টেস্ট জয়: বাংলা ক্রিকেটের ইতিহাস যাত্রা

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 1 Nov 2016, 05:39 PM
Updated : 1 Nov 2016, 05:39 PM


নিরাপত্তা ব্যবস্তা নিয়ে শঙ্কায় ইংলিশ ক্রিকেট টিমের বাংলাদেশ ভ্রমণ নিয়ে বিস্তর জল ঘোলা হয়েছিল। সেই ইংল্যান্ড টিম বাংলাদেশে এসে আমাদের সান্নিধ্যে জমজমাট ক্রিকেট ম্যাচ উপহারও দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে ইংল্যান্ডকে হারানোর গৌরবের পাশাপাশি বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য নিরাপদ রাষ্ট্র এই চ্যালেঞ্জও জিতে গেলাম আমরা। ওয়ান ডে ও টেস্ট সিরিজ শেষে ইংলিশ ক্যাপ্টেন অ্যালিস্টার কুক জানিয়েছেন, বাংলাদেশে এসে খেলতে পেরে তারা গর্বিত। শুধু তাই নয় বাংলাদেশের আতিথেয়তা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থায় তিনি এতোটাই মুগ্ধ যে, মিরপুরে বাংলাদেশের কাছে হেরে যাওয়া শেষ টেস্টে পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে অকপটে জানিয়ে দিয়েছেন, এই সফরের আগে নিরাপত্তা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। এখানে আসা আদৌ উচিত হবে কি না, এসব নিয়েও কথা হয়েছে। কিন্তু আমার খুব ভালো লাগছে যে আমি বাংলাদেশে ইংল্যান্ড দলকে নেতৃত্ব দিতে পেরেছি। আমি এখানে আসতে পেরে সত্যিই গর্বিত। বাংলাদেশের এই জয় সত্যিই বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য দারুণ কিছু। মাঝেমধ্যে একটি খেলাতে অনেক কিছুই বড় হয়ে ওঠে। আমার মনে হয়, এই দেশে সবারই উচিত খেলতে আসা।

অস্ট্রেলিয়া টিমের এদেশে খেলতে না আসা এবং গুলশান ট্রাজেডির পর দেশে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠান নিয়ে অনিশ্চয়তার যে কালো মেঘ বাংলার আকাশে জমা হয়েছিল, ইংল্যান্ড দলের আনন্দঘন সফরের মধ্য দিয়ে সে মেঘ নিশ্চয় কেটে গেল। তার ওপর বাংলাদেশ ও ইংল্যান্ডের সদ্য শেষ হওয়া এই ওয়ান ডে ও টেস্ট সিরিজ এতোটাই রোমাঞ্চকর ও টানটান উত্তেজনাপূর্ণ ছিল যে, রৌদ্রকরোজ্জ্বল নতুন দিনের ক্রিকেট যাত্রাপথে এক অনিন্দ্য ইতিহাসে পদার্পণের সুশোভন সাক্ষী হয়ে থাকল এই ম্যাচগুলো।

কে না জানে ক্রিকেটের আদি ও অভিজাত দল হলো ইংল্যান্ড। যাদের হাত ধরে ক্রিকেট নামের এই মনোমুগ্ধকর খেলাটি পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। সেই তাদেরকে ক্রিকেটের সবচে' কুলীন পার্ট টেস্ট ম্যাচে হারানো অশেষ গৌরবের। অনন্য ইতিহাসই এটা। পাঁচদিনের ম্যাচ মাত্র তিনদিনে তাও আবার ১০৮ রানের বড় ব্যবধানে হারানো বিশাল মর্যাদার বটে। ২৭৩ রান তারা করতে গিয়ে দুই ইংলিশ ওপেনার শতরান পর্যন্ত ব্যাপারটাকে সহজ সমীকরণ বানিয়ে ফেলবেন মনে হয়েছিল। কিন্তু ক্রিকেট গভীর অনিশ্চয়তার খেলা; কখন কিভাবে কোনদিকে মোড় নেয় আগে থেকে ঠাওর করা প্রায়শ মুশকিল। এ বিষয়টি আবারও দেখিয়ে দিলেন মেহেদি হাসান মিরাজ ও সাকিব আল হাসান। তাদের ঘূর্ণি জাদুর মায়াজালে ইংলিশ ব্যাটসম্যানরা দাঁড়াতেই পারলেন না; এমনকি সামান্য প্রতিরোধ গড়তেও অসমর্থ হলেন। আর এর মধ্য দিয়ে আমাদের ১৯ বছরের উদীয়মান তরুণ ক্রিকেটার মিরাজ ঢুকে গেলেন ১৩০ বছরের ক্রিকেট ইতিহাসে। বাংলাদেশের জন্যও সাজিয়ে দিলেন বড় কাঙ্ক্ষিত উপহার। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম ঐতিহাসিক টেস্ট জয়ে সেই অনবদ্য ইতিহাসের নায়ক হয়ে গেলেন মিরাজ। আর এই জয় দিয়ে আনন্দের আতিশয্যে মাতালেন ১৬ কোটি বাঙালিকে।

আমাদের কাটার মাস্টার বিশ্বজয়ী তরুণ সেনসেশন মোস্তাফিজুর রহমান বিশ্রামে থাকায় তাঁকে যখন আমরা ক্রিকেট অনুরাগীরা খুব মিস করছিলাম, সেসময় তার অভাব ষোলোকলায় পূর্ণ করে দিলেন মেহেদী হাসান মিরাজ। ১৮৮৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার বাঁহাতি পেসার জন জেমস ফেরিস নিজের অভিষেক দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে সর্বোচ্চ ১৮ উইকেট নিয়েছিলেন। সিডনিতে প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৪ উইকেটের পর দ্বিতীয় ইনিংসে নিয়েছিলেন ৫টি উইকেট। এরপর একই মাঠে দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৫টি উইকেট নেওয়ার পর দ্বিতীয় ইনিংসে ৪টি উইকেট নিয়েছিলেন। সব মিলিয়ে তার উইকেট সংখ্যা ছিল ১৮টি। আর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ মিরাজ শেষ করছেন ১৯ উইকেট নিয়ে। কী সহজাত ভাবেই না ভেঙ্গে দিলেন ফেরিসের ১৩০ বছরের বিশ্বরেকর্ড!

চলমান সিরিজের ওয়ানডে ম্যাচ চলাকালে আমাদের খেলোয়াড়দের উদযাপনের ভাষাটা আমাদেরকে ডিমেরিট দিয়েছিল। টাইগার অধিনায়ককে ম্যাচ ফি জরিমানাও করা হয়েছিল। কিন্তু মিরপুরে শেষ টেস্টে এক ওভারে তিন উইকেট নেওয়ার কালে বেন স্টোকসের প্রথম উইকেট নেওয়ার পর বোল্ড আউট হওয়া খেলোয়াড়কে, ঐ মুহুর্তটি উদযাপনকে অথবা ক্রিকেটীয় নান্দনিকতাকে আমাদের সাকিব আল হাসান যেভাবে স্যালুট জানালেন, তা দৃষ্টিনন্দন, পরিশীলিত ও বিনয়ী ক্রিকেটের অবিস্মরণীয় ও নবতর উদাহরণ হয়েই থাকল। ম্যাচ শেষে নিজের টুইট অ্যাকাউন্টে বেন স্টোকস লিখেছেন, 'দারুণ একটা টেস্ট সিরিজ ও ওয়ানডে সিরিজে আমাদের আতিথেয়তা দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ বাংলাদেশকে। নিরাপত্তা দলকে স্যালুট, বাংলাদেশের জনগণকে এবং অবশ্যই সাকিব আল হাসানকে।' সম্মান, ভব্যতা, মর্যাদা, সমীহ ও ভাবাদর্শে ক্রিকেট তো আসলে এতোটাই সুন্দর।

শেষ টেস্ট ম্যাচে জেতার পর আমাদের দলের অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম আইসিসি'র কাছে দাবি জানিয়েছেন, আরো বেশি বেশি ম্যাচ খেলবার সুযোগ দেয়ার জন্য। অন্তত কাগজে কলমে বড় দল যারা তাদের সাথে খেলাটা সচল রাখা আমাদের ভক্তকূলেরও দাবি। ১৫ মাস পরে টেস্ট ম্যাচ খেলতে নেমেও আমরা আমাদের ক্রীড়ানৈপূণ্য দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছি, কেবল তথাকথিত পরাশক্তি নয় উদীয়মান ক্রিকেট দল যারা, তারাও বয়সীদের সমানহারে ম্যাচ খেলবার অধিকার রাখি। চট্টগ্রামের প্রথম টেস্টে ২২ রানে হার। আমাদের টেম্পারামেন্ট খানিকটা এদিক সেদিক হলেই আমরা ম্যাচতা জিততেও পারতাম। আর মিরপুরে তো ইংল্যান্ডের সাথে রীতিমতো প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে যোগ্য ও শ্রেয়তর দল হিসেবেই আমরা ম্যাচ জিতেছি। এখন তবে আইসিসি'র পাদপ্রদীপের আলোয় আসুক না আমাদের ক্রিকেট! আমরা কথা দিতে পারি, মোস্তাফিজ, মিরাজ, সাকিবদের হাত ধরে আরও সুন্দর ক্রিকেট বিশ্বকে উপহার দিতে পারব।

আমাদের ক্রিকেট ধীরে ধীরে উৎকর্ষেও তুঙ্গ স্পর্শ করছে। কিন্তু আমরা দর্শক, ভক্ত বা অনুরাগীরা কি সেই মাপে পূর্ণবিকশিত হতে পারছি? এখনও যারা ক্রিকেট মানেই ইংল্যান্ডের ২০০ বছরে দাসত্বের প্রতিশোধ আর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী অপকর্মের প্রতিশোধ হিসেবে দেখেন, তারা খেলাটা স্রেফ ছেলেখেলার পর্যায়েই নিয়ে যান। কোনো ক্রীড়াকৌশল কি উপনিবেশবাদ কিংবা মহান মুক্তিযুদ্ধের সমীকরণ হতে পারে? পারস্পরিক বোঝাপড়া, সহযোগিতা ও হৃদ্যতার মাধ্যমে যা অর্জন করা যায়, উগ্র জাতীয়তাবাদ কিংবা বাড়াবাড়িপূর্ণ দেশাত্মবোধ দিয়ে তা নাও হতে পারে। মনে রাখাটা দরকার ইংল্যান্ড আমার দেশে এসে আমাদের আন্তরিকতা ও যত্নে প্রীত হয়ে সসম্মানে বলে দিয়েছে, বাংলাদেশ ক্রিকেট খেলুড়েদের জন্য অবশ্যই নিরাপদ। ইংল্যান্ড অধিনায়ক আবার এদেশে ক্রিকেট খেলতে আসতে চান। এখন এই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সুন্দর জয়কে 'বধে'র ভাষায় বিকৃত করবার মানসিকতাই যদি আমরা পোষণ করে যাই তবে নিশ্চিতার্থেই বলা যায়, আমরা ক্রিকেটানুরাগী হিসেবে মোটেও ম্যাচিউরড হয়ে উঠিনি। বিশ্বমানের দর্শক বা সমর্থক হয়ে উঠা ঢের বাকি। আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবেই বলব, সাকিব আল হাসানের স্যালুটটাই হলো ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যপূর্ণ ক্রিকেটীয় ভাষা, যা রপ্ত করবার অভ্যেস এই এখন থেকেই সবার শুরু করা জরুরি।

যেই ইংল্যান্ড আমাদের টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে এসেছে বারবার সেই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৭৮ বছরের মধ্যে এই প্রথম এক সেশনে ইংলিশদের ১০টি উইকেটের পতন এবং তিনদিনেই আমাদের অনন্য টেস্ট জয়, দক্ষিণ এশিয়া তথা সারা বিশ্বে বাংলাদেশী ক্রিকেট আমোদ ছড়িয়ে দেওয়ার পোক্ত পূর্বাভাস। এই জয় আমাদের ক্রিকেট আবেগের জয়। এখন সময় মোস্তাফিজ-তাসকিন-মিরাজদের হাত ধরে ক্রিকেটের সবুজ মাঠে এগিয়ে যাওয়া। বাংলা ক্রিকেটের বিশ্বজয় খুব বেশি দূরে নয়! সকল পঙ্কিলতা ও ক্লীশে জীবনের অমঙ্গল বেদনা ভুলে যে ক্রিকেট আমাদেরকে আমোদিত করবার প্রেরণা দেয় সেই ক্রিকেটের জয়বন্দনা করি। নতুন ইতিহাস রচনাকার বঙ্গ শার্দুলদের প্রাণান্ত অভিবাদন জানাই। আর ইংল্যান্ড টিমের জন্যও আমাদের অশেষ শুভেচ্ছা। এই আনন্দঘন মুহুর্তে বাংলার ক্রিকেট ব্যাঘ্রদের উদ্দেশ্যে একটাই কথা বলবার, ও আলোর পথের যাত্রী! এ যে রাত্রি! এখানে থেমো না!

লেখক: সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
৩০ অক্টোবর ২০১৬
facebook.com/fardeen.ferdous
twitter.com/fardeenferdous