এক সাগর রক্ত, লাখো প্রাণ ও সম্ভ্রমে পাওয়া চিরসবুজ বাংলাদেশে আজকাল মানুষের মৃত্যুটা খুব ছেলেখেলায় পরিণত করে ফেলা হচ্ছে। আপনি যদি সেকেলে প্রথার বিরুদ্ধে কথা বলেন, রাজনৈতিক অশিষ্টাচার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, আপনি যদি নিজের জীবনাচরণে লিবারেল বা মহানুভব হতে চান, আপনি যদি নিজের ইচ্ছানুযায়ী ধর্ম পালন করতে চান, যদি সুকুমার বৃত্তি চর্চার মাধ্যমে মানবিকতাকে উর্ধ্বে তোলে ধরতে চান, সর্বোপরি আপনি যদি কোথাও কিছু লিখেছেন- তবে নির্ঘাত জানবেন মৃত্যুদূত ধারালো লৌহাস্ত্র হয়ে আপনার ঘাড়ের পাশ দিয়েই ঘুরঘুর করে চলেছে। নিজের নিরাপত্তা নিজে দিতে না পারলে, গুপ্তহত্যায় আপনার ঠিকানা সোজা ঐপারে। আর যদি সেই লৌহাস্ত্রসহ জনতার হাতে কোনো উগ্রবাদে পর্যবশিত মানুষ ধরা পড়েছেন- তবে রাতের আঁধারে অভিযানকালে বুকের বামপাশ দিয়ে এফোর ওফোর বুলেট। বিচার চাইবেন? তবেতো আপনি স্রেফ পাগল।
এই ধুয়াসাচ্ছন্ন ধারাবাহিক মৃত্যু প্রহেলিকার শিকড় কেউ খুঁজছে না। গোড়াটা কেটে দিয়ে আগায় জল ঢেলে বিচ্ছিন্ন টাইপ একই ধাচের মহাকাব্য ফাঁদা হচ্ছে কেবল। কেউ বলছে না, কেন একজন উগ্রবাদী অল্পবয়সী যুবককে মনুষ্য রক্তে হস্ত লাল করতে হয়। কে তাদের পোষে, কেইবা তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দাতা? এদের নিয়েও কেন রাজনৈতিক ফায়দা লুটবার কথা ভাবা হবে? ওদের বিরুদ্ধে কেন সকল গোষ্ঠী এক হতে পারে না? শিক্ষক, লেখক, পুরোহিত, যাজক, ভিক্ষু, পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী, অধিকারকর্মী, স্বদেশি বা ভিনদেশি কে না মারা পড়ছে?
এসব ঘটনায় জড়িত অনেকেই ধরাও পড়ছে। অদ্ভুত মৃত্যুর মিছিলে আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জামায়াত বা হেফাজতিয়া মতাবলম্বীদের সংখ্যাটা উল্লেখযোগ্যভাবে কম। তাহলে মারছেটা কে? সেটা বিচারবিভাগীয় তদন্ত সাপেক্ষ বিষয়। কিন্তু আপনি তদন্ত করবেন কীভাবে, যদি রাঘব বোয়ালের মুখোশ খসে পড়বার ডরে ঐ ধরা পড়াদের জবাব বন্ধ করে দেন কিছু একটা বলবার আগেই। হতে পারে যারা বা যেসব সংস্থা এমনটা করেন, তারা সবাই বেশ বড়মাপের নিরাপত্তা বিশারদ। কিন্তু ওয়াচডগ, সুশীলসমাজ বা সমালোচকদের মুখ বন্ধ করাটাও নিশ্চয় সেসব বিশারদদেরই দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে!
লেখক অভিজিৎ থেকে পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী। এসব হত্যাকান্ডের কোনোটিরই যথোচিত সুরাহার কথা কেউ জানে না। কিন্তু সরকারী বা বিরোধীপক্ষের রোজকার সকল আলোচনায় প্রতিপক্ষকে দোষারোপের খেলা চলছে। দেশের প্রধান নির্বাহি প্রাইম মিনিস্টার বলছেন, তিনি হেড অব দ্য গভর্ণমেন্ট, তাই সব খবর তাঁর কাছে আছে। এসব খুনোখুনির ঘটনায় বিএনপি জামায়াত জড়িত। অন্যদিকে বিএনপি নেত্রীরও একই সুর। সব ঘটনার জন্য দায়ী বর্তমান সরকার ও আওয়ামীলীগ। এসব নাকি বিএনপি জামায়াতকে শায়েস্তা করবারই নানামুখী পায়তারা। রাজরাজড়াদের মহলে চলমান এসব বালখিল্যপূর্ণ ব্লেম গেম দেখে আমরা বলতে পারি, যদি বিএনপির কথা সত্য হয়, তা খন্ডন করবার দায়িত্ব সরকারের এবং যদি সরকারের কাছে প্রকৃত তথ্য থেকে থাকে সেসব প্রকাশ করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের কর্তব্যটাও সরকারের ওপরই বর্তায়। অন্যথায় কোনোপক্ষের চাপাবাজিই আসলে ধোপে টেকে না। এমতাবস্থায় একাত্তরের ৭ই মার্চে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভরাট কন্ঠটাই কেবল স্মরণ করতে পারি, 'বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়'!
সুন্দর মানুষের অশুভ রক্তপাতের কালে হাজার বিষাদ ও কোটি শোকগ্রস্ততায় আশার আলো দেখা গিয়েছিল। এজন্য যে, অবশেষে পুলিশ অন্ধকার অপশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল বলে। আর এর মূলে ছিল ৫ জুন চট্টগ্রামে পুলিশ অফিসার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু'র করুণ প্রয়ানের পর। মিতু'র দুই অবুঝ শিশু মা হারা হওয়ার পর। এই ঘটনার পর পুলিশ জঙ্গিদের ধরতে বেশ তৎপর হয়। শুরু হয় জঙ্গিবিরোধী বিশেষ সাঁড়াশি অভিযান। পুলিশের দেয়া হিসাব অনুযায়ী, এই অভিযানে বিভিন্ন উগ্রবাদী দলের ১৯৪ জন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরও ১২ সহস্রাধিক মানুষকে আটক করা হয়েছে। এই সময়কালে অর্ধ ডজন ক্রসফায়ারের ঘটনাও ঘটেছে। পুলিশ বলছে, জঙ্গি বহির্ভূত আটককৃতরা বিভিন্ন মামলার আসামী। যদিও বিএনপি বলছে, ঈদের আগে গ্রেপ্তার বাণিজ্যের অংশ হিসেবে তাদের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীকে আটকে রেখে বিএনপি'র রাজনীতিকে চাপে ফেলার কৌশল বাস্তবায়িত হচ্ছে।
আমাদের কথা হলো, পুলিশকে সেই যুদ্ধ ঘোষণা করতে হলো, সেটা নিজেদের পরিবারের কেউ অকাল প্রয়ানের আগে কেন করা হলো না। ২০১৫ সালের বইমেলায় বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ খুন হওয়ার পরই যদি এই যুদ্ধটা শুরু করা যেত তবে শিক্ষক, পুরোহিত বা লেখকদের পরিবারে এমনভাবে কঠিন শোক নাও নেমে আসতে পারত। কিন্তু আমরাতো আবার এসব কথা বলতে পারব না। পুলিশের সমালোচনা করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কারণ সমালোচক পুলিশের বন্ধু নয়, কেবলমাত্র তোষামোদেরাই তাদের পরম মিত্র।
যে পুলিশ কিছুদিন আগেও হাটহাজারী মৌলভীদের ভাষায় কথায় বলেছে, মুক্ত চিন্তা বা লেখালেখি করলে ১৪ বছরের জেল হবে-এমনটা মনে করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু গুপ্তঘাতকদের বিষয়ে কোনো রাও শব্দ করেনি। সেই পুলিশ কিনা অদৃশ্য খুনীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। এখন আমরা যদি বলি, অবশেষে পুলিশ টেরোরিজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। যাক এতোদিনে হাটহাজারিয়া অনুভূতিপ্রবণ পুলিশ ভায়াদের তবে বোধোদয় হয়েছে। অভিজিৎ হত্যাকান্ডের পরই এই যুদ্ধটা ঘোষণা করা হলে আজ হয়ত মাহমুদা মিতুর দুই নিষ্পাপ শিশুর করুণ আর্তি আমাদের দেখতে হতো না! অমনি বন্ধুস্থানীয় যুদ্ধবাজ পুলিশ ভাইয়েরা তেতে উঠেন। মানছি, পুলিশ আইন প্রয়োগ করে বলে তারা সমাজের সর্বাপেক্ষা অধিক প্রতিক্রিয়াশীল অংশের অন্তর্ভুক্ত। তাই বলে পাবলিক ফোরামে সিভিলিয়ানদের প্রতিক্রিয়ার জবাবে যা খুশি তা বলে দিয়ে চরম প্রতিক্রিয়া দেখানোটা কি শোভন হতে পারে? প্রজাতন্ত্রের কর্মী বা সেবকদেরতো নিরবে নিভৃতে দেশসেবা করবার কথা। তাদের কি যখন তখন যা খুশি তা বলা শোভা পায়? কিন্তু আজকাল পুলিশ তাই করছে। বিভিন্ন ফোরামে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে রাজনীতিকেও হার মানিয়ে দিচ্ছে! বিগলিত বাহবায় তোরণ, ব্যানার বা ফেস্টুনে লিডারদের মতো সংবর্ধনাও গ্রহণ করছে!
আমরা পেশাদার লেখকরা এসব বিষয়ে কথা বলতে গেলেই বন্ধুবর পুলিশ ভাইয়েরা বলেন, তাদের প্রতি সমবেদনা না জানিয়ে সস্তা জনপ্রিয়তার উদ্দেশ্যে নাকি আমরা বন্ধুর জীবনের ঝুঁকি, বন্ধুর আবেগ, বন্ধুর পেশাকে তুচ্ছ করে অমানবিকতা ও অসামাজিকতার পরিচয় দিচ্ছি। আমরা লেখকরা নাকি ইস্যু তৈরি ও বিক্রি করে মানবতাকে পণ্য করে তুলছি। আমরা নাকি অভিজিৎ নিয়ে বড় কথা বলছি, কিন্তু তাদের ভাষায় যেখানে অভিজিতের তুলনায় মিতু ভাবীর ভিকটিম হওয়াটাই বেশি মর্মান্তিক, সেটা নিয়ে দু'কলম লিখছি না। এবং এমন মানুষ কখনোই পুলিশের বন্ধু হতে পারে না।
আমরা এই পুলিশ বন্ধুদের চরমপত্রের প্রেক্ষিতে বলছি, মিতু ভাবীর জন্য পৃথিবীর যেখানে যারাই দু'ফোটা চোখের জল ফেলেছে, আমরা নিরঙ্কুশভাবে তাদের দলে। মিতু ভাবীর মাতৃহীন সন্তানের সবটুকু বেদনা ও শোক সমানভাবে আমাদেরও। আর আমাদের মতো বোধসম্পন্ন সকল মানুষের ভাবনাও নিঃসন্দেহে তাই হবে।
কিন্তু আমাদের বুঝে আসে না, অভিজিৎ বা অপরাপর নৃশংসতার শিকার অধ্যাপক, পুরোহিত, যাজক বা ভিক্ষুদের তুলনায় ভাবীর ভিকটিম হওয়াটা বেশি মর্মান্তিক কীভাবে হয়? অভিজিতের রক্তের চেয়ে কি ভাবীর রক্তের মূল্য বেশি। ভাবী'র অকাল প্রয়াণে তাঁর সন্তান বা মা বাবা যতোটা সাফার করছে, তার চেয়ে কোন অংশে কম সাফার করছেন অভিজিতের বাবা বা স্ত্রী? মানুষের ভিকটিমাইজিং ট্রাজেডি নিয়ে পার্থক্য গড়ে দেয়ার এই বুদ্ধি যদি হয় কোনো মিড লেভেল পুলিশ কর্মকর্তার। তবে আমাদের বাকরুদ্ধ হওয়া ছাড়া গতি নাই। মানবিক সমতার সংজ্ঞা যাদের জানা নাই, তাদের অন্তত অন্যকে মানবিক হওয়ার জ্ঞান দেয়াটা শোভা পায় না। আমার বন্ধুস্থানীয় কারো কারো মতো এমনধারার কিছু পুলিশের অতি অহংকার, সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবৈষম্য ও শ্রেণিবিদ্বেষটাই বড় ইস্যু, যার কারিগর ও সোল এজেন্ট পুলিশ নিজেই। লেখকরা কোনোমতেই নয়।
তবে আশার কথা এই, ভালো মানুষ, ভালো আমলা, ভালো আরক্ষা এবং সর্পোপরি ভালো রাজনীতিবিদ আছে বলেই এখনো সমাজ সংসার টিকে আছে। পুলিশ আমাদেরই ভাই বা স্বজন। অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে, অন্ধকারের হায়েনাদের বিরুদ্ধে তাদের সকল যুদ্ধে আমাদের মতো সুবোধ সিভিলিয়ানরা পুলিশের পাশেই থাকবে। তবে জনগণের স্বার্থ পরিপন্থী কোনো জজ মিয়া সিন্ড্রমের আমুদে সমর্থক হওয়াটা আমাদের কর্ম নয়।
মনে রাখা ভালো যে, উগ্র সেকুলারিজম, উগ্র বাঙালি জাতীয়বাদ, উগ্র বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, উগ্র চিন্তক, উগ্র ধার্মিকের মতো উগ্র পুলিশও পরিত্যাজ্য। উগ্রদের আশ্রয় হলো অজস্র মিথ্যা। আর মিথ্যার ঠিকানা হলো পশ্চাদপদ মধ্যযুগীয় চোরাবালি। কাজেই অতি অহংকার নয়, বাগাড়ম্বরতা নয়, সহজ সরল পথ খোঁজা, সাদাসিধা কথা বলা, বুদ্ধিদীপ্ত বিনয়াবনত বীরদেরই আমরা পূজা করব।
সবকিছু সামাল দিয়ে ফেলেছে, বাংলাদেশের মানুষকে আরামে ঘুম পারিয়ে রেখেছে পুলিশের এমন বাড়াবাড়ি আত্মবিশ্বাসের ভিড়ে যেন এমনটা সর্বৈব সত্য না হয় যে, আমাদের প্রাইম মিনিস্টারকে মক্কা নগরের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে হয় আর ভারতের প্রাইম মিনিস্টার এসে আমাদের ঢাকা রামকৃষ্ণ মিশন পাহারা দিতে লেগে যান। ভিতর বা বাহির কোনো জঙ্গিপনাতেই আমাদের সার্বভৌমত্বের ওপর প্রশ্নবোধক চিহ্ন আঁকা চলবে না।
১৮ মাসে অন্তত ৩৮ জনকে খুন করেছে গোপন আততায়ীরা। পুরোহিত, যাজক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে সাধারণ দরজি কেউই রেহাই পাচ্ছেন না এদের হিংস্র আক্রোশ থেকে। কিন্তু পুলিশের কিছু ক্রসফায়ার কেচ্ছা ছাড়া আর কোনো সফলতা আছে তা জোর গলায় বলা কারো সাজে না!
কাজেই সমালোচনাকে অসহ্য ঠাওরে নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় আসীন রাখতে বন্ধুত্ব, হৃদ্যতা বা আত্মীয়তার আবেগে খোচা দিয়ে কথামালার আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার সময় এখন নয়, আমরা দেখতে চাই শুধুই কাজ। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ ঠ্যাংগারো পুলিশি রাষ্ট্র হয়ে উঠবে না, তবে সুশৃঙ্খল পুলিশই এনে দিবে মানুষের জন্য সুন্দর প্রভাত। পরস্পরবিরোধী ব্লেম গেম নিপাত যাক, অপশক্তির বিরুদ্ধে পুলিশের সত্যিকারের যুদ্ধটা এগিয়ে চলুক। আর কবি কুসুমকুমারী দাশের 'আদর্শ ছেলে' কেবল আশাবাদে না থেকে বাস্তবানুগ হয়ে উঠুক।
আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?
মুখে হাসি, বুকে বল তেজে ভরা মন
মানুষ হইতে হবে- এই তার পণ!!
লেখকঃ সাংবাদিক, মাছরাঙা টেলিভিশন
২৫ জুন ২০১৬
facebook.com/fardeen.ferdous.bd
twitter.com/fardeenferdous