সড়ক ব্যবস্থাপনায় নারী: মায়ের হাতে প্রাণের বাংলাদেশ!

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 5 July 2016, 03:11 AM
Updated : 5 July 2016, 03:11 AM

বিগত বছরগুলোর মধ্যে এবার ঈদের আগে মহাসড়কে অনেকটা যানজট ভোগান্তি ছাড়া ঘরমুখো মানুষেরা স্বজনদের কাছে ফিরতে পারছেন। ঈদের দু'তিন দিন আগে রাজধানীর আশেপাশে হাজার হাজার যাত্রীকে হয়ত গাড়ির জন্য স্টেশনে অপেক্ষা করতে হচ্ছে, কিন্তু তারপরও ঘন্টার পর ঘন্টা একইস্থানে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকা, রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাস ট্রাকের খোলা ছাদে নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের অবর্ণীয় দুর্ভোগ পোহানোটা এবার চোখে পড়ছে না। এর কারণ হতে পারে, মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি, রাস্তার পরিসর বাড়ানো, সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাড়তি তৎপরতা ইত্যাদি।

তবে এবার সাংবাদিক হিসেবে মহাসড়কের সংবাদ কাভার করতে গিয়ে যে বিষয়টি সবচে' বেশি নজর কেড়েছে তা হলো, সড়ক ব্যবস্থাপনা বা ট্রাফিকিং এ স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেব কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া অল্প বয়সী তরুণ-তরুণীরা। তাও আবার অপরাপর শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমান্তরালে তাল মিলিয়ে স্বচ্ছন্দে খুব সাবলীলভাবে নারীরাও তাদের কর্তব্য পালন করছেন।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবারের ঈদের আগে মহাসড়ক ব্যবস্থাপনায় রোভার স্কাউটদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। এর সুফলও মিলছে ভালো। এখন পর্যন্ত ঢাকার প্রবেশমুখগুলোতে যানজট দানা বাঁধতে পারেনি। নানা বয়সী সড়ক ব্যবহারকারীদের সেবা দেয়াটা উপভোগ করছেন বলে জানান স্বেচ্ছাসেবকরা।

এবারের ঈদের ৫দিন পূর্ব থেকে রাজধানীর আশেপাশের ১৬টি যানজটপ্রবণ পয়েন্টে মহাসড়ক ব্যবস্থাপনায় ১ হাজার স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দেয়া দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত এয়ার, নেভাল ও রোভার স্কাউটের নারী ও পুরুষ সদস্যরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন। দিনে তিন শিফটে বিভক্ত হয়ে ৮ ঘন্টা করে দায়িত্ব পালন করছেন তারা। প্রতি শিফটের জন্য প্রতি স্বেচ্ছাসেবকের জন্য ৯ শ টাকা সম্মানীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিশু, নারী ও বৃদ্ধদের সড়ক পারাপারে সাহায্য, অসুস্থ্যকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা বা বিশ্রামের ব্যবস্থা করা, রোজাদারের ইফতার বা সাহরীতে সহায়তা এবং যানবাহনের যথার্থ গমনাগমনে ভূমিকা রাখছেন এসব স্বেচ্ছাসেবকরা। ছাত্রাবস্থায় সেবামূলক এই দায়িত্ব পালনকে উপভোগ করছেন বলে জানান তারা। ঘরমুখো মানুষের ঈদযাত্রাকে নির্বিঘœ করতে এসব নারী ও পুরুষ স্বেচ্ছাসেবকদের দায়িত্বপালনকে স্বাগত জানিয়েছে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার সড়ক ব্যবহারকারীরাও।

এর ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে ভালো। এখন পর্যন্ত ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের গাজীপুর অংশের সবচে' যানজটপ্রবণ এলাকা চন্দ্রামোড়সহ ঢাকার চতুর্পাশে অন্যান্য প্রবেশমুখগুলোতে যানজট দানা বাঁধতে পারেনি। যানজট নিরসনে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগকে অভিনব বলেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

মন্ত্রী জানিয়েছেন, এবারই প্রথম ঈদের আগে যানজট নিরসনে রোভার স্কাউটদের স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। নারী স্কাউটরা তাদের ছেলে বন্ধুদের সাথে রীতিমতো পাল্লা দিয়ে নিষ্ঠার সাথে অর্পিত দায়িত্ব পালন করছেন।

ওরা যখন সড়ক ব্যবহারকারী কোনো নারী ও বয়োবৃদ্ধকে হাত ধরে এবং শিশুদেরকে কোলে করে রাস্তা পারাপার করে দেন, তখন মমতাময়ী মায়ের আদর, স্নেহ আর ভালোবাসার কথাই মনে করিয়ে দেয়। ধুলো, রোদ বা বৃষ্টির ধকল সয়ে ঘরমুখো মানুষের ঈদযাত্রা নির্ঝঞ্ঝাট করতে পুরুষের সাথে সমযোগ্যতায় সড়ক নিরাপত্তা দিয়ে যাচ্ছেন এই নারীরা। মনে হয়, এইতো সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সমতার বাংলাদেশ! সমতার হাত ধরে এগিয়ে চলছে যে বাংলাদেশ, সেই সমতা ও মমতার কারিগর মায়েদেরকে স্যালুট না জানিয়ে উপায় আছে? যে মায়েরা দিনরাত শ্রম দিয়ে মহাসড়কের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানে এভাবে দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁদের জন্য হাত তুলে থাকবে পুরো বাংলাদেশের প্রাণান্ত প্রার্থনা!

আর এই দুঃসাহসী মায়েদের জন্যই দ্রোহ ও সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম পঙক্তি রচনা করেছেনঃ
হাতে রুলি, পায়ে মল
মাথার ঘোমটা ছিড়ে ফেল নারী;
ভেঙ্গে ফেল ও শিকল
যে ঘোমটা তোমায় করিয়াছে ভীরু
ওড়াও সে আবরণ,
দূর করে দাও দাসীর চিহ্ন
যত আভরণ।

নারীর স্বাতন্ত্রবোধ কেড়ে নিয়ে তার জন্য একশ্রেণির পুরুষ তৈরি করতে চায় অসংখ্য শক্ত শেকল বা অন্ধকার বাতাবরণ। সাংসারিক জীবনে সেইসব পুরুষের মনোরঞ্জনের সুবিধার্থে নারীকে করে ভিন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত। নামিয়ে আনে দাসীর পর্যায়ে। ঐ পুরুষেরা চায় নারীকে অন্ত:পুরবাসিনী করতে। কিন্তু দিন তো বদলাচ্ছে, তাই না। মানুষ বাঁচে কর্মে। তার আবার নারী-পুরুষ ভেদ কেন?

মনে রাখা দরকার, ঘর থেকে বের হয়ে ২৫ লাখ নারী শ্রমিক যদি আমাদের রেমিট্যান্সের প্রধান সূত্র পোশাক কারখানাগুলোতে কাজ না করতেন তবে বিশ্ব মানুষের আব্রু ঢাকবার আবরণের কি খবর হতো আর দেশের সুখ স্বাচ্ছন্দেরই বা কী হতো, কে জানে? আর সেই নারীরা যখন ব্যস্ত ও বিপদসংকুল সড়ক পথে ঈদ উদযাপন করতে দূর-দূরান্তে নিজ গৃহে স্বজনের কাছে ফিরছেন, তাদের নিরাপত্তাও দিচ্ছেন অপর নারী স্বেচ্ছাসেবীরা। এ এক দুর্দান্ত পদক্ষেপ, প্রাগ্রসর ভাবনা, মনে করা যেতেই পারে!

কবি নজরুল ইসলাম যে, জোর দিয়েই বলেছিলেন,
সাম্যের গান গাই
আমার চক্ষে পুরুষ রমণী
কোন ভেদাভেদ নাই!

এবার মায়েদের হার্দিক সেবায় মহাসড়কে যানজট বিড়ম্বনামুক্ত যাত্রার সুযোগ মেলায় সবার ঈদ উৎসব সত্যিকারের আনন্দমুখর ও সুখকর হবে-একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। কাজেই শুধু মহাসড়কে নয়, সমাজের সর্বস্তরে এভাবে নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাবলম্বীতা ও কর্মসংস্থানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হোক মানুষ হিসেবে সম অধিকার। মমতাময়ী মায়ের হাতেই থাকুক প্রাণের বাংলাদেশ।

লেখকঃ সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
০৫ জুলাই ২০১৬
facebook.com/fardeen.ferdous.bd
twitter.com/fardeenferdous