পিতার আরশিতে প্রজন্মের প্রতিচ্ছবি

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 19 June 2016, 03:54 PM
Updated : 19 June 2016, 03:54 PM

একটি বিশেষ দিনের জন্য আমার কোনো বাবা নেই। তাই আমার পিতৃদেব বা জনয়িতা নিয়ে খুব বেশি আদিখ্যেতাও নেই। নিয়তির ইচ্ছায় সন্তান আবাল্যেই অনাথ বা নিরাশ্রয় হয়ে পড়লে বাবার আবদার, খুনসুটি বা ভালোবাসা নিয়ে বলবারও তেমন কিছু থাকে না। আমার বাবা না দূরের মানুষ; না কাছের। তাই পরম মমতা, মাথার ওপর এক আকাশ ছায়াবৃক্ষ নির্ভরতা বা অশেষ নিরাপত্তার অনুভূতি সেতো নয় আমার জন্য। আমার বাবা কি রাগ, শাসন, ভয়ে মোড়ানো গম্ভীর রাশভারী? তার আমি কী জানি? বাবা তুমি আসলে কেমন?

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার প্রথম দশকের শেষার্ধে যখন বুঝতে শিখেছি আত্মীয়-পরিজন সবাইকে দেখতাম আমার মাথায় হাত বুলিয়ে খুব আদর করতে। আহা! এতিম ছেলে। এতিমের মাথায় হাত দিলেই গুণাহ মাফ। কী ট্রাজেডি, আমি বাবা বলে কারো কোলে গিয়ে বসতে পারি না। তাঁর ঘাড়ে ওঠে পাড়াময় বেড়াতে পারি না। বালকীয় কৃত্যে তাঁর গা ভিজিয়ে দিতে পারি না। আমার আর মায়ের সুখে দুঃখে তাঁর কোনো দেখা পাই না। সেই বেদনাবিধুর নিঃসঙ্গতার কথাটিই বারবার মনে করিয়ে দিয়ে আমার মাথার ওপর দিয়ে ছওয়াব কামাই করে যান আমাদের দুঃখে খুব হাহুতাশি স্বজনেরা! না অস্বীকার করব না কেউ কেউ ধর্মাচারের ব্রত হিসেবে ফেতরা বা যাকাতের দু'চারখানা টাকাকড়িও আমার কোমল হস্তে সমর্পণ করে যান। এতে নাকি তাদের দ্বিগুণ ছওয়াব। যাক সান্ত্বনা এই যে, আমার অদৃশ্য বাবা লোকায়িত বলে এই অনাথ নিরাশ্রয়ের অছিলায় অনেকের স্বর্গলাভের অভিলাষ পূর্ণ হতে থাকল।

মহান প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে আমার মাথার সব চুলের ওপর দিয়ে পূণ্যার্থীর হাত অতিক্রমেরও আগে আমার বয়স মাত্র যখন ২ শত ৪০ দিন, হঠাৎ আমার কর্মচঞ্চল গ্রাম্য কবিরাজ বাবা নিঁখোজ হন। সাত দিন পর বাড়ির অনতিদূরে বিলের কচুরিপানার সবুজপত্র আর বাহারি মঞ্জুরিকা ভেদ করে বাবার হাতের হদিশ পাওয়া যায়। পাশে বসে কৃষ্ণ কাকেদের তারস্বর চিৎকার আর সেই পিতৃহস্ত ভোজন সবার মনোযোগ কাড়ে।
সাতদিনের গলিত বাবাকে বিলের জল থেকে টেনে তোলা হলে মায়ের পোশাক শুভ্র হয়ে যায়। নাক থেকে খসে পড়ে নদ। কানপাশা ছুড়ে ফেলা হয় দূরে। অশ্রুবাষ্প আর বিষাদের নীল বিষে ছড়াছড়ি মায়ের ঊষর প্রান্তর। একমাত্র পুত্র তাঁর নিরাশ্রয় অনাথ।

খুব সাদামাটা গ্রামীণ পারিবারিক গল্প। সৎ মা তার শরীক বিনাশ করতে পরিবারের বড় পুত্রকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিলেন। আর বাবার পাষাণ পিতৃকাপুরুষ তার দ্বিতীয় স্ত্রীর পক্ষ নিয়ে চিহ্নিত হন্তারকদের কাছ থেকে উৎকোচ নিয়ে রাষ্ট্র কর্তৃক দায়েরকৃত মামলা ডিসমিস করে দিলেন। সেকালেও এখনকার মতোই খুনোখুনি বা বিচারহীনতার সংস্কৃতি খুব চালুই ছিল।

দস্যুদের বাড়ি থেকে স্থায়ীভাবে বাপের বাড়ি চলে আসা শোকগ্রস্ত মা কোনোদিন আমার বাবাকে নিয়ে এক লাইনও বলেন নি। বাবার স্মৃতি বলতে এই আমি আর বাবার রেখে যাওয়া একটা গোল আয়নাই আমার পরম সঞ্চয়। পিতার সেই আরশিতেই জাগরুক আছে সন্তানের প্রতিচ্ছবি। ওই আয়নাতেই মুখ রেখে দেখি, বাবা আমাকে কাঁধে তোলে সারা গ্রামময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পাখি দেখাচ্ছেন, ফড়িং চেনাচ্ছেন। ৮ মাসের শিশু কীইবা তার বোঝে? বাবার একটা পোষা বানর ছিল বলে জেনেছি। গলায় লোহার শিকল পরানো ধূসর রঙের সেই উচ্ছল বানরটাও নাচতে নাচতে কি আমাদের পেছন পেছন ঘুরে চলেছে?

আমার এমন পিতৃপ্রেমে ছিটেফোঁটাও আনন্দ নেই কেবলই বেদনা। তবে তাই হোক, আমার জীবনে নাহয় কবিগুরুই সত্য থাকুক, প্রেমের আনন্দ থাকে স্বল্পক্ষণ কিন্তু বেদনা থাকে সারাটি জীবন।

আমি যখন আর এতিম নই। মানে বালেগ হয়ে গেছি। সেইবেলা কিংবা তারও আগে বালকবেলায় এক দু'বার বাবার ভিটায় আমার পা পড়েছে। বাবার নিজ হাতে রোপন করা রক্তজবা গাছ দেখে মুগ্ধ হয়েছি কিংবা ফুলের মধু শোষে খেতে বালক মৌমাছিও সেজেছি। তারপরও বাবার স্বরূপটা আসলে কি, তা অধরাই থেকে গেছে। এখন আর সেই রক্তজবা নেই হয়ত। লোভাতুর ভূমিগ্রাসী স্বজনেরা আমার কোমল বাবার রেখে যাওয়া রক্তজবা পছন্দ করবেন কেন?

আমাদের আব্রাহামিক শান্তির ধর্মে এতিমের ১০টি হকের প্রথমটিতে বলা হয়েছে এতিমের সম্পদ অন্যদের স্পর্শ করা নিষিদ্ধ। কিন্তু হায়! আমার স্বজনদের ধর্ম খুব ভালোলাগে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা যে মোটেই ভালো লাগে না।

২০০৬ সালের ২৭ মে সকাল ৭টা ৫৫ মিনিটে মহান ঈশ্বরের ইচ্ছায় আমাদের মাতার মাতা মেহেরুনের কল্যাণে আমি এই অনাথ নিজেই বাবা হওয়ার গৌরব অর্জন করলাম। মেয়ে সুখপ্রীতা'র সুখই যেন আমার সুখ। 'আয়রে আমার কাছে আয় মামণি, এ হাতটা ভালো করে ধর এখনই'- হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ভরাট গলার এই গানটা যতবার শুনি আমার সকল উপলব্ধিতেই যেন উছলে ওঠে কন্যার জন্য পাগলপণ নির্মল ভালোবাসার সজীব অনুভূতি। এই হয়ত বাবার সর্বস্বত্যাগী পবিত্র প্রেম, যা সব স্বার্থের উর্ধ্বে। আমার বাড়িয়ে দেয়া হাতের স্পর্শেই কন্যার অনুপ্রেরণা ও আত্মবিশ্বাসেরা যেন প্রাণ পায়। হাজার অন্ধকারেও ছড়িয়ে যায় আলোর দ্যোতি। ঘুমোট মেঘেরা বৃষ্টি হয়ে ঝরে। পাখিরা গান গায় গলা খোলে। প্রজাপতি তার সবটুকু রঙ ছড়ায়। বাবা বুঝি তবে এমন, তাইতো?

আচ্ছা আজ থেকে তবে বাবার রেখে যাওয়া সেই রুপোলী আরশিতে অকালে ঝরে যাওয়া আমার মতোই দেখতে সেই সহজিয়া বাবারই মুখচ্ছবি খুঁজব। সুখপ্রীতাকেও বলব, তাঁর পিতামহ নীরবে-নিভৃতে-নির্জনে থাকে এই আয়নাতেই। বাবার জন্য আমাদের ভালোবাসা আর অগাধ শ্রদ্ধার রূপরেখাটা হোক না যতোই বেদনার- তবু সেই বাবাকেই খোঁজে ফিরব।

আমরা হবো আমেরিকান যোদ্ধা উইলিয়াম জ্যাকসনের পুত্র সোনোরা লুইস ডডেরও বেশিকিছু। সোনোরার মা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে অকাল প্রয়াত হলেও যুদ্ধ ফেরৎ উইলিয়াম নিজের ছয় পুত্র-কন্যাকে মানুষ করার জন্য রাত-দিন কী কঠিন অমানুষিক পরিশ্রমই না করেছিলেন। আন্তরিক প্রচেষ্টা আর কঠোর পরিশ্রমের আইকন পিতৃপুরুষ উইলিয়ামের স্মরণে জুন মাসের তৃতীয় রোববার বাবা দিবস হোক আমাদের রোজকার। ঝড়-বৃষ্টি-রোদে ছায়াবৃক্ষ পিতার বন্দনা হোক প্রতিদিনের। আর বাবার পরম আশ্রয়ে, 'শিশু হবার ভরসা আবার জাগুক প্রাণে/ লাগুক হাওয়া নির্ভাবনার পালে'র মতো রাবীন্দ্রিক প্রশস্তিরাও ছড়িয়ে যাক আমাদের মতো সন্তানের হৃদয়তন্ত্রীতে।

শত বাঁধা-বিপত্তি সয়ে আমাদের যে জনক আলো জ্বেলে যান সন্তানের সুন্দর প্রাণপ্রদীপে। যেই উদার পিতা ঘুমিয়ে থাকেন আমাদের অন্তরে সেই কুল বংশের জনকের জন্য অফুরান শ্রদ্ধাঞ্জলি।

ফারদিন ফেরদৌসঃ লেখক ও সাংবাদিক
১৬ জুন ২০১৬
twitter.com.fardeenferdous
facebook.com/fardeen.ferdous.bd