কলসিন্দুরের ফুটবল কন্যাঃ এই মণিহার আমায় নাহি সাজে

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 8 Sept 2016, 04:50 PM
Updated : 8 Sept 2016, 04:50 PM

১৯১৫ সালে ইংল্যান্ডের রাণী ভিক্টোরিয়া বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে 'নাইটহুড' উপাধি দেন। কিন্তু ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ বাহিনী কর্তৃক পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে নিরীহ মানুষ হত্যার প্রতিবাদে কবিগুরু সেই 'নাইট' উপাধি ত্যাগ করেছিলেন। আর লিখেছিলেন সেই অমর গানঃ

এই মণিহার আমায় নাহি সাজে…
এরে পরতে গেলে লাগে, এরে ছিঁড়তে গেলে বাজে।।
কণ্ঠ যে রোধ করে, সুর তো নাহি সরে।
ওই দিকে যে মন পরে রয়, মন লাগে না কাজে।

কবিগুরু যতবড় দুঃখে তাঁকে দেয়া সম্মান ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, আমাদের দুঃখ তারচেয়ে কোনো অংশে কম নয়। আমাদের কন্ঠ আজ রোধ হয়ে আসছে। কোন বিভীষিকার মধ্যে আমরা এসে পৌছেছি? যেখানে নিজেদের মেয়েদের প্রাপ্য সম্মানটুকুও আমরা দিতে পারি না, মায়ের ন্যূনতম মর্যাদাও আমরা রাখতে জানি না!

গেল কয়েকদিন যে অনূর্ধ্ব-১৬ স্বর্ণকিশোরীরা আমাদের ফুটবল অঙ্গন মাতিয়ে দিয়ে বিশ্ব সভায় নাম লেখাল, সেই তাদেরকেই কিনা চরম অসম্মান ও লাঞ্ছনা উপহার দেয়া হলো। খেলা শেষে কোনো নিরাপত্তা না দিয়ে একটি লোকাল বাসে করে ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার উপজেলার কলসিন্দুরে তাদের আঁতুরঘরে ফেরৎ পাঠানো হলো। গাড়িতে অভিভাবকহীন এসব কীর্তিমতি ফুটবলারদেরকে একা পেয়ে উত্যক্তও করে ছাড়ল কিছু কাপুরুষ। অল্পবয়সী এই মেয়েদের প্রতি এতোটা অসম্মান, অযত্ন, উপেক্ষা, অনাদর ও অবহেলা কেন? তারা মেয়ে বলে? এই প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে সর্বত্র।

মেয়ে বলে তাদের কপালে নিরাপদ এসি বাস জুটবে না, মুড়ির টিনে করে পাবলিকলি তাদেরকে ছেড়ে দিতে হবে? এই ক'দিন ওরা বিশ্বের ৫টি দলকে টানা হারিয়ে দিয়ে অপরাজিত থেকে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের মূল পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে গিয়ে যে মাপের ক্রীড়ানৈপূণ্য দেখিয়েছে -তার ধারেকাছে পারফর্মেন্সও যদি কোনো ছেলে দল করত, তাদেরকে মাথায় তোলে নাচার লোকের অভাব হতোনা। অথচ মেয়েরা বলেই মুড়ির টিন বাস, টিজিং-টিপ্পনী আর চুড়ান্ত অবহেলা। এই স্বর্ণপ্রভা মেয়েরা এতো অল্প বয়সে আসলে আমাদের একটু বেশিই সাফল্য এনে দিয়েছে। যা আমাদের আর সইছে না। কুকুরের পেটে কি আর ঘি হজম হয়। তাই রবিঠাকুরের মতো করে আমাদের বলবার সময় এসেছে, এই মণিহার আমায় নাহি সাজে…!

ভারতীয় সীমান্তবর্তী ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনপদ কলসিন্দুর। উন্নতির সকল সূচকে পিছিয়ে থাকা প্রান্তিক এই গ্রামের মেয়েশিশুরা তাক লাগিয়ে দিচ্ছে ফুটবল খেলে। দেশ ও বিদেশের মাটিতে অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়ে বাংলাদেশের মাথা উঁচু করে দিচ্ছে তারা। ফুটবলের এই কুশলী শিল্পীরা প্রিয় লাল-সবুজ পতাকার গৌরব বাড়িয়েই চলেছে। কলসিন্দুরের ১০ কন্যা মার্জিয়া আক্তার, সানজিদা আক্তার, নাজমা আক্তার, শিউলি আজিম, মারিয়া মান্দা, মাহমুদা আক্তার, লুপা আক্তার, শামছুন্নাহার, তাসলিমা ও তহুরা আক্তার অনূর্ধ্ব-১৪ কিংবা ১৬ তে তাদের দুর্দান্ত ক্রীড়াশৈলি দেখিয়ে সবার মন জয় করেছে। এখানকার বেশিরভাগ ফুটবলারই বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ম্যাচগুলোতে খেলেছে। তাদের গ্রামীণ প্রশিক্ষক মফিজ উদ্দিন, অনূর্ধ্ব-১৬ জাতীয় দলের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের পাশাপাশি সকল ভক্তের প্রশংসায় ভাসছেন এই কিশোরী ফুটবলাররা। অধিনায়ক কৃষ্ণার নেতৃত্বে 'সি' গ্রুপে নিজেদের শেষ ম্যাচে আমিরাতকে ৪-০ গোলে, ইরানকে ৩-০ গোলে, সিঙ্গাপুরকে ৫-০, কিরগিজস্তানকে ১০-০ ও চাইনিজ তাইপেকে ৪-২ গোলে হারিয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের মূল পর্বে ঠাঁই করে নিয়েছে এই কিশোরীদের দল।

অথচ বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের কর্তারা সেই কিশোরি ফুটবলারদের অসম্মান উপহার দিয়েই ক্ষান্ত হননি। তাদেরকে ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে নিয়ে ফেলে দিয়েছেন। সাফ ফুটবলের টানা শিডিউল থাকায় এসব মেয়েরা নিজেদের স্কুল টিমে খেলতে অপারগতা প্রকাশ করেছে। আর কি চাই! ফুটবলারদের বাবাকে পেটাচ্ছে দুর্মুখো শিক্ষকেরা। এমনকি কলসিন্দুরের ৯ কিশোরী ফুটবলারকে জুতাপেটা করে স্কুল থেকে বহিষ্কারের হুমকিও দিয়ে দেয়া হয়েছে। যে মেয়েরা এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে টানা দুইবারের সেরা, তাদের আজ এই গতি। জীবনকে ভালোভাবে অনুভব বা অনুধাবন করবার আগেই পুরুষতান্ত্রিক বিশ্রী সমাজ তাদেরকে নিয়ে যেভাবে কাটাছিড়া করছে, তাতে ভবিষ্যতে মেয়েরা আর ফুটবল খেলতে সাহসী হবে -এমনটা মনে করবার আর কারণ নাই। মেয়েদের নৈপুণ্য দেখে যে কোচ ছোটন তাঁর শিষ্যদের 'স্যালুট' জানিয়েছিলেন, সেই স্যালুটের তবে এই গতি?

ইতিহাস গড়া মেয়েদেরকে আজ অঙ্কুরেই আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত করবার পায়তারা করছে কলসিন্দুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের শরীরচর্চা শিক্ষক জুবেদ তালুকদারের মতো কুলাঙ্গার কাপুরুষেরা। নারীরা ঘরের বাহির হয়ে সম্মান কুড়াবে, পুরুষের গলগ্রহ না হয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচবে -এটা কোনোকালেই পুরুষ মেনে নিতে পারেনি এখনো পারছে না। লজ্জার মাথা খাওয়া বিকারগ্রস্ত পুরুষ নিজের আত্মম্ভরিতা নিয়ে বড়ই অহংকারগ্রস্ত। নারী তার কাছে সর্বদা জুতাপেটার তুল্য। নারী তুমি মাথা তুলেছো কিংবা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছো তো পুরুষের সকল ঝাড়িঝুরির বিষাক্ত অনুভূতিরা ঝরঝর করে খসে পড়তে থাকবে। আর কি চাই? পুরুষ তখন চিৎকার করবে, মারবে, জুতাপেটা করবে, বহিষ্কারের ভয় দেখাবে, মুড়ির টিনে বাড়ি পাঠাবে, উত্যক্ত করবে। কীতিরা সব পুরুষের বাপের একার সম্পত্তি। সেইখানে তুমি ভাগ বসাবে নারী -এতোটা দুঃসাহস এই দেশে করতে যেয়ো না। এই দেশের ৯০ ভাগ মুসলমানের ভাবনাতে বাস করে হীনমন্যতা, কুপমন্ডুকতা, অশিক্ষা, বকধার্মিকতা আর ভন্ডামি। তারা এখনও ভাবে নারী অন্ত:পুরে থেকে কেবলই পুরুষের দাসত্ব কওে যাবে। ঘরের বাহির হওয়া তার চলবে না। ফুটবল খেলা তো দূরস্থান।

অথচ পুরুষ ক্রিকেটার সাকিব-মুশফিকদের জন্য সকল নিয়ম কানুন আলাদা। ওদের জন্য কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষারা পর্যন্ত থমকে দাঁড়াত। আর মেয়েদের বেলায় জুটে জুতাপেটা!

নারীর নেতৃত্বে পরিচালিত বর্তমান সরকার নারীর শিক্ষা বিস্তার, ক্ষমতায়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে বলে দাবি করা হয়। এমন বাস্তবতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কলসিন্দুরের প্রতিভাধর এই কন্যাদের অসম্মনের বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন কি? এই মেয়েদেরকে সসম্মানে ঢাকায় এনে তাদের আদি কোচ মফিজ উদ্দিনের তত্ত্বাবধানে রেখে নিরাপদ বাসস্থান ও শিক্ষার ব্যবস্থা করা যায় কি? আমাদের এই ক্ষুদ্র দাবির প্রতি সমর্থন থাকলে একদিন হয়ত বাংলাদেশের নারী ফুটবলে আরও বিস্ময়কর সাফল্যের দেখা পেয়ে আমরা আরও অকল্পনীয় আনন্দে ভাসতে পারি। সেদিনও কিছু পুরুষের কপালে ভাজ পড়বে জানি। তবু মায়ের মর্যাদায় মানবতা বেঁচে থাকুক না। সেই মণিহার আমাদেরও সাজুক। জয় হোক কলসিন্দুরের সুকন্যাদের। জয় হোক ফুটবলের।

লেখকঃ সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬
twitter.com/fardeenferdous
facebook.com/fardeen.ferdous