিক যে বাংলা সালের প্রবর্তনা তা চির জাগরুক থাকবে লোকজ বাঙালি মানসিকতার জারি, সারি, পালা গানে, পুতুল নাচে, নাগর দোলায়, কারূপণ্যে, কুটির শিল্পে, মৃৎশিল্পে, চিড়া, মুড়ি, খৈ বাতাসায় অথবা চাষির অমৃতান্ন মরিচ, পেয়াজ ও পান্তাভাতের দুর্নিবার সুস্বাদে। তাই হাজারও মুখ ও মুখোশের ছদ্মবেশ ও সহস্র অপূর্ণতায়ও জীবনানন্দের 'বর্ষ আবাহন'র মতো করেই বলবার প্রচেষ্টাটা হয়ত অব্যাহত রাখতে হবে। এসো এসো ওগো নবীন,/ চলে গেছে জীর্ণ মলিন-/ আজকে তুমি মৃত্যুবিহীন/ মুক্ত সীমারেখা।

মৃত্যুবিহীন মুক্ত সীমারেখার মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জীবনের বর্ষবন্দনা হোক সুখকর ও সমৃদ্ধময়। সমস্ত হিংসা ও বিদ্বেষ অন্ধকারে ছুড়ে ফেলে আপন আলোয় আমাদের শুভবোধ, সত্য ও সুন্দর স্বপ্নরা চিরজীবী হোক। হাতে ধরে রাখা অব্যাহত শৈল্পিক মুখোশ আর ধারাবাহিক মঙ্গল শোভাযাত্রাতেই এগিয়ে চলুক বাঙালি বৈশাখি সংস্কৃতি। সকল হিসাব মিলে যাক আমাদের হালখাতার। ভালোবাসা ও মমতায় মোড়ানো থাক এখানকার মানুষ ও প্রাণের বাংলাদেশ।
শুভ নববর্ষ ১৪২৩।

লেখকঃ সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
০১ বৈশাখ ১৪২৩। ১৪ এপ্রিল ২০১৬
facebook.com/fardeen.ferdous.bd
twitter.com/fardeenferdous