তাপদাহঃ এবার থেকে এসিই খাব!

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 25 May 2017, 07:53 PM
Updated : 25 May 2017, 07:53 PM

দাঁড়িয়েছিলাম গ্রামের মোড়ের বটবৃক্ষের ছায়ায়। এই তপ্ত দুপুরেও বৃক্ষের সবুজ পত্র আমাকে শীতল বাতাস করতে ভুলল না। পৃথিবীর কোনো কৃত্রিম এসিরই এমন হাওয়া দেয়ার মুরোদ থাকে না, থাকবেও না।

হঠাৎ একটি পিকআপ ভ্যানে নতুন এসি নিয়ে গ্রামে প্রবেশ করতে দেখলাম গ্রামেরই উঠতি সোনা ব্যবসায়ী দিলদার মিয়ার কলেজ পড়ুয়া পোলাকে।
-কিরে গ্রামের সবুজ কুটিরেও শহুরে এসি ঢুকাইলি?
-হ, ঢুকাইলাম, আমার বাপের ট্যাকা আছে ঘরে ঊনপঞ্চাশটা এসি লাগামু, আপনার কোনো সমিস্যা?
-নারে বাপধন, আমার সমস্যা না। ঢাকার গরমে টিকতে না পাইরা গ্রামে এসেছিলাম হাওয়া বদল করতে…
-তো, আপনার হাওয়ায় তো আমরা ডিস্টার্ব দেই নাই। খান না হাওয়া।
-একদিন বুঝবিরে পোলা ঘরে ঘরে এসি লাগাইয়া গ্রিনহাউজ গ্যাস নি:সরণ করতে করতে ওজন স্তর ফুটো করে দিবি। আর সেদিন ঘরে বসে এসি খাবি। কিন্তু খাবারের সন্ধানে বাইরে যেতে পারবি না।
-মানে?
-মানেটা খুব সোজারে…এবার গ্রীষ্মের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর ক'দিন, ৫০ ডিগ্রি দেখেই মরতে পারব। যেদিন ৫০ ছুবে। সেদিন আর খাবার উৎপাদনের জন্য ক্ষেতখামারে যেতে পারবি না। ঘরের ভিতর বইসা এসির শীতল হাওয়া খাইতে খাইতে মরণরে স্বাগত জানাবি। ভাত, ডাল, সবজি কোথায় পাবি? যাহ, বাড়িত গিয়া এসি খা গা। এসি খাইয়া বাঁচনের প্র্যাপকটিস কর গে!
-কইছে তোমারে, যার যেমন বুদ্ধি। ট্যাকা থাকলে বাঘের চক্ষু কিনন যায়। চাল ডালতো কিচ্ছু না।
-হাহাহা! খুব হেসে নিলাম।

পৃথিবীকে সূর্যের মহাজাগতিক ক্ষতিকর অতিবেগুনী রশ্মির প্রভাব থেকে রক্ষা করার জন্য ওজোন স্তরের যে বেস্টনি রয়েছে সিএফসি ও এইচএফসি গ্যাস মূলত সেই বেস্টনি ফুটো করে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। বিশ্বের উন্নত দেশতো বটেই আমাদের দেশের কলকারখানাগুলো কোনোরূপ নিয়ন্ত্রণ ছাড়া ওই গ্যাসগুলো নি:সরণ করে চলেছে। দেশের যত ফ্রিজ বা এয়ার কন্ডিশনার আছে সবগুলোতেই গ্যাস দুটি ব্যবহৃত হয়েছে এবং হচ্ছে। ইদানিংকালে দু'একটি কোম্পানি গ্রিনগ্যাস ব্যবহারের কথা শোনাচ্ছে কিন্তু আগেরগুলোর ব্যবস্থা কী হবে তা তাদের জানা নাই।

দেশে যে পরিমাণ এসি ফ্রিজ ব্যবহৃত হয় তাতে ফিবছর ১৫ ভাগ হারে ক্ষতিকর গ্রিনহাউজ গ্যাস নি:সরণের পরিমাণ বাড়ছে। ঘরে আরামের ঠান্ডা খাচ্ছি আর সামগ্রিকভাবে পুরো প্রকৃতিকেই উত্তপ্ত করে ক্ষেপিয়ে তুলছি। বিকৃত করে ফেলছি স্বাভাবিক জলবায়ু। আর তাই প্রকৃতিও ধীরে ধীরে তার প্ররিশোধ তুলছে। বাড়ছে তাপদাহ, হচ্ছে বজ্রপাত বা ঘূর্ণিঝড়! আপনি ক্রমাগত প্রশান্ত-ধীর পরিবেশের খারাপ করে যাবেন আর নির্বোধের মতো আবার তারই ভালোবাসা চাইবেন তা হবে না।

এসি-ফ্রিজে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ হয় তা দিয়ে অনায়াসে দু'তিনটে বাংলাদেশ চালানো যেত। এই ভয়াবহ গরমে এসির কারেন্ট যুগাতে সারাদেশে মরার ওপর খাড়ার ঘা হিসেবে চলছে লোডশেডিং! বাহানা হিসেবে দেখানো হচ্ছে, ঝড়ে ও বজ্রপাতে বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। চাহিদার সাথে পাল্লা দিয়ে উৎপাদন হচ্ছে না। কিন্তু বিদ্যুৎ নিয়ে ভারি গালগপ্প কিন্তু এখনো থেমে নেই। অবস্থাটা এমন যে বিদ্যুৎ সংকুলান হোক বা হোক, শহুরে মানুষের জুতো বা অন্তর্বাসের দোকানেও শীতলযন্ত্র থাকে কিন্তু প্রান্তিক গ্রামের মানুষটি ছোট্ট একটা পাখা চালানোর মতো বিদ্যুৎও পায় না।

শহুরে অথবা উপশহরের সামর্থ্যবান মানুষেরা একবারও কি ভেবেছেন, অনার্য সাধারণ মানুষ দেশে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ তাদের একঅনু বিদ্যুৎ দিতে পারছেন না কিন্তু আপনার বিলাসিতার গ্রিনহাউজ গ্যাসে তাদেরকে মেরে ফেলবার উপক্রম করছেন। এই গরমে কোনো এক পর্ণ কুটিরে নতুন আসা কোনো এক শিশুর কী অবস্থা? তার ক্রন্দন কি পৌছবে বিলাসীবাবুদের অন্দরমহলে?
…………
পাদটিকাঃ রামপালে নির্মাণ করা হচ্ছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। কয়লা পুড়ে সেই বিষাক্ত গ্যাসই নি:সৃত হবে। মরবে সুন্দরবনের গাছ। গাছ অক্সিজেন দেবে না আবার কয়লা পুড়িয়ে কার্বনও বাড়িয়ে চলব। কী হবে আমাদের ভবিষ্যৎ? আজকের শিশুরা কোথায় দাঁড়াবে?

লেখকঃ সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
সুখেরছায়া
২৪ মে ২০১৭!