আনন্দ ও সুন্দরের অমৃতসাধক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর!

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 6 August 2016, 06:23 AM
Updated : 6 August 2016, 06:23 AM

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (২৫ বৈশাখ, ১২৬৮ – ২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) সাহিত্যভাবনার মূল সত্য হ'লো আনন্দ। স্রষ্টা ও সৃষ্টি, বিষয় আর বিষয়ী কিংবা লেখক-পাঠকের যে যুগপৎ মেলবন্ধনের আত্মানুভব বা বৈশ্বিক উপলব্ধি- তাই হ'লো এই আনন্দের সারকথা। সুখ-দুঃখ, লজ্জা-ভয়, ক্রোধ-বিস্ময়, রাগ-অনুরাগসমেত জীবনরসের সামগ্রিক দর্শনকে উপজীব্য করে জীবনব্যাপী এই আনন্দ অভিযাত্রায় সত্য ও সুন্দরের অন্বেষাটাকেই পরাণসখা বন্ধু করেছিলেন জীবন গানের মহাশিল্পী রবীন্দ্রনাথ। এই আনন্দ বন্দনায় যথার্থ সুর সেধেছেন কবি:
আনন্দধারা বহিছে ভুবনে,
দিনরজনী কত অমৃতরস উথলি যায় অনন্ত গগনে।


মানবাত্মার প্রকৃত দর্শন অথবা জীবন ও প্রকৃতির বহুমাত্রিক ধারাকে কথার জাদুতে বেঁধে বাঙালির শাশ্বত চৈতন্যকে যিনি চিন্তা ও বোধের উৎকর্ষে রূপায়িত করেছেন- তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আজ ২২ শ্রাবণ বাঙালি চৈতন্যের এই প্রবাদপুরুষের ৭৫তম প্রয়াণবার্ষিকী। পরম শ্রদ্ধা ও গভীর ভাবগাম্ভীর্যে 'আমার সোনার বাংলা'র কারিগর ও স্বপ্নদ্রষ্টা প্রিয় কবিগুরুকে স্মরণ করছি।

প্রকৃতিকে, মানবসমাজকে এবং বিশ্বজগৎকে সর্বাঙ্গে ছুঁয়ে থাকা মানুষ তার সামগ্রিক ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে সম্প্রসারিত করে এবং বাহিরকে নিজের মধ্যে স্বীকৃত করে। শেষের মধ্যেই থাকে অশেষ। মানবজীবনের এই যে ভিতর বাহিরের নিরন্তর মিলন সাধনা-এটাই সাহিত্য। আর এই মিলনের পথ ধরে নিগূঢ় সাধনায় রাবীন্দ্রিক সাহিত্যকীর্তি হয়ে ওঠেছিল সৃষ্টিশীল ও আনন্দবাদী। একাশি বছরের দীর্ঘজীবনে গানে, কথায়, গল্প, নিবন্ধের গদ্য আর ছন্দে গুরুদেব মানুষ, প্রকৃতি বা জীবনদেবতার স্বরূপ উন্মোচনের মধ্য দিয়ে প্রমাণ রেখেছেন- জীবনই আসলে সাহিত্য। সেই জীবনের পরম শান্তির সন্ধানটাকে তাই সাহিত্যকেই ব্যাপৃত করা ছাড়া উপায় থাকে না।

কাজেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কাব্যসাহিত্যে ভাবগভীরতা, গীতিধর্মিতা চিত্ররূপময়তা, আধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোম্যান্টিক সৌন্দর্যচেতনা, ভাব, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য, বাস্তবচেতনা ও প্রগতিচেতনার মধ্য দিয়ে প্রেম ও আনন্দের যে সত্তাকে ধারণ করেছিলেন। তা সমকালেও যেমন সমান প্রাসঙ্গিক আছে এবং ভবিষ্যতেও তার ব্যতিক্রম অতি অকল্পনীয়।

বিশ্বকবি জীবনে বারো বার দেশের বাহির হয়ে ৫টি মহাদেশের ত্রিশটির বেশি দেশ ভ্রমণ করেন। ব্যাপকভাবে বিশ্বভ্রমণ করার কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সমসাময়িক অরি বের্গস, আলবার্ট আইনস্টাইন, রবার্ট ফ্রস্ট, টমাস মান, জর্জ বার্নার্ড শ, এইচ জি ওয়েলস, রোম্যা রোলা প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছিলেন। ১৯১২ সালে ব্যক্তিগত চিকিৎসার জন্য তৃতীয়বার ইংল্যান্ডে গিয়ে ইয়েটসসহ কয়েকজন ইংরেজ কবি ও বুদ্ধিজীবীদের কাছে নিজের সদ্যরচিত গীতাঞ্জলি কাব্যের ইংরেজি অনুবাদ পাঠ করে শোনান। কবিতাগুলি শুনে তাঁরা মুগ্ধ হন। শেষ পর্যন্ত সুইডিশ একাডেমীও ঐ কাব্যসুধায় প্রীত হয়ে ১৯১৩ সালে রবি ঠাকুরকে নোবেল প্রাইজে সম্মানিত করে। এভাবে বিশ্বপরিক্রমার ফলে ভারতের বাইরে নিজের রচনাকে পরিচিত করে তোলার এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে রাজনৈতিক মতবিনিময়েরর সুযোগও পান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

জীবনের একেবারে শেষপর্বে পারস্য, ইরাক এবং সিংহল ভ্রমণের সময় মানুষের পারস্পরিক ভেদাভেদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তার বিতৃষ্ণা খুব তীব্র হয়েছিল। তবে বিভিন্ন রাষ্ট্র পরিভ্রমণ করে মানবজাতির মধ্যে বহুবিধ বিভাজন সৃষ্টির হীনতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের নিজের মতও সুদৃঢ় হয়।
১৯৩২ সালের মে মাসে কবিগুরু ইরাকের একটি বেদুইন শিবিরে গিয়েছিলেন। সেখানে এক মুসলিম উপজাতীয় নেতা তাঁকে বলেন,
:আমাদের মহানবী বলেছেন, তিনিই সত্যিকারের মুসলমান, যাঁর বাক্য বা কর্মের দ্বারা তাঁর ভ্রাতৃপ্রতিম মানুষগুলির ন্যূনতম ক্ষতিসাধনও হয় না।
এমন কথায় বিস্মিত হয়ে কবি তাঁর ডায়েরিতে লিখে নিয়েছিলেন,
:চমকে উঠলুম। বুঝলুম তার কথাগুলিই মানবতার মূল কথা।

বাংলাদেশের বর্তমান অস্থির সময়ে ধণিকশ্রেণির শিক্ষিত যুবাদের বিপথগামিতার কালে মহানবীর এই আপ্ত বাক্য বড়ই প্রাসঙ্গিক।


জীবনের শেষ ভাগে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তীব্রতম প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩৪ সালে ব্রিটিশ বিহার প্রদেশে ভূমিকম্পে শতাধিক মানুষের মৃত্যুকে মহাত্মা গান্ধী 'ঈশ্বরের রোষ' বলে অভিহিত করলে, রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজির এহেন বক্তব্যকে অবৈজ্ঞানিক বলে চিহ্নিত করেন এবং প্রকাশ্যে তাঁর সমালোচনা করেন। সেসময় কলকাতার সাধারণ মানুষের আর্থিক দুরবস্থা ও ব্রিটিশ বাংলা প্রদেশের দ্রুত আর্থসামাজিক অবক্ষয় তাঁকে বিশেষভাবে বিচলিত করে তুলেছিল। এর প্রতিবাদে তিনি লেখালেখিতেও সরব ছিলেন।

১৯৪০ সালের শেষ দিকে অসুস্থ হয়ে পড়েন কবি। দীর্ঘ রোগভোগের পর, শল্য চিকিৎসার জটিলতার কারণে, ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট (২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) কলকাতার জোড়াসাঁকোতে অবস্থিত বাসভবনে প্রয়াত হন রবীন্দ্রনাথ। জোড়াসাঁকোর সেই বাড়িতেই কবির জন্ম ও বেড়ে ওঠা।
ভবিষ্যৎদ্রষ্টা কবি বাংলা ১৩১৭ সালের ২২ শে শ্রাবণ লিখেছিলেন,
তোমার দয়া যদি
চাহিতে নাও জানি
তবুও দয়া করে
চরণে নিয়ো টানি।
… …
মৃত্যু ভেদ করি
অমৃত পড়ে ঝরি,
অতল দীনতায়
শূন্য উঠে ভরি।
এই পঙক্তিমালা গীতাঞ্জলি'র শেষের দিকে কবি স্থান দিয়েছিলেন। মারা যাওয়ার একত্রিশ বছর আগেই ২২ শ্রাবণে অতল দীনতায় মৃত্যু ভেদ করে অমৃতের সন্ধান করেছিলেন কবি।


বড় দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতি বিজড়িত রুদ্ধ কক্ষটিকে মনে রেখেই রবীন্দ্রনাথ 'রুদ্ধ গৃহ' নামে প্রবন্ধ লেখেন, যা তাঁর জীবনমরণভাবনার স্থায়ী দিক-নির্দেশক। এ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন-
এ জগতে অবিশ্রাম জীবনের প্রবাহ মৃত্যুকে হু হু করিয়া ভাসাইয়া লইয়া যায়, মৃত্যু কোথাও টিকিয়া থাকিতে পারে না…পৃথিবী মৃত্যুকেও কোলে করিয়া লয়, জীবনকেও কোলে করিয়া রাখে, পৃথিবীর কোলে উভয়েই ভাইবোনের মতো খেলা করে। পৃথিবীতে যাহা আসে তাহাই যায়। এই প্রবাহেই জগতের স্বাস্থ্য রক্ষা হয়। কণামাত্রের যাতায়াত বন্ধ হইলে জগতের সামঞ্জস্য ভঙ্গ হয়।
গীতাঞ্জলি কাব্যের সর্বশেষ কাব্যে কবিগুরু তাই যথার্থ বলেছেন,
দিবস যদি সাঙ্গ হল, না যদি গাহে পাখি,
ক্লান্ত বায়ু না যদি আর চলে
এবার তবে গভীর ক'রে ফেলো গো মো'রে ঢাকি
অতি নিবিড় ঘনতিমিরতলে
স্বপন দিয়ে গোপনে ধীরে ধীরে
যেমন করে ঢেকেছ ধরণীরে,
যেমন করে ঢেকেছ মুদিয়া-পড়া আঁখি,
ঢেকেছ তুমি রাতের শতদলে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নশ্বর শরীর নিয়ে হয়ত আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর দর্শন, ভাবনা ও বোধ সত্য, মুক্তি ও প্রাণশক্তির ত্রয়ীরূপে বাঙালি মানসকে যুগ যুগ জাগিয়ে রাখবে। জ্ঞান, চিন্তা বা তর্কে গুরুদেব চিরভাস্বর থাকবেন। আজ বাইশে শ্রাবণে তাই অনন্ত রোদন নয়, বরং ভরা বর্ষার আনন্দ সমাগমে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে আমাদের ছুঁয়ে যাক চির প্রাণময় রবি ঠাকুর।

লেখকঃ সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
২২ শ্রাবণ ১৪২৩/ ০৬ আগস্ট ২০১৬
facebook.com/fardeen.ferdous.bd
twitter.com/fardeenferdous