ফিদেল কাস্ত্রো: অবিসংবাদিত সমতা বিপ্লবী

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 29 Nov 2016, 03:52 AM
Updated : 29 Nov 2016, 03:52 AM

সাম্যবাদের নিপূণ কারিগর জার্মান সমাজবিজ্ঞানী কার্ল মার্কসকে পুঁজিবাদি ও সাম্রাজ্যবাদিদের আজন্মের ভয়। মার্কসীয় সাম্যবাদ মানলে আমেরিকার প্রেসিডেন্টদের হোয়াইট হাউজে ভোগবিলাসে বাস করা হবে না। আপামর জনতাকে নিজের সমান মর্যাদা দিতে গিয়ে কস্মিনকালেও প্রেসিডেন্ট পত্নীরা ফার্স্টলেডি বনতে পারবে না। আর ফিদেল কাস্ত্রো নামের এক মহান বিপ্লবী নাক উঁচু সাম্রাজ্যবাদি আমেরিকার দোরগোড়ায় বাস করে অর্ধশত বছর ধরে পুঁজিবাদিদের সেই ভয়টাকে এক নিখাদ, নিরেট ও অক্ষয় শিল্পরূপে প্রতিষ্ঠিত করে গেলেন।

সারা পৃথিবী না পারুক নিজের দেশ কিউবাকে মার্কসীয় সমতার স্বর্গ হিসেবে গড়ে দিয়ে গেলেন কাস্ত্রো। কিউবার একজন সাধারণ শ্রমিক আর কিউবার অবিসংবাদিত নেতার শ্রমের মূল্যমানে কোনো হেরফের হবে না। কে মহাতারকা আর কে চাষাভূষা ভূমিপুত্র -মানবীয় পরিচয়ের এমন দৈন্যতা ও বৈষম্যের কবর রচনা করে দিলেন কাস্ত্রো। সমতা ও অধিকারে শ্রেণিহীন, শোষণহীন এবং ব্যক্তিমালিকানাহীন সাম্যবাদী মানুষের আদর্শ ভূমিরূপ আজ তাই বিপ্লবী কাস্ত্রোর দেশ। কিউবা স্বাধীন, সামাজিকভাবে সচেতন শ্রমজীবী মানুষের উৎকর্ষিক সুসংগঠিত সমাজ। যেখানে মানুষের স্বশাসনে সকলের সামর্থ নিয়োজিত সর্বসাধারণের সমান কল্যাণে। অদ্বিতীয় ও অতুল্য ফিদেলীয় 'বিপ্লব'টাই কিউবাকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাম্যের চুড়ান্ত শিখর স্পর্শ করে দিয়ে গেল। হিতবাদি মানুষের কাছে যা সত্যিকারের ভাবাদর্শ আর সাম্রাজ্যবাদী ধনতান্ত্রিকদের কাছে নিজেদের অবস্থান টলানো ভয়ঙ্কর জুজু।

কাজেই খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের বন্ধু ও স্বজন এবং বিপরীতে কর্তৃত্ববাদীদের জন্মশত্রু মহান বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রোর মৃত্যু নেই। বিপ্লব বেঁচে থাকবে। বেঁচে থাকবেন মহান বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রো। প্রাণান্ত অভিবাদন হে কমরেড!

যেই মানুষটি কিউবান জাতীয়তাবোধ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতাকে আশ্রয় করে সমাজতন্ত্র তথা সাম্যবাদে ঝুঁকে পড়েন; তার দিনকাল খুব সহজ ছিল না। বিশ্বের ক্ষমতাধরেরা যেখানে আমেরিকার পদস্পর্শ করে নিজেদের ধন্য মনে করে, সেখানে আমেরিকার নাকের ডগায় বসে প্রচলিত ধনতন্ত্রকে অবজ্ঞাভরে ছুড়ে ফেলে মার্কিনীদের বিরুদ্ধে গিয়ে সুষম সমতায় মানুষের দু:খ ঘোচানোর যুদ্ধটাকে জীবনের ব্রত করেন কাস্ত্রো। তাঁর এই সংগ্রামে পাশে পান আর্জেন্টাইন কিংবদন্তী বিপ্লবী চে গুয়েভারা এবং নিজের ভাই কিউবার বর্তমান প্রেসিডেন্ট রাউলকে।

নিজের দেশেই ঘাপটি মেরে থাকা আমেরিকান চর বা নিজের দেশের মার্কিন পুতুল সরকারের সাথে এক অসম যুদ্ধ জিতে দেশনায়কের দায়িত্ব নিতে হয় কাস্ত্রোকে। আর এই বিপ্লবের ভয়াল পরিণতি হিসেবে ৯০ বছরের জীবনে ফিদেল কাস্ত্রোকে ৬৩৮ বার মৃত্যুফাঁদ পার হতে হয়। কিন্তু জীবন বড় ভালোবেসেছিল তাঁকে। নিজের দেশের গোয়েন্দা সংস্থা আর যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ'র চরদের বিচিত্র ষড়যন্ত্র; চুরুটে বা ভাষণ ডেস্কের মধ্যে বিস্ফোরক রাখা, খাবারে বিষ দেয়া, ব্যবহৃত কলমে বিষযুক্ত সুচ রাখা কিংবা পোশাকে জীবাণু ছড়িয়ে দেয়া; কোনোটাই কাস্ত্রোর জীবনকে পরাভূত করতে পারেনি। যে জীবন মানুষের জন্য উৎসর্গিত; বিপথে সেই জীবনের বিনাশ থাকতে নেই। বরং এক অনুপম বিপ্লব সাধনায় বিশ্ব রাজনীতিতে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখে ইতিহাস হয়ে থাকলেন কাস্ত্রো। হয়ে রইলেন নির্যাতিত, নিপীড়িত আর উৎপীড়িতের অনন্য অনুপ্রেরণা।

সমাজতন্ত্র বিরোধীরা বরাবর তাঁকে বলে এসেছেন একনায়ক। কিন্তু এই বিপ্লবী নেতা একালের 'কিউবা' নামের এমন একটি দেশ ও শির উঁচু জাতি রেখে গেলেন; কারো কাছে মাথা নত করবার নজির তাদের নেই। কাস্ত্রো দুর্গম গ্রাম বা প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চলে শিক্ষার আলো পৌছে দিতে হাজার হাজার বিদ্যালয় খুলেছিলেন, সবার জন্য অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেছিলেন; যার ফলে দেশের শিক্ষিত মানুষের হার এখন ৯৯.৮%। মানুষকে দিয়েছেন বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা; সেখানকার মানুষের গড় আয়ু এখন প্রায় ৮০ বছর।

সর্বোপরি কাস্ত্রো কিউবাকে এমন একটি জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেছেন যে, যেখান থেকে ছোট্ট একটি দ্বীপ রাষ্ট্র হয়েও পরাক্রমশালী আমেরিকাকে বা তাদের মতাদর্শী ধনতান্ত্রিকদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া যায়। কিউবায় এই বিপ্লবীর নামে রাস্তাঘাট, এয়ারপোর্ট, স্টেডিয়ামজাতীয় তেমন কিছু গড়ে ওঠেনি। 'কাস্ত্রো' চেতনা নিয়েও আমজনতার মাঝে মাথা ঘামানোর সময় নেই। কিন্তু একটা জাতিরাষ্ট্র কিউবা আর ব্যক্তি ফিদেল কাস্ত্রো আজ একে অপরের পরিপূরক। জীবনে বহু সংকট পাড়ি দেয়া সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রতিভূ কাস্ত্রো'র এটাইতো প্রাপ্য।

সারাবিশ্বেই জনতার বিপ্লব নিয়ে যারা চিন্তা করেছেন, কাজ করেছেন এমন মানুষের সাথে ফিদেল কাস্ত্রোর বন্ধুত্ব ছিল কালের কষ্ঠিপাথরে উত্তীর্ণ। নোবেলজয়ী সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ছিলেন তাঁর খুব প্রিয়। এমনকি বাঙালি রবীন্দ্রনাথকেও তিনি ভালো অনুধাবন করতেন। কাস্ত্রো'র সাথে গভীর সখ্যতা ছিল আফ্রিকান অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। মানুষের স্বাধিকার রক্ষায় এই নেতাদের জীবনদর্শন এক ও অভিন্ন সুতোয় গাঁথা। যদিও আমাদের সংবিধানের মূলনীতিতে সমাজতন্ত্র বলে একটি শব্দ আছে, কিন্তু চর্চিত সমাজতন্ত্র বলে অবশ্য এখানে কিছুই নেই। তবে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু কাস্ত্রোর সমাজতন্ত্রে আস্থাবান ছিলেন।

১৯৭৩ সালে আলজেরিয়া জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন (ন্যাম)'র সম্মেলনে অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গন করে সোৎসাহে বলেছিলেন, 'আমি হিমালয় দেখিনি। তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়ের সমান। এভাবে আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতাই লাভ করলাম।'

বিপ্লবী কাস্ত্রো একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন। হয়েছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। আমরা তাঁর সেই অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিন বছর আগে কাস্ত্রোকে 'মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মানননায়' ভূষিত করে নিজেদেরকেই গৌরাবান্বিত করেছি।

আমেরিকার দাম্ভিকতা, অহমিকা ও আত্মগৌরবকে আজন্ম মাটিতে নামিয়ে রাখা একজন ফিদেল কাস্ত্রো'র 'সমাজ বিপ্লব' অবিনশ্বর। তিনি আপামর মানুষের হৃদয়ে চিরকাল থাকবেন। হার না মানা লড়াকু ফিদেল কাস্ত্রো গেল এপ্রিলে সর্বশেষ জনসম্মুখে তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, কিউবার সাম্যবাদী ধারণা এখনো কার্যকরী এবং কিউবার জনগণ বিজয়ী হবে।

আজন্মই পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, আধিপত্য, দখলদারিত্ব আর কর্তৃত্ববাদবিরোধী নিখাদ জাতীয়তাবাদী এই মানুষটির মুখেই একথা মানায় যে, বিপ্লব হলো আমৃত্যু সংগ্রাম; অতীত থেকে ভবিষ্যতের পথে যার নিরন্তর যাত্রাপথ।

এবার আমরাও বলি, আবার কোনো একদিন তরুণ এক কাস্ত্রো এসে পৃথিবীকে নতুন করে মার্কসীয় সাম্যবাদে সাজিয়ে দিয়ে সকল মানুষের সমতা ও অধিকার বোধের কথা জানান দেবে আর বিপ্লবের স্বপ্নটা চির জাগরুক রাখবে; মহান বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রো'র (অগাস্ট ১৩, ১৯২৬ – নভেম্বর ২৫, ২০১৬) মহাপ্রয়াণের পর এটাই আমাদের প্রতীতি। বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক।

লেখক: সাংবাদিক, মাছরাঙা টেলিভিশন
২৭ নভেম্বর ২০১৬
twitter.com/fardeenferdous
facebook.com/fardeen.ferdous
bdnews24.com/author/fardeenferdous