ডোনাল্ড ট্রাম্প: যত গর্জেছেন ততটাই কি বর্ষাতে পারবেন?

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 13 Nov 2016, 03:13 AM
Updated : 13 Nov 2016, 03:13 AM

বাংলায় দু'টি প্রবাদ আছে; প্রথমটি আষাঢ়ের তর্জন-গর্জন সার, দ্বিতীয়টি হলো যত গর্জে তত বর্ষে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের ক্ষেত্রে এই কথাগুলো প্রযোজ্য হবে কি হবে না তা সময়ই বলবে। কিন্তু আমরা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা করতে পারি যেকোনো ক্ষেত্রেই চরম স্বার্থপরতা কিংবা একান্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা কেবল ধ্বংসই ডেকে আনে। মানুষের অধিকার রক্ষায় ঔদার্য আর সমঝোতাই আনে প্রকৃত শান্তি।

হুজুগে ভোটারকে কাছে টেনে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে অনেক কথাই বলা যায়। কিন্তু কার্যকরণে তার সবটাই বাস্তবায়ন করা যাবে -এমন নয়। এবং তা যদি হতো বিশ্বজুড়ে হুলস্থূল কান্ড বেঁধে যেত। উদাহরণ হিসেবে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রমোদীর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি নির্বাচনের আগে বলেছিলেন, ভারত হিন্দুর রাষ্ট্র; অভিবাসী মুসলিমদের ঝেটিয়ে বিদায় করা হবে। কিন্তু বছর গড়িয়ে গেলেও তার সেই কথার প্রতিফলন কেউ দেখেনি। নির্বাচনের মাঠে 'স্টান্টবাজি' না থাকলে চলমান শাসকগোষ্ঠীতে অভ্যস্ত হয়ে পড়া ভোটারদের আকৃষ্ট করা যায় না। কথার ফুলঝুরিতে ঝলক দেখাতে পারাটাই নির্বাচনী অগ্নিপরীক্ষা পাশের নিয়ামক হয়ে উঠছে দিন দিন। নরেন্দ্র মোদীর পরেই এর সর্বশেষ উদাহরণ ডোনাল্ড ট্রাম্প। গুজরাট দাঙ্গার নায়ক এবং কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে সময় পার করা ছাড়াই মোদী হয়ে উঠবেন দেশের প্রধানমন্ত্রী কিংবা মাত্র ১৭ মাস আগে রিপাবলিকান দলে নাম লেখানো আপাদমস্তক রাজনীতি বিমুখ ব্যবসায়ী ট্রাম্প হবেন প্রেসিডেন্ট এমনটা কেউ ভাবেননি। আর আপনি যা ভাববেন তাই কেবল ইতিহাস হবে, তা নয়; ভাবনার বাইরে থাকা কিছুই আজকাল ইতিহাসের পাতাকে সোনার অক্ষরে ভরিয়ে তুলছে। ট্রাম্প দেখিয়ে দিয়েছেন, চিন্তাশীলদের ভাবনার জগৎকে নতুনভাবে সাজাতে হবে, যাতে সেই ভাবনার জগতে ধরা পড়ে, কূটকৌশলী ব্যতিক্রমীরাই জয়ী হবে, চোখের দেখা সারল্যদের জিতবার দিন সমাপ্ত।

নির্বাচনী বাকবিতন্ডা আর শাসক হয়ে ওঠার পরের গল্প একরকম নয়। এর প্রমাণ অতি আত্মকেন্দ্রিক ট্রাম্প জয়ী হওয়ার পর প্রথম ভাষণেই ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যের ডাক দিয়ে বলেছেন, প্রত্যেক নাগরিকের কাছে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আমি সব আমেরিকানের প্রেসিডেন্ট হব। নির্বাচনী প্রচারণাকালে বিরূপ মন্তব্যে যে ওবামার চৌদ্দগোষ্ঠী ধুয়ে দিয়েছেন, জয়ের পর ওয়াইট হাউজে প্রথম সাক্ষাতের পর সেই ওবামাকে সম্পর্কে ট্রাম্প বলেছেন, তিনি অত্যন্ত ভালো মানুষ।

যদিও নির্বাচনী প্রচারণাকালে ট্রাম্প বারবার বলেছেন, কৃষ্ণাঙ্গরা কুৎসিত, মুসলিম মানেই সন্ত্রাসী, হিস্পানিকরা সবাই মাদকসেবী, অভিবাসীদের জ্বালায় শেতাঙ্গরা নিজ দেশেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। আসলে যিনি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ শক্তি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের প্রেসিডেন্ট হয়ে উঠবেন, তার ভালোই জানার কথা, 'কালো আর ধলো বাহিরে কেবল, ভিতরে সবারই সমান রাঙা'। আর এই 'ইডিয়মটি' যদি সত্যি না হতো বারাক ওবামার মতো নিখাদ কৃষ্ণাঙ্গ একজন মানুষ দুই দুইবার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন না।

কিন্তু ট্রাম্পের এই অতিকথনই তাঁকে যারপরনাই সাফল্য এনে দিয়েছে। নির্বাচনে জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে শ্বেতাঙ্গদের ৫৮ ভাগ ভোট ট্রাম্প পেয়েছেন; এমনকি হিস্পানিক ও কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটও ২০১২ সালের চেয়ে রিপাবলিকানরা বেশি পেয়েছেন।

ট্রাম্পের অবিশ্বাস্য ও অপ্রত্যাশিত জয়ে বিশ্ব শেয়ার বাজার নিম্নগামী পয়ে পড়ে। এমন অবস্থায় বিশ্ব নেতারা এখন ট্রাম্পের নির্বাচনী ঘোষণা বাস্তবায়ন নিয়ে একধরণের মিশ্র প্রতিক্রিয়ার দেখিয়েছেন। তারা বলছেন, বিশ্বে মুক্ত বাণিজ্য নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে, জলবায়ু পরিবর্তন চুক্তির ওপর হুমকি আসতে পারে, মেক্সিকো বা অন্য কোনো বিবদমান রাষ্ট্রের সাথে সীমান্ত বন্ধ হয়ে যেতে পারে, ন্যাটোর সঙ্গে সম্পর্ক সংকটে পড়তে পারে এবং রুশ মার্কিন সম্পর্কের নতুন মেরুকরণে বদলে যেতে পারে বিশ্ব রাজনীতি। কারণ এসবই ছিল ট্রাম্পের একধরণের অলিখিত নির্বাচনী ইশতেহার।

ট্রাম্পের বিপুল বিজয়ে এখন আর হিলারীর পরিকল্পনা নিয়ে কোথাও কোনো আলোচনা হচ্ছে না। মজার ব্যাপার হলো ওবামা প্রশাসনের বাইরে এসে হিলারী আমেরিকা বা বিশ্বের জন্য নতুন কোনো স্বপ্নের কথা বলেছেন, তেমনটা এখন আর কারো মনে পড়ছে না। এমননি তিনি একজন নারী হয়ে নিজের দেশ বা সারাবিশ্বের বঞ্চিত-অবহেলিত নারীর জন্য কিছু করবেন বলেছিলেন, তাও জানা যাচ্ছে না। অতএব প্রচলিত অর্থে হিলারী ক্লিনটন জিতে গেলে ওবামা প্রশাসনের ছায়া থেকে নিজের আলাদা ব্যক্তিত্ব দিয়ে ভিন্ন কিছু করতেন একথা এখন আর কেউ বিশ্বাস করে না। বিশ্ব শান্তি রক্ষা, আন্ত:রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক উন্নয়ন, সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে কার্যকরী ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে ওবামা প্রশাসনের সাফল্য চোখে পড়ার মতো নয়। এমনকি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালেও বিশ্ব স্থিতিশীলতা রক্ষার ক্ষেত্রে হিলারীর যোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। এসব বিবেচনায় হিলারীর নাম করে আরেকজন ওবামাকে আমেরিকানরা ক্ষমতায় দেখতে চায়নি। অব্যাহতভাবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তার দিক থেকে ডুবতে বসা মার্কিনীরা পরিবর্তন দেখতে চেয়েছিল। যতই অবিশ্বাস্য হোক, কাক্সিক্ষত আবর্তনের সেই ফলটাই ট্রাম্পের ঘরে গেছে।

মার্কিনীরা বিশ্বাস করতে চেয়েছেন, গোপন মিত্রের চেয়ে প্রকাশ্য শত্রুই তাদের জন্য ভালো। অর্থাৎ ধুর্ত ডেভিলের চেয়ে খোলামনা মনস্টারকেই তারা স্বাগত জানিয়েছেন। এখন এই মনস্টার দেশের মানুষকে বিপাকে ফেলে তাঁর পূর্ব প্রতিশ্রুত ভোটের বাহাস বাস্তবায়ন করতে লেগে যাবে -এটা ট্রাম্পের একনিষ্ঠ ভোটাররাও বিশ্বাস করবেন না।

আর যাই হোক, এটা তো 'মান্ধাতার আমল' না। আর আমেরিকান সব লোকই জড়ভরত নয়। কুম্ভকর্ণের নিদ্রাও কেউ যাচ্ছে না। নির্বাচন শেষ হলো আর সবাই অগস্ত্য যাত্রা করে দিয়েছেন -এমনও না। ট্রাম্প জেতার পর তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্টেটে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। এমনকি ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের সাধারণ মানুষ স্বাধীনতার দাবি পর্যন্ত তুলছে। এমন পরিস্থিতিতে হিলারী চেয়ে মাত্র পয়েন্ট ৪ ভাগ ভোট বেশি পাওয়া ট্রাম্প তাঁর প্রতিপক্ষকে চুনোপুঁটি ঠাওরে নিজে রাঘববোয়াল বা মীরজাফর সেজে হুটহাট সিদ্ধান্ত নিয়ে ধুন্ধুমার তুঘলকি কান্ডকারখানা ঘটিয়ে বসবেন বলে যারা বিশ্বাস করেন; আমরা তাদের সাথে দ্বিমতই পোষণ করব।

কিছু খয়ের খাঁ গোষ্ঠী তাঁকে ভুল পরামর্শ দিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা করবেন, মানছি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, নির্বাচনী প্রচারকালে ট্রাম্পের বেফাঁস মন্তব্য আর পূর্বের নৈতিকস্খলনের গোপন ঘটনাগুলো পাদপ্রদীপের আলোয় আসার পর নিজের দলেরই অনেকে ব্যাপক সমালোচনা করেছেন; এমনকি সমর্থনও প্রত্যাহারের কথা জানিয়েছেন। এসব পলিটিশানরা রাজনীতিতেই আছেন এবং থাকবেন। মাত্র ১৭ মাস বয়সী রাজনীতিবিদ ট্রাম্প তাদেরকে এক কথায় উড়িয়ে দিতে পারবেন বলে মনে হয় না। তাছাড়া নিজের নামের আগে সেঁটে যাওয়া বর্ণবাদী, নারীবিদ্বেষী, স্বৈরাচার ও ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার ভূত নামিয়ে না ফেললে ডোনাল্ড ট্রাম্পের চার বছরের হোয়াইট হাউজ জার্নিটা অসম্পন্নও থেকে যেতে পারে!

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এখন এটা প্রমাণ করতে চাইছেন যে, বিশ্ব রাজনীতির জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্প এক ভয়াবহ দুঃসংবাদ এবং ট্রাম্পের হাত ধরে আমেরিকার রাজনীতির অবক্ষয় কাটবে না। কারণ ট্রাম্প আপাদমস্তক একজন উগ্র ডানপন্থী এবং প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের প্রতিভূ। এসব সত্ত্বেও মনে রাখা দরকার, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিশ্ব রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেওয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হলে সবার আস্থা তাঁকে অর্জন করতেই হবে। কথায় এবং আচরণে তাঁকে অবশ্যই সংযত হতে হবে। বৈশ্বিক পরিসরে তাঁর ভূমিকার গ্রহণযোগ্যতা তাঁকেই প্রমাণ করতে হবে। কাজেই হিলারী ক্লিনটন ক্ষমতায় আসলেই পৃথিবীর সব অশান্তি, যুদ্ধ বা সহিংসতা দূর হয়ে যেত; এটা যেমন না, তেমনি ট্রাম্পের ওপর নব্য হিটলার ভর করে রামরাবণের যুদ্ধ লাগিয়ে দিতে পারবেন, এমনও না।

সব বিবেচনায় এটা বলা যায় যে, যদিও ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাতে একটা আলাদীনের চেরাগ থাকবে না, তবু আমেরিকা তথা বিশ্বকে এগিয়ে নিতে নিজের পূর্বের কালো অধ্যায় ঝেড়ে ফেলে একান্ত সদিচ্ছাকে জাগরুক রেখে গঠনমূলক ও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবেন এমনটাই প্রত্যাশিত। কে অভিবাসী, কে সংখ্যালঘু, কে মুসলিম, কে কৃষ্ণাঙ্গ আর কে হিস্পানিক এভাবে নয়, বরং সকল মানুষের সমান শক্তির ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে মধ্যযুগের বাঙালি শ্রেষ্ঠ কবি বড়– চন্ডীদাসকেই আত্মস্থ করতে হবে, 'সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই'!

লেখক: সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
১১ নভেম্বর ২০১৬
twitter.com/fardeenferdous
facebook.com/fardeen.ferdous
blog.bdnews24.com/fardeenferdous