ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনঃ সুবচন নির্বাসনে

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 22 April 2016, 05:59 PM
Updated : 22 April 2016, 05:59 PM

দেশে এখন নির্বাচনের মৌসুম চলছে। পাল্লা দিয়ে চলছে নির্বাচনী বিধিভঙ্গের মহোৎসব। অবশ্য যে দেশে নির্বাচন কমিশনকে 'ঢাল নাই তলোয়ার নাই নিধিরাম সর্দার' হয়ে কাজ করে যেতে হয়, সেই দেশে নির্বাচনী অসদাচারই হয়তো প্রকৃষ্ট সদাচার।

দেশে চার হাজারের বেশি ইউনিয়নে পর্যায়ক্রমে জুন মাস পর্যন্ত এই নির্বাচন হবে। প্রথম ধাপে ৭৫২ ইউপিতে ২২ মার্চ এবং দ্বিতীয় ধাপে ৩১ মার্চ ৭১০টি ইউপি ভোট হয়েছে। ২৩ এপ্রিল ভোট অনুষ্ঠিত হচ্ছে ৭১১টি ইউপিতে। এভাবে ৭ মে ৭২৮টি ইউপি, ২৮ মে ৭১৪টি ইউপি এবং ৪ জুন ৬৬০টি ইউপিতে ভোট হবে।

২২ মার্চ প্রথম ধাপে সারা দেশে ৩৬টি জেলায় ৭১২টি ইউনিয়নে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই নির্বাচনে সংঘর্ষ, কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাইসহ বিভিন্ন অভিযোগের কারণে নির্বাচন কমিশন ৫৬টি কেন্দ্রের ভোট বাতিল করে। সারা দেশে নির্বাচনের আগে ও পরে সহিংসতায় মারা যান অন্তত ২৪ জন। আহত হয়েছেন দুই হাজারের বেশি মানুষ। প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত হওয়া নির্বাচনে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে বিজিবির গুলিতেই প্রাণ গেছে পাঁচজনের। সারা দেশে সহিংসতা নিরসনে বেশ কিছু পুলিশ সদস্য আহতও হন।

দ্বিতীয় দফা নির্বাচন সহিংসতার চিত্র আগের মতোই দেখা গেছে। তবে নির্বাচন কমিশন বলেছে, ২২ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রথম ধাপের তুলনায় ৩১ মার্চের দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে সহিংসতা, জবরদস্তি ও প্রাণহানি কম হয়েছে। প্রাণহানির সংখ্যাতত্ত্বের কমবেশি দিয়ে হয়ত নির্বাচন কমিশন আত্মতুষ্টি পেতে চেয়েছে। প্রথম ধাপের নির্বাচনের দিন সারাদেশে যেখানে ১১ জন নিহত ও সহস্রাধিক আহত হয়েছিল। সে তুলনায় দ্বিতীয় ধাপে প্রাণহানি মাত্র ৮ জনের!


বিস্ময়কর হলেও সত্য, এসব খুনোখুনি, সহিংসতা বা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নিজেদের প্রার্থীর সঙ্গে একই দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেই। এমন প্রেক্ষিতে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের নির্বাচনে বিএনপি ও ক্ষমতাসীনদের জোটসঙ্গী জাতীয় পার্টির তরফে কেন্দ্র দখল, ব্যাপক কারচুপি ও ব্যালট বাক্স ছিনতাই নিয়ে লিখিত অভিযোগ করলেও নির্বাচন কমিশন সেদিকে কর্ণপাত করেনি। ৩১ মার্চ ৬৪৭টি ইউপিতে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ১৩টি ইউপিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৩ জন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী জয়ী হয়েছেন এবং ৬৩টি ইউপিতে বিএনপির কোনো প্রার্থীই ছিল না। অন্তত পাঁচ শতাধিক ইউপিতে ক্ষমতাসীনদের বিদ্রোহী প্রার্থী ছিল। কার্যত বেশির ভাগ স্থানেই বিদ্রোহী ও সরকার সমর্থকরা বিবদমান অবস্থায় ছিল।

এমন বাস্তবতায় এক ধরনের শঙ্কার মধ্য দিয়ে ২৩ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হচ্ছে ইউপি নির্বাচনের তৃতীয় পর্ব। তৃতীয় ধাপে ৬২০টি ইউনিয়ন পরিষদে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে ব্যাপক সংঘাতের পর তৃতীয় পর্বেও সংঘাত সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকজন প্রার্থীর প্রাণও গেছে। দুই ধাপের নির্বাচনে ইতোমধ্যে প্রাণ গেছে ৩৬ জনের। নির্বাচনকেন্দ্রিক অপঘাতে এই প্রাণ হারানোর মিছিল বেড়েই চলেছে। সুতরাং আজকের সম্ভাব্য নির্বাচনী বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কতটা কঠোর হতে হয় আর কত নিরীহ প্রাণ ঝরে, সেটাই দেখবার বিষয়।

শঙ্কার কথা হলো এই, অনুষ্ঠিত এসব ইউপি নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার, কেন্দ্র দখল, সহিংসতা ও নানা অনিয়ম জাতীয় কোনো অভিযোগেরই নিষ্পত্তি না করে তরিঘড়ি করে গেজেট প্রকাশ করছে নির্বাচন কমিশন। রাজনীতির মাঠে বিএনপি আওয়ামীলীগের প্রধান প্রতিদ্বন্ধী হলেও ইউপি নির্বাচনে দেখা গেছে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। এযাবৎ প্রকাশিত ফলাফলে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের ধারেকাছেও নেই অন্যকোনো রাজনৈতিক দল। সর্বশেষ দুই ধাপের নির্বাচনে নৌকা ৫০ দশমিক ৯৬, ধানের শীষ ১৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে। ৮৪ ইউপিতে আওয়ামীলীগের ভোট ৯০ শতাংশের বেশি, অন্তত দু'টিতে ৯৯ শতাংশ। অপরদিকে ৩৯৪ ইউপিতে বিএনপি'র ভোট ১০ শতাংশের কম, ৪১টিতে ১ শতাংশেরও কম। তাহলে এমন ধারার নয়ছয়ের নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, তা সহজেই অনুমান করা যায়।

তৃণমূল পর্যায়ের এই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অনেক চেয়ারম্যান প্রার্থী ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করছেন। তার ওপর দলীয় পরিচয়ে নির্বাচন হওয়ায় নমিনেশন পেতে কোটি টাকাও খরচ করছেন কেউ কেউ। মনোনয়ন বাণিজ্যের বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট। ভেবে দেখা দরকার, মাসে মাত্র তিন হাজার টাকা সম্মানী পাওয়া চেয়ারম্যানশিপ পেতে প্রার্থীরা কোটি টাকা খরচ করছেন। এ থেকেই অনুধাবন করা যাচ্ছে, কেমন মানুষগুলো আসলে জনপ্রতিনিধি হচ্ছেন এবং তাঁদের খরচ তুলতে গিয়ে জনগণকে কী সেবাটা তাঁরা দেবেন?

বলা হয়ে থাকে, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া, জনমতের প্রতিফলন ঘটানো ও জনতার শাসন প্রতিষ্ঠায় নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু যে নির্বাচনে বিরোধী দলের ভূমিকা নানা কৌশলে খাটো করা হয়ে থাকে, যেখানে ভোটবাক্স ভরতে পেশি শক্তি ও অর্থের ছড়াছড়ি ঘটানো হয় এবং নির্বাচন কমিশনের কোনো কার্যকর তদারকি ছাড়া সেই নির্বাচনের কী ফায়দা, তা কারো বোধগম্য নয়।

এসব নির্বাচনের মাধ্যমে ন্যায়নীতি, সততা, বিধিভঙ্গের যে মহড়া দেওয়া হচ্ছে, তাতে জাতি হিসেবে আমাদের ভবিষ্যৎ কী, তা নিয়ে এখনই ভাবনায় বসে যাওয়া যেতে পারে। মুখে শুধু উন্নয়নের বুলি কপচাতে থাকব আর নির্বাচনী পরিবেশ ও পদ্ধতিকে অন্ধকার যুগেই রেখে দেব, এমন দেশপ্রেম আখেরে বিরাট হুমকিতেই পড়তে পারে। ভাবার সময় এসেছে, ভোজবাজির নির্বাচন নামের এক ধরনের খেলার মাধ্যমে আমরা আসলে কী প্রমাণ করতে চাইছি। যদি হয় ক্ষমতাসীনদের পাওয়ার প্র্যাকটিস, তবে জানবেন অশনিসংকেত সমাগত। আমজনতা এমন অনিয়ম আর গোয়ার্তুমির প্রতিবাদ করতে শিখে গেলে সেদিন পোক্ত মসনদের খুঁটিটাও নড়বড়ে হয়ে যেতে পারে।

আমরা তেমন দিন দেখতে চাই না। আমরা চাই, সব নির্বাচনে সত্যিকারের জনমত প্রতিফলিত হোক। উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটের আনন্দে ভাসুক বাংলার প্রতিটি জনপদ। প্রকৃত জনদরদিরাই মানুষের প্রতিনিধিত্ব করুক। তবেই দেশ ও দশের মঙ্গল।

লেখকঃ সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
১০ বৈশাখ ১৪২৩। ২৩ এপ্রিল ২০১৬
facebook.com/fardeen.ferdous.bd
twitter.com/fardeenferdous