প্রতিবাদের বাংলাপ্রতীক শহীদ জননী জাহানারা ইমাম

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 3 May 2016, 08:08 PM
Updated : 3 May 2016, 08:08 PM

১৯৭১'র মহান মুক্তিযুদ্ধ! বাঙালির হাজার গৌরব ও অযুত বেদনার বছর। ঐ একটি বছরেই পরাভব না মানা দুঃসাহসী বাঙালি তাঁর সত্যিকারের জাত চিনিয়ে দিয়েছিল বিশ্ববাসীকে। সেসময় স্বাধীনতার জন্য কৃষক, মজুর, জেলে, তাঁতি, কামার, কুমোর, শিক্ষক, চিকিৎসক, শিল্পী, ছাত্র, কন্যা, জায়া, জননী সবার প্রাণের আবেগ দুর্দমনীয় হয়ে ওঠেছিল। তাই মাত্র নয় মাসেই ছিনিয়ে আনতে পেরেছিল বড় কাক্সিক্ষত সেই স্বাধীনতা। দেশ মায়ের জন্মযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানহারা বিবাগী মায়েদের আবেগের ফল্গুধারা কোটি বাঙালির হৃদয়স্পর্শ করে অশ্রু ঝরিয়েই চলবে নিরন্তর। আমাদের তেমন একজন বাঙালি মা শহীদ জননী জাহানারা ইমাম।


বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের মহাকাব্যিক প্রামাণিক গ্রন্থ 'একাত্তরের দিনগুলি' গ্রন্থে ২১ এপ্রিল বুধবার-এর বিবরণে রুমী'র সঙ্গে জাহানারা ইমামের কথোকপথনে উঠে এসেছে রুমী'র যুদ্ধে যেতে মা জাহানারা ইমামকে রাজি করানোর বিবরণ।

রুমী বলে- 'আম্মা, দেশের এই রকম অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও, আমি হয়ত যাব শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তাহলে আমার বিবেক চিরকালের মত অপরাধী করে রাখবে আমাকে। আমেরিকা থেকে হয়ত বড় ডিগ্রী নিয়ে এসে বড় ইঞ্জিনিয়ার হব কিন্তু বিবেকের ভ্রুকুটির সামনে কোনোদিনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব না। তুমি কি তাই চাও আম্মা?'
জাহানারা ইমাম জোরে দুই চোখ বন্ধ করে বললেন, 'না, তা চাইনে। ঠিক আছে, তোর কথাই মেনে নিলাম। দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানী করে। যা, তুই যুদ্ধেই যা।'

এভাবে রুমী মা জাহানারা ইমামের কাছ থেকে যুদ্ধে যাওয়ার ছাড়পত্র আদায় করে। যেসময় আমেরিকান স্কলারশিপ নিয়ে রুমীর ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে অধ্যয়ন করবার কথা। সেই সুযোগকে পায়ে দলে দেশমাতৃকার স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন গেরিলা যুদ্ধের পথিকৃৎ 'ক্র্যাক প্লাটুন' এর অন্যতম সদস্য শহীদ শফি ইমাম রুমী।

সংসারের নিয়মই এটা যে, কোনো কিছু পেতে হলে তার জন্য মূল্য দিতে হয়। আর দেশকে শত্রুমুক্ত করতে দেশপ্রেমিক জাহানারা ইমাম তাঁর সন্তানকে দেশের জন্য উৎসর্গ করে চরম মূল্যই দিয়েছিলেন। সেই মহীয়সী নারী বীরমাতা জাহানারা ইমামের ৮৮তম জন্মদিন আজ। শুভ জন্মদিন প্রিয় শহীদ জননী।

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে যদি চারটি বইয়ের নাম করতে হয়, তবে সেই তালিকায় অবধারিতভাবেই নাম থাকবে 'একাত্তরের
দিনগুলি'। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত বইটি ১৯৭১ সালের ০১ মার্চ থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যক্তিগত দিনলিপি আকারে লিখেছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। বইটিতে মুক্তিযুদ্ধের ভয়াল সময়ে অগ্নিগর্ভ ঢাকা শহরের অবস্থা ও গেরিলা তৎপরতার বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে। যেখানে তাঁর শহীদ সন্তান শফি ইমাম রুমী অন্যতম প্রধান চরিত্র হিসেবে পরিস্ফুটিত হয়েছে। দেশমাতৃকার জন্য যে পুত্রের প্রাণদানের পর জাহানারা ইমাম মুক্তিকামী গণমানুষের কাছে শহীদ জননী উপাধি পেয়েছিলেন।


স্বাধীনতা ও বাংলা একাডেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক জাহানারা ইমাম ১৯২৯ সালের ৩ মে অবিভক্ত ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। বাবার কাছে তার শিক্ষা জীবনের শুরু। ১৯৪২ সালে মেট্রিক পাসের পর রংপুর কারমাইকেল কলেজে থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে ১৯৪৫ সালে ভর্তি হন কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে। ১৯৪৭ সালে লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন তিনি। এরপর ১৯৬৪ সালে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার সানডিয়াগো স্টেট কলেজ থেকে সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন ডিগ্রি অর্জন করেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ পাস করেন জাহানারা ইমাম।

কর্মজীবনে বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতাসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন জাহানারা ইমাম।

১৯৯১ সালে স্বাধীনতা বিরোধিতা ও গণহত্যার প্রতীক গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামীর আমির করে স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ দেয়া হলে বিক্ষুব্ধ দেশবাসির সঙ্গে তিনিও রাস্তায় নেমে আসেন এবং ১৯৯২ সালে তার নেতৃত্বেই গঠিত হয় 'ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি'।
ওই কমিটি ১৯৯২ সালে ২৬ মার্চ একাত্তরের রাজাকার, ঘাতক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে গণআদালতের মাধ্যমে পরিচালিত ঐতিহাসিক বিচারে দশটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপন করে। ১২ জন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত গণআদালতের চেয়ারম্যান জাহানারা ইমাম এর মধ্যে দশটি অপরাধ মৃত্যুদন্ডযোগ্য বলে ঘোষণা করেন। যে কারণে তিনিসহ গণআদালতের সাথে জড়িত দেশের বিশিষ্ট ২৪ জন নাগরিক তৎকালীন সরকারের বিরাগভাজন হয়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতা মামলারও শিকার হন। জাহানারা ইমামের নেতৃত্বাধীন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি পরে তৎকালীন জাতীয় সংসদের স্পিকার, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার কাছে গণআদালতের রায় কার্যকর করার দাবিসংবলিত স্মারকলিপি পেশ করেন। সেসময় শত সংসদ সদস্য গণআদালতের রায়ের পক্ষে সমর্থন দেন। আর এভাবে ক্রমেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি জনদাবিতে রূপ লাভ করে।

মূলত জাহানারা ইমামের এই গণআদালতের দেখানো পথ বেয়েই আজকের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ এগিয়ে নিচ্ছে শেখ হাসিনার বর্তমান সরকার। জাহানারা ইমাম ছিলেন অসামান্যা এক মা। যিনি নির্দ্বিধায় নিজের প্রাণাধিক প্রিয় সন্তান রুমীকে দেশ মাতৃকার মুক্তিযুদ্ধে উৎসর্গ করেছিলেন। সেই জননী সাহসিকা জাহানারা ইমাম কিংবা রুমীর স্বপ্নের বাংলাদেশে আজ এক নতুন নজির স্থাপিত হয়েছে। ইতোমধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধী গোলাম আযম ৯০ বছরের কারাদন্ডের সাজা মাথায় নিয়ে মারা গেছেন। কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং রুমী হত্যার দায়ে দন্ডপ্রাপ্ত ও বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল পরিকল্পকদের অন্যতম আলী আহসান মুহম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির দন্ডাদেশ কার্যকরের মাধ্যমে জাতি কলঙ্কমোচনের পথে এগিয়ে চলেছে। অপরাপর যুদ্ধাপরাধীদের মামলাও বিচারাধীন আছে।
ঘাতকব্যাধি ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে নিশ্চিত মৃত্যুপথযাত্রী শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তার জীবনের শেষ বেলা পর্যন্ত স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচারের দাবিতে লড়াই করে গেছেন। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে বাংলার আপামর দেশপ্রমিক মানুষের কাছে নির্দেশনা সংবলিত এক হৃদয়গ্রাহী চিঠিও দিয়ে যান তিনি। যুদ্ধারাপধীদের বিচারের মুখোমুখি করতে আন্দোলন চালিয়ে নিতে জনগণের ওপর দায়িত্ব দিয়ে যান শহীদ রুমীর মা লেখক জাহানারা ইমাম। আর মানবতাবিরোধীদের রায় কার্যকরের মাধ্যমে সেই দায়িত্বের চূড়ান্ত বাস্তবায়নই যেন আলোর মুখ দেখছে। শহীদ রুমীর বাংলা থেকে অবশেষে ধীরে ধীরে কলঙ্ক কালিমা অপসারিত হচ্ছে।


ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২৬ জুন ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টায় যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানের একটি হাসপাতালে ৬৫ বছর বয়সে জাহানারা ইমাম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আলোর পথের দিশারী প্রিয় শহীদ জননী আমাদের জন্য রেখে যান যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী ও দেশদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও প্রতিবাদের বুনিয়াদি প্রেরণা।

'ক্যান্সারের সাথে বসবাস'-সুসাহিত্যিক জাহানারা ইমাম রচিত সুপাঠ্য বইটি ক্যান্সার আক্রান্তদের মানসিক দৃঢ়তা ও মনোবল রক্ষায় এক অসাধারণ গ্রন্থ। 'বুকের ভিতরে আগুন', 'নাটকের অবসান', 'জীবন মৃত্যু' বা 'বীরশ্রেষ্ঠ' প্রভৃতি গ্রন্থ ছাড়িয়ে সবার শীর্ষে রয়েছে পাঠকপ্রিয় 'একাত্তরের দিনগুলি'। এই একটি গ্রন্থ মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি হিসেবে ইতিহাসে অমরত্ব পেয়েছে। আর জাহানারা ইমাম স্বীকৃতি পেয়েছেন আপামর জনসাধারণের জননী সাহসিকারূপে।

১৩ বছরের জার্মান কিশোরী আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি থেকে আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীভৎস রূপের দেখা পাই। আর 'একাত্তরের দিনগুলি' আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের হানাদারদের নারকীয় গণহত্যা, নারীর সম্ভ্রম বিনাশ বা দেশ ধ্বংসের প্রকৃত আয়না। আমাদের স্বাধীনতার সেই আয়নার কারিগর, আজীবন সংগ্রামী, অসাম্প্রদায়িক সাদা মনের মানুষ ও প্রতিবাদের দৃপ্ত প্রতীক শহীদ জননী জাহানারা ইমামের প্রতি তাঁর জন্মদিনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমৃত সুর ও ছন্দে জানাই অশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি।
ঐ মহামানব আসে
দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে
মর্তধূলির ঘাসে।
… … …
জয় জয় জয় রে মানব অভ্যুদয়
মন্দ্রি উঠিল মহাকাশে।

লেখকঃ সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
০৩ মে ২০১৬
twitter.com/fardeenferdous
facebook.com/fardeen.ferdous.bd