ঈদ আনন্দে ভোগান্তির পীড়া আর কতকাল?

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 8 Sept 2016, 01:18 AM
Updated : 8 Sept 2016, 01:18 AM

আর্থিক সক্ষমতায় আমরা এখন মধ্যম আয়ে পৌঁছে গেছি। নানামুখী সাফল্যে বিশ্বের সকল চক্ষুষ্মানের নজর কাড়ছি আমরা। কিন্তু নানাপদে মানুষের ভোগান্তির রেকর্ড ভেঙ্গেই চলেছি। বিশেষ করে ঈদযাত্রায় গণমানুষের ঘরে ফেরাকে অশান্তির মোড়ক থেকে বের করতে পারছি না। সময়ের এক ফোড়, অসময়ের দশ ফোড় প্রবচনটির স্রষ্টা সময়ের কাজ সময়ে করাকেই গুরুত্ব দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই উপদেশ আমরা শুনব এমন ধাতুতে আমরা গড়া নই। ঈদ ঘণিয়ে এলে সড়ক সংস্কার, জাহাজ মেরামত, ফিটনেসবিহীন গাড়ি জব্দসহ ইত্যাকার নানা ব্যবস্থাপনার তোড়জোড় চোখে পড়ে। আর বাকী সময় শৃঙ্খলার শৈথিল্য ও নজরদারিহীনতা আকাশ স্পর্শ করে। যার ফলে প্রতিটি ঈদের আনন্দের সাথে ভোগান্তি বা বিড়ম্বনা হাত ধরাধরি করেই চলে। এতে কোনো শ্রেণির পদাধিকারিদেরই বিকার নামের অনুভূতিতে কিছু আসে যায় -এমনটা দেখা যায় না। ভোগান্তি লাঘবের প্রচেষ্টারা কাজ না করতে করতে উদাসীন চৈতন্যের অসারতাই যেন প্রকৃত সার।

অতএব, যারা নাড়ির টানে ঈদে বাড়ি যাবেন, ঘন্টার ঘণ্টা রাস্তায় ক্ষণ গুনবেন, আবার গাড়ি চললেও, বেপরোয়া যানচালক লক্কড়ঝক্কর গাড়িটা জরাজীর্ণ মহাসড়ক দিয়ে চালিয়ে নিয়ে আপনার প্রাণপ্রদীপটা যথাস্থানে পৌছে দিতে পারবেন -এমন নিশ্চয়তা পাবেন না। ট্রেনের টিকিটের জন্য হাপিত্যেশ করে মরবেন, ছাদেও জায়গা মিলবে না। লঞ্চে নদী পাড়ি দেবেন, বিশাল জলরাশির ভয়াল স্রোত ঠেলে বাড়ি পৌছবেন এই গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না। বছরের পর বছর ধরে ঘটে চলা এইসব যন্ত্রণার স্থায়ী ও টেকসই সমাধান কেউ ভাবে না।

এবারও রোজার ঈদের মতো কোরবানির ঈদেও নির্বাহী আদেশে ছুটি বাড়িয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু সেই ছুটিটা পরিবার পরিজনের সাথে কাটিয়ে বিশেষ উপভোগ্যতায় নিয়ে যাবেন -তা কি হবে? মহাসড়কের নানা জঞ্জালের সাথে এবার উৎসবের প্রধান অনুষঙ্গ গরুর হাট বসে গেছে সেই সড়ক ঘেঁষেই। গরুবাহী গাড়ি আসবে, গরু নামবে অথবা ক্রেতা গরু গাড়িতে উঠিয়ে বাড়ি নিয়ে যাবেন, তারপর আপনার গাড়ি চলবে। কাজেই ছুটি বাড়ল বলেই মহাসড়কের ভোগান্তি থেকে রেহাই মিলবে -ব্যাপারটা তেমন নাও হতে পারে। ঈদযাত্রার ভোগান্তি থেকে আপনার মুক্তি আলোয় আলোয় ঐ আকাশে নাও ঘটতে পারে। প্রতি ঈদেই যা সঙ্গি -সেই সঙ্গি এবার তিরোহিত হবে তেমন কার্যকরণ চোখে পড়েনি -কেবল 'ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক হবে, আরামদায়ক হবে' জাতীয় চাপাবাজি ছাড়া। একথা মনে রেখেই হাজার হাজার ঘরমুখো মানুষের ঈদযাত্রা শুরু করা চাই যে, কথায় চিড়ে ভিজে নাই কোনোদিন আর ভিজবেও না। কারণ আমাদের দেশে সেই ছেলে এখনো হয়নি যে কথায় না বড় হয়ে হঠাৎ করে কাজে বড় হয়ে উঠবে। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা তেমনটাই বলে।


প্রতি ঈদেই আমরা দেখে আসছি মানুষের অন্তহীন ভোগান্তি। স্বজনের ভালোবাসার টানে তবু সবটাই মেনে নেন সবাই। কিন্তু সভ্যতার পথে পা রাখতে চাইলে এমন মানবেতর পরিস্থিতির নাগাল টেনে ধরাটা ক্ষমতাসীনদের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে।

আপ্রতি ঈদের আগেই মরা দেখি রাজধানীর বাস টার্মিনালগুলোতে বাড়িফেরা মানুষের ভিড়। দক্ষিণবঙ্গগামী লঞ্চে তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না। ট্রেনের টিকেট নির্ধারিত সময়ের আগেই সাবাড় হয়ে যায়। ট্রেনের শিডিউলে মহাবিপর্যয় ঘটে, যানবাহনের চাপ ও সড়ক ব্যবস্থাপনার শিথিলতার কারণে যানজট সৃষ্টি হয় গাজীপুর-চন্দ্রা-টাঙ্গাইল, আব্দুল্লাহপুর-আশুলিয়া-বাইপাইল এবং কাওড়াকান্দি-শিমুলিয়া, পাটুরিয়া-দৌলদিয়া ও আরিচা ফেরিঘাটে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টেও থাকে একই অবস্থা। এসময় একদিকে গাড়িগুলো আটকে থাকে মহাসড়কে অন্যদিকে রাজধানীতে গাড়ি ঢুকতে না পারায় বিপুল সংখ্যক যাত্রীকে ঘরে ফেরার অপেক্ষায় থাকতে হয়। এছাড়া মহাসড়কে দিনব্যাপী যানজটে সবচেয়ে নাকাল হন নারী, শিশু ও বয়োবৃদ্ধরা। পানীয় জল, খাবার সংকটের পাশাপাশি শৌচাগারের অভাবে দুর্বিষহ বিড়ম্বনায় পড়তে হয় মানুষকে। আরও দুঃখের কথা হলো যানজটের এমন দুর্বিপাকের কালে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাউকে ধারেকাছে দেখা যায় না। সংশ্লিষ্ট সকলপক্ষই তখন হাল ছেড়ে বসে থাকেন। আর নাকাল হওয়া যাত্রীরা নিতান্ত নিরুপায় হয়ে মেজাজ ঠিক রাখতে না পেরে সরকার তথা সড়ক ব্যবস্থাপনায় দায়িত্বরতদের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করতে থাকেন।

বরাবরের মতো সীমাহীন দুর্ভোগে পড়ে সাধারণের ঈদের ছুটি যাতে ম্লান না হয় -সেক্ষেত্রে সড়ক ব্যবস্থাপনার কাজটি একই ধারাপাতে বছরব্যাপী চালু রাখতে পারে সড়ক বিভাগ। পুলিশের ট্রাফিকিংটাও যদি সর্বোচ্চ সততায় চালানো যায়, যেমন ফিটনেসবিহীন যান চলাচল বন্ধ, লাইসেন্সবিহীন চালক কিংবা শিশু চালকদেরকে গাড়ি চালাতে না দেয়া, যত্রতত্র পার্কিং থেকে চালকদের নিবৃত করা। ট্রেন, বাস বা লঞ্চ যাত্রীর চাহিদামাফিক প্রতুল করা এবং সর্বোপরি যোগাযোগ ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। তবেই দুর্ভোগের লাগাম টেনে ধরা যেতে পারে।

প্রতি বছরই আনুপাতিক হারে যাত্রী ও গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু রাস্তাার উন্নয়ন সেই হারে বাড়ছে না। ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত হওয়ায় সেদিকের যাত্রীদের হয়ত খানিকটা রেহাই মিলবে। কিন্তু ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের চারলেনে উন্নীতকরণের কাজ কেবল শুরু হওয়ায় সেদিকের যাত্রীদের ভোগান্তিকেই সাথী করতে হবে। ওই রুট ব্যবহারকারীরা এখনই ঘন্টার পর যানজটে নাকাল হচ্ছেন। তার ওপর এবার ঈদযাত্রাতেও বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকতে পারে। আর বৃষ্টি যদি নামে তবে গরু বোঝাই ট্রাকের ধকল সামলে মহাসড়কে যান চলাচল কতোটা স্বাভাবিক থাকবে -তা ভবিতব্যই বলবে। তবে যাত্রী কিংবা সড়ক সংশ্লিষ্টদের অধিকতর সতর্ক হওয়ার সময় এখনই।

উৎসবের আনন্দকে পরিবারের স্বজন, নিকটাত্মীয় বা বন্ধু-বান্ধবদের সাথে সর্বাঙ্গীনভাবে প্রকৃত উদযাপনে মাতিয়ে রাখতে ঘরমুখো মানুষের ঈদযাত্রাকে নির্বিঘ্ন করার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের নজরদারি বাড়ুক সবখানে। মানুষের ঈদযাত্রা হোক সাবলীল ও আনন্দময়।

লেখকঃ সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬
twitter.com/fardeenferdous
facebook.com/fardeen.ferdous