নগরে এ কেমন চাঁদাবাজি!

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 6 Nov 2016, 06:54 PM
Updated : 6 Nov 2016, 06:54 PM


২০০০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে গাজীপুর জেলা একদম নিরক্ষরমুক্ত। কিন্তু এখানকার তথাকথিত অক্ষরজ্ঞানসম্পন্নরা কি করে জীবিকা নির্বাহ করেন, আজ সেই গল্পই করি। গাইবান্ধার শামীম বেশকিছুদিন ধরে গাজীপুর শহরে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালান। তিনি সকালে যখন প্যাসেঞ্জার নিয়ে শহরে ঢোকেন, তাকে দুটো টিকেট কাটতে হয়। প্রথমটি গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নামাঙ্কিত টোকেনে ১০ টাকা, দ্বিতীয়টি গাজীপুর মহানগর অটোরিকশা মালিক সমিতির ১০ টাকার টোকেন। রাজবাড়ি রোডে ঢুকলেই বিভিন্ন বয়স ও বাহারি চেহারার বেশ কয়েকজন যুবককে লাঠি ও চাঁদার রশিদ বই হাতে দেখা যায়। ইতিউতি ঘুরে রিকশাওয়ালার হাতে টোকেন ধরিয়ে দিয়ে দুই টিকেটে ২০ টাকা আদায় করে নেন। সারাদিন রিকশার সামনে ওই তারিখ লেখা টোকেন ঝুলিয়ে রাখা বাধ্যতামূলক। নইলে আবার ২০টাকার ফাঁদে পড়তে হবে রিকশাওয়ালাকে। ভূক্তভোগী গাইবান্ধার এই শামীম শহরে প্রবেশের মূল সড়কে দৈনন্দিন এভাবে প্রকাশ্য চাঁদাবাজির বিষয়টিতে বেশ তিতিবিরক্ত! শামীমের মতো শহরে প্রবেশ করা সব রিকশাওয়ালারই এমন দশা।

হিসেব অনুযায়ী প্রতিদিন অন্তত ১৪ হাজার ব্যাটারিচালিত বা পায়ে চালানো অটোরিকশা গাজীপুর শহরে প্রবেশ করে। এই হিসেবে ২০ টাকা হারে প্রতিদিন চাঁদাবাজরা আয় করেন ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। মাসে মাত্র ৮৪ লাখ টাকা। অথচ ব্যাটারিচালিত রিকশা মহানগরে চলা আইনত নিষিদ্ধ। এই আইন অবশ্য কিতাবে আছে কিন্তু নগরের গোয়ালে নাই। তাই এখানে ওসবতো দেদারছে চলেই; তাদের মালিক সমিতিও বুক ফুলিয়ে চলে।

জানতে চাইলে, সিটি কর্পোরেশনের অধিকর্তারা টোকেনের বিনিময়ে দুনিয়ার কাউকে চাঁদাবাজির অনুমতি দেননি বলে দাবি করেন। তাহলে এই টাকাটা আসলে কার পকেটে যায়? ছাত্রলীগ, যুবলীগতো এমন কাজ জীবনেও করবে না! নানা ধান্ধা-ফিকিরে তাদের অর্থকড়ির খুব একটা অভাব নেই! আর আরক্ষা বাহিনীর উর্দিওয়ালারা নিজেরাই আইন প্রয়োগ করে; তারা আইন ভাঙ্গবে -এমন প্রশ্ন করাটাও অন্যায়! আর নগরের পিতা যিনি, তিনি তো জন্ম থেকে ধনবান; তিনি গরীবের টাকায় বিদেশ ভ্রমণ করতে যাবেন কোন দু:খে? আর জেলার যিনি প্রশাসক তিনি কালো কাঁচওয়ালা গাড়িতে ঘুরেন; তাই হয়ত উনার চোখে এসব পড়ে না।

কিন্তু আমরা যারা সাধারণ মানুষ ওই রোড দিয়ে রোজ চলাফেরা করি তাদের চোখে এখনো লজ্জা বোধটা অবশিষ্ট আছে; তাই বিষয়টা আমাদেরকে মারাত্মকভাবে পীড়া দেয়। পর্দার অন্তরালে নানা কিসিমের অপরাধ ঘটে চলেছে। তা জেনেও আমরা হয়ত না জানার ভান করি। কিন্তু প্রকাশ্য দিবালোকে সিটি করপোরেশনের নাম ভাঙ্গিয়ে চাঁদাবাজির নামে হরিলুট কারোরই কি চোখে পড়ে না?

শুধু শহরের রাস্তায় নয়, নগরের ওপর দিয়ে চলে যাওয়া মহাসড়কগুলোতেও সারা বছর ধরে চলছে চাঁদাবাজি। ঈদ আসলে এই চাঁদাবাজি আরো বেপরোয়া রূপ ধারণ করে। আমরা যারা নগরের জীবনযাত্রা প্রতিনিয়ত অনুসরণ করি –তারা বিবেকের আয়নায় প্রতিবিম্বিতা রূপে সচেতন মানুষদের সেসব দেখাতেও চাই। কিন্তু পরিবর্তন হয় সামান্যই। গেল রমজানের ঈদে গাজীপুরের সড়ক-মহাসড়কে বেপরোয়া চাঁদাবাজির বিষয়টি আমরা টেলিভিশনে সংবাদ আকারেও দেখিয়েছি। সেই সংবাদে আমরা এমনটা দেখিয়েছিলামঃ
ঈদকে সামনে রেখে গাজীপুরের বিভিন্ন মহাসড়কের বেশ কয়েকটি পয়েন্ট এখন চাঁদাবাজদের দখলে। চাঁদাবাজদের দৌরাত্যে একরকম দিশেহারা ক্ষুদ্র যানবাহনের চালকরা। পূবাইল, টঙ্গি ও মীরেরবাজারসহ বিভিন্ন পয়েন্টে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা সিটি করপোরেশনের দোহাই দিয়ে রীতিমতো রশিদ ব্যবহার করেই চালাচ্ছে চাঁদাবাজি। ঈদের আগে সড়ক ব্যবস্থা সচল রেখে মানুষের ঈদযাত্রাকে নির্বিঘ্ন করতে চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধ্বে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে নগর ও পুলিশ প্রশাসন। রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে সড়ক বিশৃঙ্খলার সাথে জড়িত থাকাদের বিরুদ্ধ্বে পুলিশি ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান স্থানীয় জনপ্রতিনিধি।

সড়কের পাশে লাঠি ও চাঁদাবাজির রশিদ বই হাতে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকে কোনো এক চাঁদাবাজ। সুযোগ বুঝে পছন্দমতো গাড়ি নজরে এলেই শিকার ধরবার মতো করে হামলে পড়ে চালকের ওপর। গছিয়ে দেয়া হয় ২০ টাকা বা ৩০ টাকা মূল্যের চাঁদার রশিদ। চালক দিতে রাজী না হলেই, চলে হুমকি-ধামকি। এমনকি গাড়ি ভাঙচুর বা মারধোরের ঘটনাও ঘটে। এভাবে বাকবিতন্ডা চলাকালে মহাসড়কে লেগে যায় দীর্ঘ যানজট। সেদিকে ট্রাফিক পুলিশ বা চাঁদাবাজদের কোনোই ভ্রুক্ষেপ থাকে না।

রমজানের শুরু থেকেই গাজীপুরের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের টঙ্গি স্টেশন রোড, শিলমুন বাজার, মাজুখান, মীরেরবাজার, পূবাইলবাজারসহ অন্তত ১৫টি স্থানে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ইঞ্জিনচালিত যানবাহনের ইজারাদারদের কথা বলে স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগকর্মী জাকারিয়া ও খসরুর নাম খচিত রশিদ বই ব্যবহার করে এই চাঁদাবাজি চালানো হচ্ছে। সিএনজি, লেগুনা, টেম্পু বা দূরপাল্লার মালবাহী ট্রাক চালকরা চাঁদা দিতে অস্বীকার করলেই গাড়ি ভাঙচুর ও মারধোরেরও শিকার হচ্ছেন তারা। বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে অতিষ্ট চালকরা এই অবস্থা থেকে মুক্তি চান।

যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় নগর প্রশাসন থেকে ইজারা এনে পূবাইল ও মীরেরবাজারে সিনএনজি ও লেগুনা স্ট্যান্ড বানিয়ে প্রকাশ্যে করা হচ্ছে চাঁদাবাজি। তবে অবৈধভাবে যানবাহনের চালক বা মালিকের কাছ থেকে টাকা তোলাকে চাঁদাবাজি বলতে নারাজ সেখানকার দায়িত্বপ্রাপ্তরা।
বিষয়টি জেলা পুলিশ প্রশাসন ও নগর কর্তৃপক্ষের নজরে আনলে তারা চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন। আর সিটি কর্তৃপক্ষ জানায় তারা কাউকে চাঁদাবাজির ইজারা দেননি। তবে রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে সড়ক বিশৃঙ্খলার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধ্বে পুলিশি ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান স্থানীয় সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল।

ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ছত্রছায়ায় গড়ে উঠা এসব চাঁদাবাজি সিন্ডিকেটের সাথে পুলিশ ও নগর প্রশাসনের একশ্রেণির কর্মকর্তার যোগাসাজশ রয়েছে বলেও অভিযোগ আছে। মহাসড়কের ভোগান্তি লাঘবে চাঁদাবাজি বন্ধের দাবি সড়ক ব্যবহারকারীদের।

এমন সংবাদ টেলিভিশনে প্রচারের পর কয়েকদিন চাঁদাবাজি বন্ধ থাকায় স্বস্তি ফিরে আসে ক্ষুদ্র যানবাহন চালক ও মালিকদের মধ্যে। তারপর যেখানকার জল আবার সেখানেই ফিরে গেছে। সেই চাঁদাবাজরাও আছে। আর মহাসড়কের ভোগান্তিও চলছে সমান্তরালে পাল্লা দিয়ে। ঢাল তলোয়ার ছাড়া নিধিরাম সর্দার পুলিশি নজরদারিও আছে!

কিন্তু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিচিত্র সমীকরণ মেলানোর পর রাস্তায় এসব চাঁদাবাজি নামের অপকর্ম বন্ধ করতে পারে এমন বুকের পাটা আছে কার? নগরের পিতা, জেলার আধিকারিক, পুলিশ কিংবা রাজনৈতিক নেতা কার না দরকার আছে পারিবারিক স্বাচ্ছন্দ্য? শুধু দরকার একটু চোখ বন্ধ করে রাখা। আর লজ্জার মাথাটা এক ঢোকে খেয়ে ফেললেই কেল্লাফতে! কারো ভাবনায় কিচ্ছুটি আসবে যাবে না। আমরা বলতে বলতে একসময় চুপ মেরে যাব। চোখের সামনে এমন অকর্ম দেখতে দেখতে চোখের রেটিনাও ভোতা হয়ে যাবে। আমরা কোথাও কোনো প্রশ্ন করব না।
আসলে সুশিক্ষিতের এই নগরে কেউ কি আছেন জবাব দেয়ার মতো? হায় জবাবদিহিতা কোথায় তোমার বাড়ি, কোথায় তোমার ঘর?

লেখকঃ সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
০৭ নভেম্বর ২০১৬
facebook.com/fardeen.ferdous
twitter.com/fardeenferdous