ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে…

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 24 May 2016, 08:40 PM
Updated : 24 May 2016, 08:40 PM

ব্যক্তির জীবনদর্শন, বোধ, অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি বা চিন্তাচেতনাকে গভীরভাবে আলোড়িত ও আচ্ছন্ন করতে পারে কে? নিঃসঙ্কোচে চোখ বন্ধ করে একবাক্যে বলে দেয়া যায় নদী, বন ও মানুষের কথা। বন ও নদী মানুষের চিত্তকে যেভাবে অধিকার করে, আর কে তা পারে? যে নদী ঈশ্বরের কৃপায় আবহমানকাল থেকে লালন পালন করে আসছে আমাদের, সেই নদীর ডাকে, নদীর গানে সাড়া না দিয়ে কী আছে উপায়!
পৃথিবীজুড়ে আমাদের তাবৎ আদি সভ্যতা ও মনুষ্য বসতি এই নদী কেন্দ্রিক। সেই দেশবিহীন বাঁধনহীন ঘরছাড়া আজন্ম বয়ে চলা নদীর সাথে দুঃখ-সুখের আলাপন সাড়বার সাধটা হয়ত সবারই উদগ্র বাসনা।

'বর্ষা ও নদী'র কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নদীকে দেখেছিলেন নদী তীরের মানুষের সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে৷ এই দেখার মধ্য দিয়ে তিনি পৌঁছেছিলেন মাটির কাছাকাছি৷ খুব সানন্দেই নদীকে তিনি বলতেন জলের রাণী। বলা যায়, রবীন্দ্র মানসের সবচেয়ে বড় প্রেরণাই নদী। কবিগুরু মানব মনের তৃপ্তি-অতৃপ্তির বিষয়টিকে নদীর এপার-ওপারের অতি লোভনীয় হাতছানির অনুষঙ্গ হিসেবে প্রকাশ করে যেমনটা কবিতায় বলেছেন-'নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস/ ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।/নদীর ওপার বসি' দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে;/ কহে, যাহা কিছু সুখ সকলি ওপারে।
এমন নদী যার প্রধান অবলম্বন অথবা সম্বল সেই বাংলাদেশের সন্তানবৎ আপন বৃহৎ তিন নদীর একটি যমুনা নদী পরিভ্রমণের সুযোগ এসেছিল গেল ২০ ও ২১ মে। টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইলের শহীদ সালাউদ্দিন সেনানিবাসের আমাদের অতি স্নেহাস্পদ এক স্বজন ডেকেছিল ছুটির নিমন্ত্রণে। বহু দূরে হাজার কিছুর অন্বেষণে থাকলেও গিন্নী'র আদুরে ছোট ভাই আমার এই বড় কুটুমের নিমন্ত্রণে সাড়া না দিলে যমুনার জল দেখতে আসলে কতোটা কালো, স্নান করতে কতোটা ভালো লাগে তা সত্যি হয়ত জানা হতো না।


২০ মে সকালে পরিবার-পরিজন নিয়ে গাজীপুর, টাঙ্গাইল, এলেঙ্গা ও কালিহাতির বিস্তীর্ণ সবুজ জনপদ পেরিয়ে কর্মমুখর গ্রামীণ হাজারো মানুষের মায়াবী মুখ দেখতে দেখতে পৌছে গেলাম স্নিগ্ধ সবুজ নিঝুম ভূমি শহীদ সালাউদ্দিন সেনানিবাসের অফিসার্স মেসে। সেখানকার লাল সবুজ কৃষ্ণচূড়ার মায়ায় মাখামাখিটা পারিবারিক আড্ডাকে করলো বহুবর্ণিল। সাথে কাঁচা ও পাকা আমের জুস, ডাবের জল, গাছ থেকে সদ্য পেড়ে আনা লিচুর সুস্বাদ ভ্রমণ ক্লান্তি দূর করে সবার রসনাকে বেশ তৃপ্তিই দিয়ে গেল। দুপুরের ভোজনবিলাস শেষে আমাদের সেই স্বজনের ইউনিটের বাহারি আম, কাঁঠাল ও লিচু বাগান এবং মৎস পুকুরখানি দেখবার পর মনে এই প্রতীতি জন্মাল যে, যদি সুস্থ্য থাকতে চাও, তবে এমনকরে নিজেই কিছু উৎপাদন করে সুখে শান্তিতে খাও। এরপর জিপে সারা সেনানিবাস ঘোরাঘুরি শেষে ভাস্কর মৃণাল হক নির্মিত ওখানকার সোনালী ভাস্কর্য 'মুক্তিসেনা'র কাছ থেকে বিদায় নিয়ে একই গাড়িতে সন্ধ্যার আগে আগে সোজা পৌছে গেলাম যমুনা পাড়ে।

আহা যমুনা! স্রোতস্বিনী যমুনা। ও এতো সুন্দর, এতো মনোমুগ্ধকর, এতো নয়নাভিরাম যেন আমাদের জীবনদেবতারই একটা ছায়া। অস্ফুটে হৃদয়তন্ত্রিতে সাড়া দেয় মহামহিম প্রকৃতি বা মহাপরাক্রমশালী স্রষ্টা।
হা ঈশ্বর! এইতো এইখানেই আছো জলের রাণী যমুনার প্রতিটি জলকণায়। কবিগুরু আমার হয়ে তাঁর অমর পঙক্তি শোনায়ে যান, 'সাক্ষী করি পশ্চিমের সূর্য অস্তমান/তোমারে সঁপিয়াছিনু আমার পরান'। প্রিয় শিল্পী হেমন্ত মুখোপধ্যায় কী মধুর গান গেয়ে যান।
ও নদীরে,
একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে
বলো কোথায় তোমার দেশ
তোমার নেই কি চলার শেষ!


আমরা এখন আছি যমুনার পশ্চিম তীরে গরিলাবাড়ির ঘাটে। ঐ যে খানিক দূরে উত্তর-পশ্চিম কোণায় তাকাতেই চোখে পড়ছে দেশের আভিজাত্য, সক্ষমতা ও যোগাযোগের গর্ব বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু। গোধূলি বেলায় পশ্চিম আকাশে সোনালী লালচে আলোয় বিস্ময়কর সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সেতু আর প্রমত্তা যমুনা। গোলাকার সূর্য যখন সেতুকে চুম্বন করে অস্তপাটে নামে প্রকৃতিবিলাসী পর্যটকের মনে তা অনির্বচনীয় আবেদন রেখে যায়। আর সেতুর পোক্ত পিলারগুলোর ফাঁক গলে বয়ে চলা জলরাশি যেন রাবীন্দ্রিক হয়ে বলে যায়, সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি বাঁকা!
৪.৮ কিলোমিটার দৈর্ঘের পৃথিবীর ১১তম বৃহত্তম এবং দক্ষিণ এশিয়ার ৬ষ্ঠ বৃহত্তম সেতুটি ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। বঙ্গবন্ধু সেতু বাংলাদেশের পূর্ব এবং পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে কৌশলগত সেতুবন্ধন তৈরী করেছে। এটি জনগনের জন্য বহুবিধ সুযোগ সুবিধা বিশেষত আন্ত:আঞ্চলিক বাণিজ্যকে উৎসাহিত করেছে। সড়ক ও নৌপথে দ্রুত পণ্য এবং যাত্রী পরিবহন ছাড়াও এটি বিদ্যুৎ ও প্রাকৃতিক গ্যাস বিজ্ঞান এবং সমম্বিত টেলিযোগাযোগ ব্যবস্হার উন্নতি সাধন করেছে। এই সেতুটি এশিয়া মহাসড়ক এবং আন্ত:এশিয়া রেলপথের মধ্যবর্তী। ফলে এগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবার পর এই সেতু নির্মাণ এশিয়া থেকে মধ্য এশিয়া হয়ে উত্তর পশ্চিম ইউরোপ পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্ন সড়ক ও রেল যোগাযোগ সৃষ্টি করবে।


আকাশপথ, স্থলপথ ও নৌপথে সেই বঙ্গবন্ধু সেতু পরিদর্শন শেষে ভ্রমণপিয়াসী পরিব্রাজকের মুগ্ধতা বন্দনার আগে বরং খানিকটা যমুনার উৎপত্তি ও একে নিয়ে পৌরাণিক গল্প করা যাক। ভারতের উত্তরাখন্ডের উত্তরকাশী জেলার মধ্য হিমালয়ের মুসৌরি পর্বতশ্রেণির বান্দারপুচ শৃঙ্গের দক্ষিণ-পশ্চিম পাদদেশে যমুনোত্রী হিমবাহের ৬৩৮৭ মিটার উচ্চতায় যমুনা নদীর উৎপত্তি। এই যমুনা বাংলাদেশের প্রধান তিনটি নদীর একটি। এটি ব্রহ্মপুত্র নদীর প্রধান শাখা, যা গোয়ালন্দের কাছে পদ্মা নদীতে গিয়ে মিশেছে। যমুনার পূর্ব নাম জোনাই। ১৭৮৭ সালের বন্যায় ব্রহ্মপুত্র নতুন খাতে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে এই নদীর সৃষ্টি করেছে। গঙ্গার ন্যায় যমুনাও হিন্দুধর্মে একটি পবিত্র নদী বলে বিবেচিত হয়ে এসেছে। হিন্দুরা যমুনাকে দেবী যমুনা জ্ঞানে পূজা করেন। হিন্দু পুরাণ বলে, যমুনা সূর্যের কন্যা ও মৃত্যুর দেবতা যমের ভগিনী যমী। হিন্দুদের বিশ্বাস যমুনার পবিত্র জল মৃত্যু যন্ত্রণা উপশমকারী।

সখ্যতা বা বৈরিতায়, প্রশস্ত ব্যঞ্জনায় নদী জড়িয়ে আছে মানুষের গতিশীল জীবনযাপনে। নদী যেন জীবনের উপমা, চিত্তের প্রতীক৷ হাজারো সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার অমরগাঁথা নিজের বুকে বয়ে নিয়ে উৎস থেকে সমুদ্রে বয়ে চলে এই নদী। বৃষ্টি বা বরফগলা জলধারা পাহাড়ের গা থেকে নদীরূপে আমাদের এক অমোঘ টানে চলে আসে এই সমতলভূমে। সেই নদী নিয়ে আমাদের প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ কী সুন্দর কথাই না বলে গেছেনঃ
নদী, তুমি কোন কথা কও?
অশথের ডালাপালা তোমার বুকের 'পরে পড়েছে যে,
জামের ছায়ায় তুমি নীল হ'লে.
আরো দুরে চলে যাই
সেই শব্দ সেই শব্দ পিছে-পিছে আসে;
নদী না কি?
নদী, তুমি কোন কথা কও?
তুমি যেন আমার ছোট মেয়ে- আমার সে ছোটো মেয়ে :
যতদূর যাই আমি- হামাগুড়ি দিয়ে তুমি পিছে পিছে আসো,
তোমার ঢেউয়ের শব্দ শুনি আমি : আমারি নিজের শিশু সারাদিন নিজ মনে
কথা কয় (যেন)…


মধ্যযুগের বাংলা কবিতায় আদি পর্বে বড়ু চন্ডিদাস রচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে যমুনা ও কালিন্দী নদীর উল্লেখ আছে। এ থেকে প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে নদীর প্রভাব সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে যমুনা নদীর প্রসঙ্গ বেশ কয়েকবার এসেছে। রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলায় যমুনা নদী যে শ্রীরাধার সখীদের মতোই দৌত্যবৃত্তিতে যথেষ্ট কুশলী অবদান রেখেছে তা বুঝি বলবার অপেক্ষা রাখে না। যমুনা যথাযথই উভয়ের প্রেমলীলার মূল উৎস। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য যেমনটা বলে, -'যমুনার তীরে রাধা কদমের তলে।/তরল করিলে কেহে নয়নযুগলে। অর্থাৎ যমুনার তীরে রাধা, কেন তুমি কদমের তলে এসে নয়নযুগল তরল করলে। তাইতো নয়নযুগল তরল করা যমুনা নিয়ে লোককবি প্রাণজাগানিয়া গান বাঁধেনঃ
গোসল বড় কইরা সখি মুখে দিছে পান,
ঘর থাইকা বাইর হইছে পূর্ণিমারই
চান।
আমার যমুনার জল দেখতে কালো,
চান করিতে লাগে ভালো,
যৌবন মিশিয়া গেলো জলে…!

গল্প করতে করতে সন্ধ্যার পরপরই ফিরে গেলাম টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে সেতুর পূর্বপ্রান্তে গত বছর ২৯ জানুয়ারি উদ্বোধন হওয়া বঙ্গবন্ধু সেনানিবাসের ১২ তলা বিশিষ্ট অফিসার্স মেস 'গাং শালিক' এ। যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতুটি ত্রিমাত্রিকভাবে দেখার শুরুটা এখানেই। 'গাং শালিকে'র টপ ফ্লোর থেকে সেতু দেখবার ব্যবস্থাপনা সত্যি মনোমুগ্ধকর। রাতে নিয়ন লাইটে সজ্জিত ধনুকের মতো বাঁকানো সেতুটির সৌন্দর্য কার না চিত্ত হরণ করবে? প্রত্যুষে ঘুম থেকে উঠবার পর নিজেদের কাঁচ সজ্জিত বারান্দা থেকে দিনের প্রারম্ভিক আলোতে সেতুটি আরেকবার আমাদেরকে স্বাগত জানালো। তড়িঘড়ি করে উঠে চলে গেলাম ১২ তলার ছাদে। পাখির চোখে সেতু ও যমুনা নদী দেখবার মজাটা ভীষণরকম ভিন্নমাত্রার। সেতুর বিপরীতে পূর্বে যতদূর চোখ যায় কেবল সবুজ বনসম্ভার। গাং শালিকের পাশাপাশি দৃষ্টিসীমায় ধরা দেয়া জীবনানন্দের কাব্যে নাম রাখা ঐ সেনানিবাসের নকশীকাঁথা, নীল শালুক বা পানকৌড়ি নামের ভবনেরাও যেন বিশুদ্ধ বাঙালিয়ানার সাক্ষ্য দিয়ে যায়। সমুদ্র দৈত্য রোয়ানু'র প্রভাবে হালকা চালের মেঘ-বৃষ্টিটা নদী, সেতু ও বনভূমিকে কীযে এক আলো আঁধারি রূপে সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছিল- তা অবর্ণনীয়! এসময় রৌদ্রের বাড়াবাড়িটা থাকলে বুঝি প্রকৃতির রূপসুধা বা সৌন্দর্যটা আরো ঠিকরে বেরোত বিয়ের পিঁড়িতে বসা বর-কনের মতো। হঠাৎ ছাদের খোলা অংশে এক পশলা বৃষ্টি তার নৃত্যের ছলাকলা দেখিয়ে দিয়ে আশ-পাশের পুরো প্রকৃতিকে যেন মাঙ্গলিক স্নানে পবিত্র করে গেল।


স্নান ও প্রাতঃরাশ শেষে বেরিয়ে পড়লাম। পাখির চোখের পর এবার নৌপথে যমুনা ও সেতু দর্শনের পালা। গাং শালিকের ফ্রন্ট ডেস্ক থেকে টিকিট সংগ্রহ করে গরিলাবাড়ির ঘাটে পৌছে গেলাম। সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় লাইফ জ্যাকেট পরে নিয়ে নিরাপদ বোট রাইড শুরু করলাম। বঙ্গবন্ধু সেতুর তলদেশ দিয়ে যমুনায় ঘোরাঘুরি। নদী পাড়ের মানুষের জীবনযাত্রা আর বাহারি নৌযানে যাত্রী পারাপার অথবা বাণিজ্যিক নৌযাত্রা একসাথে দেখা। নদীর মাঝ বরাবর সবুজ ঘাসের গালিচায় মোড়ানো চরাচরের গল্পকথারা চোখে ইশারা দিয়ে যায়। সাথে বাড়তি পাওনা সেই দৈত্য রোয়ানুর দান শান্ত ধীরস্থির হাওয়া আর মধুর বৃষ্টি। এমন আনন্দক্ষণে কিছু সময়ের জন্য নিজেকে শিলাইদহ আর শাহজাদপুরে জমিদারি তদারকি করতে এসে নদী প্রেমে বাঁধা পড়া রবীন্দ্রনাথের বজরায় বসিয়ে দিলে মন্দ কি? এমন মেঘলা দিনে নদীতে বজরায় বসে লেখা একখানা গান না হয় গুরুদেব শুনিয়েই যাবেনঃ
মন মোর মেঘের সঙ্গী,
উড়ে চলে দিগ্দিগন্তের পানে
নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণবর্ষণসঙ্গীতে
রিমিঝিম রিমিঝিম রিমিঝিম॥
যমুনায় আনন্দবিহারকালে দয়িতার হাতে হাত আর নয়নে নয়ন রেখে গলা খুলে শ্যামল মিত্র হয়ে গিয়ে, 'সাত সাগর আর তেরো নদীর পারে আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে'। অথবা 'নদীতে ডুব দিয়ে সখি মুক্তো যদি পেতে চাও'- গাইতে কার না ভালো লাগে?

তারপর দুপুরের ভোজসভা শেষে স্থলপথে সেতু দেখবার পালা। স্বজনদের যারা এই প্রথমবারের মতো দেশের বৃহত্তম সেতুর উপরিতলে নিজেদের চিহ্ন রাখবেন বলে স্থির করেছেন বিশেষ করে আমার আত্মজা সুখপ্রীতা হেরা ও ওর আদরের নানু ভাই খুব রোমাঞ্চ ও এডভেঞ্চার অনুভব করলেন। সেতুর পূর্বপ্রান্ত থেকে শুরু করে পশ্চিমপ্রান্তে পৌছতে মাত্র ৭ মিনিটের সময়কাল। চোখের পলকে সেতু দর্শন সম্পন্ন। তবু এক সেতুতে ট্রেন বাস চলাচল, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ফাইবার অপটিক কেবল সঞ্চালন স্বচক্ষে না দেখলে অবিশ্বাসের ঘোর যে কারো কাটতই না। সেতু পাড় হবার পরই বঙ্গবন্ধু যমুনা ইকো পার্ক। সেখানকার মিনি চিড়িয়াখানার বণ্যপ্রাণীরা ভেংচি কেটে আপনাকে স্বাগত জানাবে। পার্কের বিশালকায় ঝাউগাছসমেত ঘণ সবুজের বনশোভায় খানিক সময়ের জন্য হারিয়ে গিয়ে নিঃসীম অরণ্যে প্রেমাস্পদের চোখে চোখ রেখে ভালোবাসা বিনিময় করা যেতেই পারে!

এবার সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধ দেখতে খানিকটা এগিয়ে যাওয়া। সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে নদী শাসনের অতি প্রয়োজনীয় অংশ খান সাহেবের ঘাট এলাকার হার্ড পয়েন্ট আপনাকে কক্সবাজারের লাবনী বা কলাবতী সী বীচের কথা মনে করিয়ে দিতে পারে। যমুনার অপার সৌন্দর্যের মনভোলানো হাতছানি যেন এখানটাতেই জমা রাখা ছিল। বিস্তীর্ণ জলরাশিতে ভরপুর স্রোত আর উথাল পাথাল ঢেউয়ের দেখা এখানে মেলে। নদীরও গর্জন আছে, সুর আছে, সঙ্গীত আছে তার সবটাই একসাথে বেঁধে রাখা হয়েছে হার্ড পয়েন্টে।


হার্ড পয়েন্টের কাছেই একা দাঁড়িয়ে এক নিঃসঙ্গ কৃষ্ণচূড়া আপনাকে জানান দিয়ে যাবে, আমার মূলে জলসিঞ্চনে প্রাণ বাঁচিয়ে রাখে যে যমুনা, তাকে ভালোবেসো, তার ডাকে সাড়া দিও মনুষ্যদেবতা। হাজার বিনষ্টি থেকে বাঁচিয়ে রেখো আমার প্রিয় নদী যমুনাকে। নদীর অশান্ত জল আর নদীর নিসর্গ সকল গ্লানি মুছে দিয়ে তোমায় দিবে চির শান্তির আস্বাদন।
আর এইভাবে প্রকৃতি কন্যা প্রিয় যমুনা ভ্রমণের যৎকিঞ্চিৎ অমৃত অনুভবটাই কেবল ভাগ করা গেল, এর কোনো সমাপ্তি থাকতে নেই।

ভ্রমণ সতর্কতা ও পরামর্শঃ
লাক্সারিয়াস এক কাপল বেডে একদিন হিসেবে এসি ৫ হাজার ও নন এসি ৩ হাজার টাকা খরচে বঙ্গবন্ধু সেনানিবাসের অফিসার মেস 'গাং শালিক' এ অবস্থান করে স্থল, নৌ ও পাখির চোখ এই তিনস্তরে যমুনা নদী ও বঙ্গবন্ধু সেতু দেখার পরিকল্পনা করতে পারেন। তবে শর্ত একটাই কোনো সেনা অফিসারের সুপারিশ প্রযোজ্য হবে। ১২ তলা ভবনে চল্লিশটি রুম অতিথিদের জন্য রাখা আছে। সেনানিবাসের অফিসারদের জন্য প্রতিদিনের নির্ধারিত মেনু অনুযায়ী নির্দিষ্ট রেটে অতিথিদেরও খাবারের ব্যবস্থা আছে। সেনানিবাসে অবস্থানকালে সেখানকার নিয়মকানুন মেনে চলার ব্যাপারে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। স্পর্শকাতর স্থাপনার ছবি তোলা থেকে বিরত থাকতে হবে। ঘন্টায় ১ হাজার টাকা খরচে ১০ সীটের সেনা বোট রাইডে বেড়াতে গেলে গাং শালিকের ফ্রন্ট ডেস্কেই টিকিট মিলবে। নদীতে অবস্থানকালে সবার জন্য লাইফ জ্যাকেট পরা বাধ্যতামূলক। লুঙ্গি পরে নিজের হোটেল স্যুট থেকে বাইরে বের হওয়া মানা। সেতু পাড় হওয়ার জন্য নিজেদের ব্যক্তিগত গাড়ি না থাকলেও সমস্যা নাই; পূর্ব পাড়ের সেনানিবাস সংলগ্ন স্টেশনেই মিলবে ভাড়ায় চালিত সেতু পারাপারের গাড়ি। ভ্রমণ শেষে নিজ গৃহে ফিরবার পথে সেনানিবাসের লেইজার ক্যান্টিন থেকে অর্গানিক রসমালাই ও স্পঞ্জ মিষ্টি নিয়ে আসতে পারেন। মাত্র দু'শ টাকা খরচে ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জ বা ভুঞাপুরের বাসে মাত্র কয়েক ঘন্টার জার্নিতেই দেখা মিলবে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপাড়। আপনার নদীদর্শন শুভ হোক।

লেখকঃ সাংবাদিক, মাছরাঙা টেলিভিশ
২৫ মে ২০১৬। ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৩
https://twitter.com/fardeenferdous
https://www.facebook.com/fardeen.ferdous.bd