নাট্য বিপ্লবের সূতিকাগার জাবি’র নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 23 April 2016, 05:20 AM
Updated : 23 April 2016, 05:20 AM

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ৩০ বছর পূর্তিকালে 'সেখানেই ফিরে আসি যেখানে থাকি' শীর্ষক শ্লোগানকে উপজীব্য করে জাঁকজমক আয়োজনে নতুন পুরাতনের আনন্দ আড্ডায় চৈত্র সংক্রান্তি ১৪২২ ও বর্ষবরণ ১৪২৩ পালিত হলো। ওই শিল্পতীর্থের একজন গর্বিত শিক্ষার্থী হিসেবে আমিও ছিলাম আড্ডার সতীর্থ। ফেলে আসা দিনগুলোকে খোঁজে ফিরবার এবং প্রাণস্পর্শে নিজের বিদ্যায়তনকে ভালোবাসবার এমন উপলক্ষ বারবার ফিরে আসুক।

এ উপলক্ষে দুইদিনব্যাপী আনন্দ আয়োজনে ডিনার ও লাঞ্চসহ থিয়েট্রিক্যাল পারফরম্যান্স, সংগীত, ক্রীড়া, জলখেলা ইত্যাদিতে মেতে উঠেছিল উৎসব। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে স্মৃতি উপহার হিসেবে দেয়া হয় একটি সুদৃশ্য পাটের ব্যাগসহ স্মরণিকা, টি-শার্ট ও বিভাগের নাম উৎকীর্ণ করা উত্তরীয়। বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আমিনুল ইসলাম দুর্জয় সম্পাদিত স্মরণিকায় নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন স্যারকে নিয়ে লেখা 'সেলিম আল দীন: বাংলা নাট্যভাবনার প্রাণপুরুষ' শিরোনামে আমার একটি নিবন্ধও স্থান পেয়েছে।

স্মরণিকার প্রথমেই স্মরণ করা হয়েছে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্রষ্টা বাংলা নাটকের প্রবাদপুরুষ অধ্যাপক ড. সেলিম আল দীনকে। আমাদের সবার যেই শিক্ষকের অসীম মুখশ্রীর পূর্ণিমা শূণ্যে আভাময়।

নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের গৌরবময় 'অগ্রযাত্রার ৩০ বছর' উপলক্ষে স্মরণিকার প্রথমেই বাণী দিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম। তিনি বলেন, নবীন ও প্রবীনের ভাব বিনিময়ে বিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের ভেতর নেতৃত্ব, মনুষত্ব, সুকুমার বৃত্তি তথা সৃজনশীলতা, নান্দনিকতার প্রয়াস অব্যাহত থাকে। আমাদের সংস্কৃতির ধারায় 'নাটক' একটি ঐতিহ্যবাহী উপাদান। এ ঐতিহ্যবাহী উপাদানকে যারা প্রাতিষ্ঠানিক ও তাত্ত্বিক কাঠামোর মধ্যে চর্চা করেন নিঃসন্দেহে তাদের অবদান অনস্বীকার্য।

সেলিম আল দীন পরবর্তী বিভাগের সবচে' সিনিয়র শিক্ষক এবং চৈত্র সংক্রান্তি ও বর্ষবরণ উদযাপন পর্ষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আফসার আহমদ জানান, কোন এক স্বপ্ন দেখার ভোরে, সেলিম আল দীনের স্বপ্ন থেকে উত্থিত নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক বাস্তবায়নের সঙ্গে সেই যে জড়িয়ে গেলাম তা আমাকে তাড়া করে নিয়ে চলেছে ত্রিশ বছর ধরে। বিভাগের আকাঙ্ক্ষা এবং আকাঙ্ক্ষার শরীরী প্রতিমা নির্মাণের এই ত্রিশ বছরের যজ্ঞে এখনও টিকে আছি। সেলিম স্যার ও আমি যে যাত্রা শুরু করেছিলাম সে ভ্রমণের মাঝপথে তিনি চলে গেলেন কালের আহ্বানে অন্য আরেক মহাকালে। আর প্রদীপ শিখাটি ঊর্ধ্বে ধরে পথ চলেছি আমি এবং আমরা। আমাদের সেই স্বপ্নটাই নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ।

স্মরণিকার সম্পাদক প্রফেসর ড. মো. আমিনুল ইসলাম দুর্জয় বলেছেন, সেলিম আল দীন প্রতিষ্ঠিত বিভাগ থেকে ত্রিশ বছরে অনধিক পঁচিশটি আবর্তনে প্রায় সাত শতাধিক শিক্ষার্থী নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে বিচিত্র কর্মক্ষেত্রে নিজেদের সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও রেখে চলেছেন পেশাদারিত্বের স্বর্ণস্বাক্ষর।

নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের বর্তমান সভাপতি, অভিনেতা, নির্দেশক ও উদযাপন পর্ষদের সদস্য সচিব অধ্যাপক ড. ইউসুফ হাসান অর্ক জানান, বাংলা নাটককে তার নিজস্ব গৌরবসহ পুনরুদ্ধার ও বিশ্বমঞ্চে এক স্বকীয়তায় পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য বিপ্লবের সূতিকাগার হিসেবে ১৯৮০'র দশকের শেষার্ধে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সেলিম আল দীনের হাত ধরে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।


এছাড়া বিভাগের ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষে মঙ্গলবাণী দেন, নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের সহধর্মিনী বেগমজাদী মেহেরুন্নেসা, কুইন্স ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান হামিদা বানু শোভা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থিয়েটার এন্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান সুদীপ চক্রবর্তী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের সভাপতি ড. শাহরিয়ার হোসেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের সভাপতি অসীম দাশ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার এন্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সৈয়দ মামুন রেজা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আবদুল হালিম প্রামানিক।

১৪২২ বাংলা বর্ষের শেষ দিন চৈত্র সংক্রান্তিতে সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন কলা ভবন সংলগ্ন মৃৎমঞ্চ চত্বর ও সরোবরের পাড় ঘিরে ঢাক গুড় গুড়, প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও ভেলা ভাসানোর মাধ্যমে নতুন পুরাতনের আনন্দ আড্ডা শুরু হয়। এরপর বিভাগের বর্তমান শিক্ষার্থীরা পরিবেশন করেন ঐতিহ্যবাহী সঙযাত্রা। এছাড়া মানিকগঞ্জের দেশ অপেরা পরিবেশন করে যাত্রাপালা 'স্বাধীন সুলতান ইলিয়াস শাহ'। রাতে নানা ব্যঞ্জনায় জাঁকজমক ডিনার আয়োজনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় প্রথম দিনের মিলনমেলা।

পরদিন ১৪২৩ সালের পহেলা বৈশাখের নতুন প্রভাত আনন্দ আড্ডার সারথীদের জন্য নিয়ে আসে নব মঙ্গলবার্তা। মঙ্গল শোভাযাত্রা ও বর্ষ আবাহনের গানের মাধ্যমে শুরু হয় বর্ষবরণ ১৪২৩। মঙ্গল শোভাযাত্রায় নেতৃত্ব দেন দেশের প্রথম নারী উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম। এরপর মৃৎমঞ্চে প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও অতিথিরা নিজস্ব পরিবেশনা সঙ্গীত, কবিতা, নাট্য উপস্থাপনা দিয়ে অভ্যাগতদের মুগ্ধ করেন। দুপুরে সরোবর পাড়ে জলখেলায় মাতেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। এরপর ক্যাম্পাসের পবিত্র জলধারায় সকল ক্লান্তি ঝেরে ফেলে মধ্যাহ্নভোজের উদরপূর্তি। এসময় মিলনমেলায় অংশগ্রহণকারীরা নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের দেয়া উপহার সামগ্রী, স্যুভেনির, টি-শার্ট ও বিভাগের নাম খচিত রেশমি উত্তরীয় গ্রহণ করেন। বিকালে একই জায়গায় শিক্ষক, প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা মেতে উঠেন সিক্স এ সাইড ক্রিকেট উত্তেজনায়। বিশ্বকাপের আদলে বিজয়ীদের দেয়া হয় চ্যাম্পিয়ন ট্রফি ও সকল খেলোয়াড় পান সোনালী মেডেল।


সন্ধ্যায় 'সেখানেই ফিরে আসি যেখানে থাকি' শীর্ষক বিভাগের উপর নির্মিত প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শন করা হয়। সেখানে উঠে আসে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ৩০ বছরের কার্যক্রম, সাফল্য, প্রাপ্তি এবং বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা নাটাচার্য অধ্যাপক ড. সেলিম আল দীনকে হারানোর বিয়োগগাঁথা।
মিলনমেলা ভাঙবার আগে মাটির মঞ্চে ভাটি অঞ্চলের বিখ্যাত পালাকার ইসলামউদ্দিন পরিবেশন করেন 'কমলারাণীর সাগরদিঘি'।

মিলনমেলার ফাঁকে আমার প্রিয় আলবেরুনী হল, চৌরঙ্গী, ক্যাফে চত্বর, সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চে পা রাখা, কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন সেলিম স্যারের সমাধিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ, লেকের পাখপাখালির সুরলহরী উপভোগ, খালার দোকানের গ্রামীণ খাবারের আস্বাদ ও ক্যাম্পাসের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সবুজ ঘন ঝোপঝাড়ে দাবড়িয়ে বেড়ানোটা বাড়তি পাওনা হয়েই থাকল। ভালোবাসার টানে, অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আমার প্রিয় ক্যাম্পাসে, আমার শিক্ষা স্বর্গে বারবার ফিরবার আকুতিটা যারা জাগিয়ে রেখেছেন, বিদ্যাশ্রমের প্রেমটা যারা বাঁচিয়ে রেখেছেন তাদের সবার জন্য এইক্ষণে প্রাণান্ত শুভ কামনা।


আর আমাদের এই পূণ্যতীর্থের নস্টালজিক মিলনমেলাকে ছন্দ ও ছবিতে সাজিয়ে তুলবার জন্য ভালোবেসে নিভৃতে যতনে মনের মন্দিরে লিখে রাখলাম আমার বন্ধু শাত ইল কবীরের নাম।

এতোসব বর্ণাঢ্য আয়োজন সূচারুরূপে সম্পন্ন করায় বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. ইউসুফ হাসান অর্ক স্যার, বিভাগের অপরাপর শিক্ষক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। আমাদের পুরনোদের গৌরবান্বিত করবার এমন প্রয়াসে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রতি থাকল হার্দিক অভিবাদন। আবার হয়ত ফিরব একদিন আমার সেই প্রিয় শিল্পতীর্থে। হৃদয়ে মিলাব হৃদয়। সে পর্যন্ত অনেক ভালো থেকো, আমার আঁতুরঘর আমার জ্ঞানতীর্থ নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ। স্মরণের শেষবেলায় অশ্রুবাষ্পে তোমার জন্য কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই অমর পঙক্তিমালাই সাজানো থাকঃ
যখন ভাঙল মিলন মেলা
ভেবেছিলুম ভুলব না আর চক্ষের জল ফেলা।
দিনে দিনে পথের ধুলায় মালা হতে ফুল ঝরে যায়
জানি নে তো কখন এল বিস্মরণের বেলা।
দিনে কঠিন হল কখন বুকের তল
ভেবেছিলেম ঝরবে না আর আমার চোখের জল।
হঠাৎ দেখা পথের মাঝে, কান্না তখন থামে না যে…
ভোলার তলে তলে ছিল অশ্রুজলের খেলা।।

লেখকঃ সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
০১ বৈশাখ ১৪২৩। ১৪ এপ্রিল ২০১৬!
twitter.com/fardeenferdous
facebook.com/fardeen.ferdous.bd