প্রতিবাদীর প্রতিপক্ষ কেন পুলিশ?

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 31 Jan 2017, 06:26 PM
Updated : 31 Jan 2017, 06:26 PM

মশা মারতে কামান দাগা বা সামান্য ব্যাপারে বৃহৎ আয়োজনের এই কথাটি যে কথকের মাথায় প্রথম এসেছিল তিনি একালে বেঁচে থাকলে দারুণ একটা উদাহরণ চোখের সামনেই দেখতে পেতেন। সীমিত আকার ও স্বল্প জনসম্পৃক্ততার হরতাল থেকে প্রতিবাদকারীদের নিবৃত করতে জলকামান, টিয়ারশেল, রাবার বুলেট ও পুলিশি বুটের যথেচ্ছাচার ব্যবহারকে কামান দাগার অত্যাধুনিক সংস্কার হিসেবেই ধার্য করতে পারতেন। সুন্দরবন থেকে মাত্র চৌদ্দ কিলোমিটার দূরের রামপালে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সাধারণ মানুষের বিরোধিতা চলছে। পাল্লা দিয়ে সরকারও পণ করেছে, অক্সিজেন, বাঘ বা বৃক্ষের চিন্তার চেয়ে বিদ্যুৎ সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষের আপাত সুখের চিন্তাটাই তাদের কাছে অগ্রাধিকার। ভবিষ্যতে যা হয় হোকগে!

তবু কিছু ভবিষ্যতদ্রষ্টা মানুষ শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দ্রোহ বা প্রতিবাদকে লালন করেন এবং খানিকটা প্রকাশও করেন। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্যি যে, সেইটুকু প্রতিবাদও আজকের রাষ্ট্র সহ্যসীমার বাইরে রাখে।

তেমনি এক পূর্বঘোষিত প্রতিবাদে লঙ্কাকান্ড ঘটে গেল বৃহস্পতিবার। ২৬ জানুয়ারি তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ডাকা অর্ধদিবস হরতাল পালনের সময় পুলিশ শাহবাগে এটিএন নিউজের প্রতিবেদক এহসান বিন দিদার, ক্যামেরা পারসন আব্দুল আলীম ও এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মিজানুর রহমানকে রীতিমতো পিটিয়ে আহত করেন। সাংবাদিকের দোষ ছিল খবর সংগ্রহ আর মিজানুর রহমান পুলিশি অ্যাকশনের বিরুদ্ধে খানিকটা বিদ্রোহ দেখিয়েছিলেন; এই যা।

এ খবরগুলো ব্রডকাস্ট, প্রিন্ট ও সোশ্যাল মিডিয়ায় বহুল প্রচারিত হলেও দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই ঘটনাকে ধাক্কাধাক্কি বলে একরকম উড়িয়ে দেন; যদিও পরে তিনি তার মত পালটে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন। ঐ পদের আধিকারিকরা বরাবর যেমনটা করে থাকেন আর কি! বিএনপি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মতিন চৌধুরীর প্রেসক্লাব হামলায় সাংবাদিক না দেখা, আলতাফ হোসেন চৌধুরীর 'আল্লাহর মাল আল্লায় নিয়া গেছে', বর্তমান সরকারের আমলে সাহারা খাতুনের '৪৮ ঘন্টায় সাগর-রুনির খুনিদের গ্রেপ্তার করা' কিংবা মহিউদ্দিন খান আলমগীরের 'পিলার ঝাঁকুনি'র মতো বেহুদা বাতচিতজাতীয় কান্ডকারখানা বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককে রীতিমতো 'রিডিকুলাস মিথে' পরিণত করেছে। কাজেই আমরা ধরেই নিচ্ছি, বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল যখন চোখ বন্ধ করে ছিলেন, তখনই আসলে শাহবাগে এবারের প্রলয় ঘটেছিল।


গুটিকয়েক প্রতিবাদকারীকে সামলাতে শত শত রাউন্ডের টিয়ার শেল, রাবার বুলেট এবং জলকামান চলে এল। তাতেও হয়ত শক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পুলিশম্যানরা পেরে ওঠছিল না। শেষাবধি নিজেদের পায়ের বুটেরই সদব্যবহার করতে হলো তাদের।

আচ্ছা কি হতো, যদি ভালোয় ভালোয় আধাবেলা হরতালের প্রহরটা কেটে যেত? মিডিয়াওলারা যে এই হরতালকে খুব বেশি পাত্তা দিচ্ছিল এমন তো নয়। কিন্তু পুলিশের বাড়াবাড়িতে এই ক্ষুদে হরতালটিই হয়ে গেল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর। বিশ্ববাসী জানল, দমন-পীড়ন করে হলেও ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন ধ্বংস করে কয়লাভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বদ্ধ পরিকর সরকার।

রাষ্ট্র কাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তাক করল? যাঁরা ছিলেন পুরোদস্তুর নিরস্ত্র ও শান্তিপ্রিয়। সাংবাদিক পিটিয়েও হিংসা মিটল না রাষ্ট্রীয়বাহিনীর। ক্ষুদে ব্যবসায়ী বয়সী মিজানুর রহমানকে তারা টেনেহিঁচড়ে নিজেদের আস্তানায় গিয়ে মনের ঝাল মেটাল। মিজানুরের ভাগ্য ভালো যে, নিতান্ত দয়াপরবশ হয়ে হাসপাতালে ভর্তির দায়িত্বটা পালন করেছিল পুলিশ।

সেদিন সকাল সকাল জুরাইন থেকে সতীর্থদের সাথে শাহবাগে পৌছান মিজানুর। একসময় পুলিশের টিয়ার শেল ও জলকামানের মুখে পড়েন। কিছুদিন আগে দুর্ঘটনায় হাত ভেঙ্গে যাওয়া এক আন্দোলনকারীকে পুলিশের মারপিট করতে দেখে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েন তিনি। জলকামানের ওপর ওঠে সামনে থাকা লোহার খাঁচাটি ঝাঁকাতে থাকেন। আর কী চাই। পুলিশের লাথি গোতা; শেষ পর্যন্ত থানার ভিতরে নিয়ে গিয়ে পুলিশিধোলাই। হয়রানিটাকে যাতে ধারাবাহিকতা দেয়া যায়, সেজন্য সাদা কাগজে স্বাক্ষর রাখার পর্বটিও বাদ রাখল না পুলিশ।

পুলিশের কাজে বাঁধা দিয়েছেন; নিশ্চিতার্থেই আইনের চোখে অপরাধ করেছেন মিজানুর। কিন্তু বয়সী মিজানুরের সাথে পুলিশরা যে চরম অবমাননাকর আচরণটি করলেন; তার আইনী ভিত্তি কি? পুলিশের ঘরে ঘরেও নিশ্চয় মিজানুর রহমানের বয়সী পিতারা রয়েছেন। অন্যায্যতার বিরুদ্ধে পিতার দ্রোহ কিভাবে সামলাতে হয় সেই শিক্ষা কি তারা গ্রহণ করেননি?

মিজানুর গণমাধ্যমকে স্পষ্ট করেই বলেছেন, ব্যক্তি পুলিশের ওপর আমার ক্ষোভ ছিল না। আমি রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে শুধু স্যান্ডেল প্রদর্শন করেছি। আমার কথা হলো পুলিশ আমাদের মতো নিরস্ত্র, সাধারণ মানুষকে ঠেকাতে বর্ম, হেলমেট সব পরে এসেছে। জলকামানও এনেছে। আমি বিভিন্ন আন্দোলনে আগেও অংশ নিয়েছি। কিন্তু এমন একটা আন্দোলনে এই মাত্রায় টিয়ার শেল ছুড়তে কখনো দেখিনি। কিন্তু কেন?
খুব স্বাভাবিকভাবেই সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশ্ন ওঠছে, বয়োজ্যেষ্ঠ এই বাবাজি'র নাম অবশ্যই অভাগা 'বাংলাদেশ'! তবে সেই পিতাকে চরম অবমাননায় টেনেহিঁচড়ে কারা অন্ধকারে নিয়ে যাচ্ছে? কি তাদের জন্ম পরিচয়? এর জবাব কি পুলিশ প্রধান বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের কাছে আছে?

আমরা সংবাদমাধ্যম থেকেই জেনেছি, পুলিশ উইকের শুরুতে আনুষ্ঠানিক দরবারে 'নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন-২০১৩' বাতিল চেয়েছেন পুলিশ সদস্যরা। যদিও এর সাথে তাৎক্ষণিকভাবে একমত পোষণ করেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আইনটি বলবৎ আছে, তারপরও ঠুনকো ঘটনাতেও বেসামাল হয়ে পড়ে পুলিশ। মন চাইলেই সাংবাদিক বা প্রতিবাদকারীদের নিজের ডেরায় নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে জখম করা হয়। আর এই আইন বহাল না থাকলেতো তা হবে একদম ডালভাত।

ওই পুলিশ উইকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেই প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, পুলিশকে হতে হবে জনবান্ধব। আমরাও তাই মনে করি। জনশৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তা দেখভাল করবার বড় দায়িত্ব পুলিশের ওপর। পুলিশ ২৪ ঘন্টা সজাগ থাকে বলেই মানুষের রাতের ঘুমটা আরামপ্রদ হয়; পরদিন নতুন উদ্যমে কাজে ঝাপিয়ে পড়তে পারে সবাই। পুলিশ কাজ করে বলেই জঙ্গিরা তাদের অভিলাষ পূর্ণ করতে পারে না।

কিন্তু মুষ্টিমেয় পুলিশ যারা দেশের নাগরিকদের চরম অসম্মান করে; ভুলুন্ঠিত করে মানবতা; তাদেরকে কেন থামানো যায় না? এই দুর্বীনিত পুলিশের ওপর ভর করে দেশটাকে আমরা কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবো? সাংবিধানিক আইন কি তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়? কল্যানমূলক বা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য আইনি সমতা বিধান করাটা অতীব জরুরি। প্রতিবাদকারীর টুটি চেপে ধরবার পুলিশি মনোভাবটা তবে কোন গণতন্ত্র?

লেখক: সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
২৮ জানুয়ারি ২০১৭
twitter.com/fardeenferdous
facebook.com/fardeen.ferdous
youtube.com/fardeenferdous