এত সস্তা তবে সাংবাদিকের প্রাণ!

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 12 Feb 2017, 11:13 AM
Updated : 12 Feb 2017, 11:13 AM

এখানে প্রতিনিয়ত জীবনকে মহাঝুঁকির মধ্য দিয়ে বয়ে নিয়ে যেতে হতে হয় এক নিদারুণ দুর্মর গন্তব্যে। সাংবাদিকের জন্য সেই ভয়াল গন্তব্যটা আরো বেশি ক্লিষ্টকর। অমানুষ কর্তৃক প্রকৃতির বিরুদ্ধচারণের কুফলকে প্রতিবিম্বিত করে সবাইকে দেখিয়ে দেয় সাংবদিকের আয়না। দেশ বা মানুষের সেইসব শত্রুর মহাশত্রু তাই সাংবাদিকেরা। তার ওপর কানুনের শৈথিল্যতা সেই শত্রুতার বারুদে আগুন ঢেলে দিয়ে যায় হরহামেশা। কাজেই এখানে এই জনপদে কথায় কথায় সাংবাদিককে লাথিগোতা দেয়া যায়; লাল দালানের চৌদ্দশিকে নিক্ষেপ করা যায়; প্রাণ কাড়া যায় নিরাপদ সুরক্ষিত আপন নিবাসে গিয়েও।

গেল জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে সুন্দরবন বিধ্বংসী রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিলের দাবিতে হরতাল চলাকালে রাজধানীর শাহবাগে দায়িত্বপালনকালে দুই টেলিভিশন সাংবাদিককে বেদম পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠাল পুলিশ। এর রেশ না কাটতেই এবার সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে আওয়ামীলীগের হানাহানি'র শিকার হলেন সমকাল পত্রিকার স্থানীয় সাংবাদিক আব্দুল হাকিম শিমুল। ০২ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার পৌর মেয়র হালিমুল হক মিরু ও নির্বাচনকালীন তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ভিপি আবদুর রহিম গ্রুপের সাথে সংঘর্ষ চলাকালে একটি গুলি শিমুলের চোখের পাশ দিয়ে মাথা ভেদ করে। ঘটনার পরদিন উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা আনার সময় পথিমধ্যেই প্রাণ হারান তিনি। ঘটনার পরপরই শাহজাদপুর পৌর মেয়রের লাইসেন্সকৃত শটগান ও গুলির খোসা জব্দ করে পুলিশ। শুক্রবার দুপুরে সাংবাদিক শিমুল মারা যাওয়ার পর বিকেলেই শাহজাদপুর থেকে মেয়রের ছোট ভাই ছাত্রলীগ নেতা হাসিবুল হক পিন্টু এবং পাবনা জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুল হক মিন্টুকে গ্রেপ্তার করা হয়। খুব সাদামাটা ভাবনা থেকেই অনুধাবন করা যায়, ক্ষমতাসীন সরকারদলীয় মেয়র নিজের বন্দুক দিয়ে একজন নির্বিরোধ সাংবাদিকের প্রাণ কেড়ে নিলেন। আর এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনায় রসদ জুগিয়েছেন মেয়রেরই আপন দুই ভাই।

এই ঘটনা নিয়ে এলাকায় হরতাল, প্রতিবাদ, সড়ক অবরোধ, বাদানুবাদ সবই হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় যথারীতি ঝড়ও বইছে। কিন্তু তাতে শিমুলের ১২ বছর বয়সী ছেলে সাদি মোহাম্মদ, ৩ বছরের কন্যা তামান্না খাতুন, স্ত্রী কামরুন নাহার বা স্বজনদের কোনোই সান্তনা জুটবে না, শোকেরও নিদান হবে না। স্বামীর দায়িত্বশীলতা আর পিতার মমতার বঞ্চনা আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে পরিবারটিকে। ইতোমধ্যে নাতি শিমুলের শোক সইতে না পেরে ৯০ বছর বয়সী নানি রোকেয়া বেগমও তাঁর শেষ ঠিকানায় পৌঁছে গেছেন। কী দোষ ছিল এই সাংবাদিক পরিবারটির যে, অকালেই এমন মহাট্রাজেডিকে বরণ করতে হলো?

আওয়ামীলীগ সমর্থিত মেয়রের গুলিতে সাংবাদিক মারা যাওয়ার পর ওই দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, 'সাংবাদিক নিহত হওয়ার ঘটনায় যে-ই জড়িত থাক না কেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিষয়টি আমরা সিরিয়াসলি দেখছি। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করতে আওয়ামীলীগের একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

মিস্টার সম্পাদক এটা প্রমাণিত যে, লাভালাভের চোরাবালিতে ডুবে যাওয়া আওয়ামীলীগের লোভীরাই হন্তারক। তাহলে আর কতকাল 'যেই জড়িত থাক'র মতো বালখিল্যপূর্ণ কথার চিড়ে ভিজতে থাকবে? এইসব হন্তারকেরা দলের মধ্যে ঘাপটি মেরে থেকে প্রকাশ্যে মানুষের প্রাণসহ অর্থকড়ি, মানসম্মান লুটেপুটে খাচ্ছে; তার দায়টা কার? উদ্ভট হানাহানি, অস্ত্র ছোড়াছুড়ি দেশের কোথায় না হচ্ছে? আপনাদের সংগঠনের লোকেরা এতকাল ধরে সমাজে যে অন্যায্যতার আরাধনা করছে, কয়টার বিরুদ্ধে প্রকৃত অর্থে ব্যবস্থা নিতে পেরেছেন? আপনারা বলবেন, এতো বড় দল, সবদিকে নজর দেয়া যায় নাকি? আমরা এবার বলব, পার্টিই যদি করবেন, দয়া করে নজরটা এবার প্রস্ফুটিত করুন, যাতে দেশদ্রোহী কুলাঙ্গারদের ওপর নজরদারিটা ঠিকঠাক করতে পারেন। তবুও ভালো নতুন সম্পাদক ৪৮ ঘন্টা বা ৪৮ বছরের মধ্যে যাননি। অনন্তকাল পরেও হলেও হয়ত আমরা বিচারিক সুরাহা পাবো!

নেতা বা ক্ষমতাসীনরা তাদের বিরুদ্ধ মতকে দমন করতে সাংবাদিকদের নিশ্চিহ্ন করবার প্রয়াস চালান। কিন্তু সবচে' উদ্বেগের বিষয় হলো রাষ্ট্রযন্ত্র নিজেও সাংবাদিক নির্যাতনের ভূমিকায় নামে। বিভিন্ন সমীক্ষা মতে, বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর অযাচিত আক্রমণ, সহিংস ঘটনার বিচারিক তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি গণমাধ্যমের কর্মীদের জন্য চরম বাস্তবতা হিসেবে দেখা দিয়েছে।

ঝুঁকিতে সাংবাদিকদের কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে। নিউইয়র্কভিত্তিক সংস্থা কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)'র তথ্যমতে বাংলাদেশে ১৯৯২ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৩ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। যদিও প্রকৃত হিসাব এর আড়াইগুণ বেশি। ১৯৯৮ সালে যশোরে রানার সম্পাদক সাইফুল আলম মুকুল, ২০০০ সালে একই এলাকার জনকণ্ঠের সাংবাদিক শামছুর রহমান, ২০০৪ সালে খুলনার নিউএজ পত্রিকার সাংবাদিক মানিক সাহা, ২০০৫ সালে ফরিদপুরে সমকালের সাংবাদিক গৌতম দাস এবং হালের ২০১২ সালের মাছরাঙা টেলিভিশনের সাগর সরোয়ার ও এটিএন বাংলার মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের নিরঙ্কুশ সুরাহা এখনো করতে পারেনি রাষ্ট্র।

সিপিজে তাদের গবেষণা থেকে দেখেছে, সারাবিশ্বেই মুক্ত সাংবাদিকতার ঝুঁকি বাড়ছে। আর ঝুঁকিটা বাড়িয়ে দিচ্ছে রাষ্ট্রীয় দায়মুক্তি। সাংবাদিক হত্যার দায়মুক্তিতে বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ১১ তম। গত এক দশকে বাংলাদেশের অন্তত ৭ সাংবাদিক হত্যার মামলাতেই অভিযুক্তরা দায়মুক্তি পেয়েছেন।

অন্যদিকে বাক স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংগঠন আর্টিকেল-১৯ এর ২০১৪ সালের গবেষণা প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশে রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন, হয়রানি ও আক্রমণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশে রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে সাংবাদিক নির্যাতনের হার ছিল ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে ২০১৪ সালে এই হার হয়েছিল ৩৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এর প্রায় ২৩ শতাংশ নির্যাতনই হয়েছে পুলিশ, র‍্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশের হাতে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাইরে সরকারি কর্মকর্তাদের হাতে ১১ শতাংশ আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের হাতে সাংবাদিক হত্যা, নির্যাতন, হয়রানি বা মামলার ঘটনা অহরহই ঘটছে।

এমন একটা পরিস্থিতির সর্বশেষ বলি হলেন শাহজাদপুরের স্থানীয় সাংবাদিক আব্দুল হাকিম শিমুল। এরই মধ্যে শিমুল হত্যায় অভিযুক্ত প্রধান আসামী মীরুসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। দায়মুক্তি না দিয়ে শিমুলের হত্যাকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা গেলেই কেবল বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বের হতে পারবো আমরা। মেঘ তার মা-বাবাকে দেখবে না কোনোদিন। তেমনি সাদি বা তামান্নাও পিতৃস্নেহ বঞ্চিত হলো চিরকালের মতো। আর কোনো মেঘের কান্নায় যেন এই বাংলাভূমির বাতাস ভারি না হয়। যে স্বার্থে রাজনীতিকরা হানাহানিতে লিপ্ত হয়ে সকল শুভবোধ নিশ্চিহ্ন করবার প্রয়াস পান, সেই নীতি বিবর্জিত স্বার্থপরতাকে জলাঞ্জলি দেয়া হোক সবার আগে। সমাজের দর্পণ সাংবাদিকরা বাঁচুক, বাঁচুক মানুষ। আর সকল সাংবাদিকের ঐক্যবদ্ধ দ্রোহে রাষ্ট্র ফিরুক আমাদের আরাধ্য সুশাসনের পথে।

লেখক: সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭
twitter.com/fardeenferdous
facebook.com/fardeen.ferdous