বাড়ছে ঢাকা: দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 14 May 2016, 07:21 PM
Updated : 14 May 2016, 07:21 PM

১.
ভালোবাসার চেয়ে ক্ষণস্থায়ী জীবনের ক্ষুদ্রতা নিয়ে কবি গান বাঁধেন, 'ভালোবাসা যত বড় জীবন তত বড় নয়'। অন্যদিকে রাজধানী বা সিটি করপোরেশনের ভাগাভাগির রেশ না কাটতেই এর আয়তন বাড়িয়ে দেয়ায় সেবা সঙ্কোচনের আশঙ্কায় নগর কবি ঐ গানের প্যারোডি করেন, ঢাকা শহর যত বড় সেবা তত বড় নয়। একজন নগর কবির আশঙ্কা যে অমূলক নয় ৪০০ বছর পার হয়ে যাওয়া রাজধানী ঢাকাবাসি মাত্রই তা জানেন।

ভারতবর্ষের মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে ১৬১০ খ্রীস্টাব্দে সুবাদার ইসলাম খান চিশতি নিজের রাজমহল থেকে বাংলার রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তর করেন। কিন্তু চতুর্পার্শ্বে তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা নদী পরিবেষ্টিত ঢাকার নদীভিত্তিক প্রশাসনকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে এর অভ্যন্তরীণ সড়ক ও পরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ গোড়া থেকেই অবহেলিত থেকেছে। দেখা যায়, ঢাকার প্রথম পাকা রাস্তা তৈরি হয় ইসলাম খানের ঢাকা আগমনের ৭০ বছর পরে ১৬৭৮ সালে আওরঙ্গজেবের পুত্র মোহাম্মদ আজমের আমলে।

এরপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঔপনিবেশিক আমলের চেপে বসা শাসকদের কলকাতাকে প্রাধান্য দেয়া এবং পাকিস্তান আমলে করাচি বা ইসলামাবাদকে প্রাধান্য দেয়ায় ঢাকার প্রতি অবহেলার পাল্লাই কেবল বড় হয়েছে। এমন ইতিহাস বিবেচনায় বলা যায়, ঢাকার আঞ্চলিক ভূগোল চরিত্র বিষয়ে অজ্ঞ নগরবিমুখ শাসক বা প্রশাসকদের দ্বারা চরম অপরিকল্পিতভাবেই ঢাকার নগর ব্যবস্থাপনা তৈরি হয়েছে। পুরোমাত্রায় এক ধরণের বিশৃঙ্খলা নিয়েই চার শতাব্দি ধরে ঢাকার বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করেছে।

১৮৬৪ সালের ০১ আগস্ট ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি'র সৃষ্টি হয়। সেই মিউনিসিপ্যালিটি কয়েক শতাব্দি পার হয়ে এখন দুই সিটি করপোরেশনে রূপান্তরিত হয়ে ৯৩টি ওয়ার্ড, ৭২৫টি মহল্লা আর দেড় কোটিরও বেশি জনসংখ্যা নিয়ে সীমাহীন সমস্যায় দিনাতিপাত করছে।

এমন বাস্তবতায় গেল ০৯ মে সোমবার সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির (নিকার) সভার মাধ্যমে উত্তর ও দক্ষিণে বিভক্ত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনেরই আয়তন বাড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। দুটি সিটি করপোরেশনেই আটটি করে ইউনিয়ন যুক্ত হবে এবং আয়তনের দিক থেকে দুটিই দ্বিগুণ আকার ধারণ করবে। আয়তন বেড়ে যাওয়ায় ঢাকা উত্তরের জনসংখ্যা দাঁড়াবে ১ কোটি ৬ লাখ ২৬ হাজার ১৭। আর দক্ষিণের জনসংখ্যা হবে ৭৫ লাখ ৫৮ হাজার ২৫। দুই সিটি করপোরেশন মিলে ঢাকার জনসংখ্যা দাঁড়াবে ১ কোটি ৮১ লাখ ৮৪ হাজার ৪১। তবে জনসংখ্যার এই হিসাব ৫ বছর আগের ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী হিসেব করা। ধারণা করা হচ্ছে, জনসংখ্যার এই পরিসংখ্যান এখন অনায়াসেই দুই কোটি ছাড়িয়ে গেছে।

নতুন করে ১৬টি ইউনিয়ন যুক্ত হওয়ায় ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকার আয়তন ১২৯ বর্গ কিলোমিটার থেকে বেড়ে ২৭০ বর্গকিলোমিটার হবে। পূর্বের ১২৯ বর্গ কিলোমিটারের দেড় কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত ঢাকা শহরের নাগরিক সেবা ও সুবিধা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট ৫০টি'র বেশি সংস্থায় মাত্র ১১ হাজার কর্মী নিয়োজিত রয়েছেন। এসব সংস্থার একটির সঙ্গে আরেকটির কোনো সমন্বয় আছে এযাবৎ তার ছিটেফোটাও পরিলক্ষিত হয়নি। তার ওপর অতিরিক্ত আয়তন ও অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ কিভাবে সামলানো যাবে -এব্যাপারে কারো মুখে রা-শব্দটি নাই।
বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম অনুচ্ছেদের ৫(২) অধ্যাদেশে বলা আছে যে, রাজধানীর সীমানা নির্ধারণ করা যেতে পারে। এর আলোকে আমরা ইতোপূর্বে ২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর ঢাকাকে কেটে দুইভাগ করেছি এবং প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে বহু প্রতিশ্রুতিবান দুই তরুণ মেয়রকে গদিতে বসিয়ে দিয়েছি। এখন নতুন আয়তন, বর্ধিত জনসংখ্যা নিয়ে ইতোপূর্বে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আলাপিত রাজধানী শহরটি চার টুকরো হলেও অবাক হওয়ার কিছু হয়ত থাকবে না। কিন্তু তাতে কি ঢাকা শহর মনুষ্যবাসের যোগ্যতার পরীক্ষায় পাশ মার্ক পাবে? মনে তো হয় না!

২.
জনসংখ্যার আধিক্য, অপহরণ, চুরি, ডাকাতি, গুম-খুন-ধর্ষণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী, মাদক বিস্তারের নখর দংশন, যানবাহন সংকট ও ভয়াবহ যানজট, যত্রতত্র ময়লা আবর্জনার স্তুপ, মশার উপদ্রব, শব্দ দূষণ, পরিবেশ দূষণ, সুপেয় পানির মারাত্মক সংকট, পয়ঃনিষ্কাশনের বেহাল দশা, গ্যাস সংকট, বিদ্যুৎ সংকট ইত্যাকার অন্তহীন হাজারো সমস্যা নিয়ে ঢাকা যেখানে বসবাসের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, গবেষণা ও জরিপ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় বিশ্বের দ্বিতীয় নিকৃষ্টতম শহরের তকমা পাচ্ছে। সেদিকে আমাদের মনোনিবেশ নিবেদিত না হয়ে কেবলমাত্র ঢাকা বাড়াও কমাও বা কাটাছেড়া করবার মধ্যে সুশান্তির সুবাতাস নাও বইতে পারে। যে শহরের মানুষকে সড়ক ব্যবস্থাপনার সংকটে পড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়ির তেল পুড়িয়ে টন কে টন কার্বন নিঃসরণ করে পরিবেশের বারোটা বাজিয়ে দিয়ে রাস্তাতেই তার কর্মঘন্টার অধিকাংশ ব্যয় করতে হয়, সেই শহরের আয়তন বাড়া কমায় কারো কি আসবে যাবে -এ কথাটা বুঝবার জন্য নগরবিদ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।

কে না জানে, রাজধানী শহরের রাস্তার ৭০ শতাংশ দখল করে ব্যক্তিগত গাড়ি মাত্র ১৫ শতাংশ যাত্রীর ভার বহন করে। আর বাকী ৮৫ ভাগ মানুষ রাস্তায় বড়লোকের নিঃসরনকৃত কার্বন খেয়ে গরমে ঘামে নাকাল হয়ে ঢাকাকে সচল রাখবার প্রয়াসে দৌঁড়াতে থাকে। কাজেই সবার আগে ব্যবস্থাপনার বৈষম্য দূরীভূত করুন, মানুষকে গ্যাস, পানি বা বিদ্যুৎ দিন, ব্যক্তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন, নাগরিক সেবার আয়তন বাড়ান, শহরের ভিতরে ২০ কিঃমিঃ রেলরুটে পিষ্ট হয়ে অসহায় মানুষ কর্তন বন্ধ করুন, তারপর নাহয় যা করার করবেন।

যে যাদুর শহরে কাজের সন্ধানে প্রতিদিন ২ হাজার ভাগ্যান্বেষী মানুষ অনুপ্রবেশ করছে। তাদের আকর্ষণকে বিকেন্দ্রীকরণ করবার প্রয়াস কোথায়? একসময় বাংলাদেশের সব মানুষ কি তবে ঢাকায় বসবাস করবে? ঢাকার আয়তন বাড়িয়ে দিয়ে অপরিকল্পিত নগরায়ন বা পরিবেশ বিরুদ্ধ অমুক নগর-তমুক নগর হাউজিং ব্যবসাকেই কেবল উসকে দেয়া হবে। অথচ প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকরণ করে দেশের অপরাপর বড় শহরে রাষ্ট্রীয় কার্যালয়গুলোকে স্থানান্তর করা গেলে ঢাকার ভার লাঘব করা যেত। এক্ষেত্রে আমরা উদাহরণ হিসেবে অন্তত দু'টি শহরকে সামনে রাখতে পারি। হল্যান্ডের রাজধানী আমস্টার্ডাম হলেও তাদের মূল প্রশাসনিক অঞ্চল দ্য হেইগে অবস্থিত। তেমনি মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর হলেও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে পরিকল্পিত আধুনিক শহর পুত্রজায়ায়।


৩.
কাজেই আমরা বলতে পারি, বর্তমান আয়তন ও জনসংখ্যা নিয়েই যেখানে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে আয়তন দ্বিগুণ করে দুই কোটি নাগরিককে সেবা দিতে তাদের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা হবে-তা নিশ্চিত! আমাদের নগরপিতাদের গালভরা প্রতিশ্রুতি, রাস্তায় ঝাড়ু দেয়ার লোকদেখানো বাহুল্যতা, সাইকেল চালিয়ে নজর কাড়া বা পিতার নামডাককে পুঁজি করা নিয়ে প্রচুর স্ট্যান্টবাজি আছে। কিন্তু নাগরিকের ন্যূনতম সুবিধা নিশ্চিত করতে তারা বিভিন্ন সেবা সংস্থার সাথে সমন্বিতভাবে একটা কাজও করে দেখাতে পেরেছেন -এমনটা একজন বশংবদ নগর ইতিহাসবিদের কলমও লিখতে পারবে না!

নগর বিভাজন বা নগর কর্তন সমর্থক অনেক বিশেষজ্ঞ বা বুরোক্রেটরা বলতে চান, রাজধানীর সাথে গ্রামীণ পরিবেশ মানায় না, তাই ঢাকার প্রত্যন্ত ইউনিয়নগুলোকে সিটি করপোরেশনের সাথে মার্জ করে দেয়া হলো। আমরা এমন মতের সাথে পূর্ণ দ্বিমত পোষণ করেই বলব, খামার বাঁচলে তবেই নগর বাঁচবে। কাজেই রাজধানী শহরের উপকন্ঠে সিটি করপোরেশনে অন্তর্ভূক্তির মাধ্যমে জলাভূমিভরাট, পরিবেশবিনাশী ও বিশৃঙ্খল থার্ড গ্রেডের শহর না বানিয়ে সেটিকে বরং ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় গ্রাম হিসেবে রেখেই দিলেই শহরবাসীদের জন্য অতি গরমে এক পশলা বৃষ্টির মতো বিশুদ্ধ অক্সিজেনের আঁধার হয়ে উঠত। আগে তো ঢাকাবাসীকে প্রাণভরা নিঃশ্বাস নিয়ে বাঁচবার অধিকারটুকু দিন। তারপর নাহয় ঢাকাকে আরও বিশাল করে গড়ে তুলবেন। সকল বিবেচনায় আমরা সর্বগ্রাসী নগর সভ্যতার বিরুদ্ধেই থাকব। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'সভ্যতার প্রতি' কবিতায় সেই কবেকালেই যেমনটা বলেছেন, আমরাও আরেকবার তেমনটা বলিঃ
দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর
হে নব সভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি,
গ্লানিহীন দিনগুলি, সেই সন্ধ্যাস্নান,…

লেখকঃ সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
১৬ মে ২০১৬
twitter.com/fardeenferdous
facebook.com/fardeen.ferdous.bd