লংগদু: পোড়খাওয়া এক টুকরো বাংলাদেশ

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 5 June 2017, 01:36 AM
Updated : 5 June 2017, 01:36 AM

বাঙালির সংবিধান বলে পাহাড়ে আদিবাসী থাকে না, মানুষ থাকে না; থাকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী! রাষ্ট্রের পবিত্র দলিলে যাদেরকে ক্ষুদ্র করে রাখা হয়েছে তাদের মান-মর্যাদার ভুলন্ঠন তাই রোজকার রেওয়াজ। রাষ্ট্র কথিত 'ক্ষুদ্র'রা থাকুক পার্বত্য চট্টগ্রামে, থাকুক গাইবান্ধায় কিংবা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়; নানা ছলছুতোয়, নানা অজুহাতে ওদের জ্বালিয়ে দাও, পুড়িয়ে দাও, দেশছাড়া করে দাও। আর বাঙালির অমানবিক উন্মাদনার জয় হোক; গোল্লায় যাক উদার গণতন্ত্র, বহুভাষা, বহুজাতি বা বহুধর্মের সুশোভন ব্যঞ্জনা।

আমাদের সুন্দর পাহাড়, শান্তির পাহাড়, নয়ন জুড়ানো পাহাড় দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে দুর্মর লাঞ্ছনা, গঞ্জনা আর বঞ্চনার অভিশাপ বয়ে বেড়াচ্ছে। দুই দশক হলো রাষ্ট্রীয় কাজী তার দায়িত্বের অংশ হিসেবে শান্তি চুক্তির কিতাব বানিয়েছে। কিন্তু অধরা শান্তিদের যে পাহাড়ের গোয়ালে অধিষ্ঠানই হলো না! পাহাড়ে পুড়ে যায় কলমপাতি, বানরাইপাড়া, বেলছড়ি, লোগাং, তাইন্দুং কিংবা হালের লংগদু। শিকার হয় লুটেরার, খুনির বা ধর্ষকের। এই ভূমি থেকে অসম্মানে বিনাশ করা হয় কল্পনা, তুমাচিং, সবিতা বা হালের বয়োবৃদ্ধ নারী গুণমালা চাকমাদের।

এক রাষ্ট্রে থেকেও আদিবাসীরা সমতলের সমান নাগরিক নয়। তাদের পরিচয়, ভাষা, ধর্ম ও স্বকীয়তা কেড়ে নিচ্ছে বাঙালির সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিষাক্ত ফ্যাং। এই বিষে সেটেলার, রাজনৈতিক এজেন্ট ও প্রশাসনিক বন্দুকের নল একসুতোয় গাঁথা সমস্বর। পাহাড়কে ধর্ষণ করে, লুটপাটের মগেরমুল্লুক বানিয়ে, দখলের মাৎসন্যায় সাজিয়ে বাঙালি কোরাস গায়ঃ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি কিংবা জয় বাংলা বাংলার জয়। সর্বমানবের ঐকতান ছাড়া এই সুরটা কি আদৌ মানবিক হয়?

সংখ্যাগরিষ্ঠতার এমন মৌলবাদী পাপে এবার পুড়ে গেল প্রকৃতিকন্যা রাঙামাটির 'লংগদু'। লংগদু এইসময়ের পেছনফেরা বাংলাদেশেরই স্মারক যেন। আদিবাসী নারী ও শিশুর পুড়ন-পীড়ন, দেশজুড়েই যার একইরূপ। মানুষের কান্না, নিজের জন্মভিটা ছেড়ে অজানা অচেনায় উদ্ভ্রান্তের মতো হেঁটে চলা; এদের আত্মার আত্মীয় যেন একাত্তরে পাক হানাদারের ভয়াল থাবায় জর্জরিত শরণার্থী কোটি মানুষ। পাকিস্তানি নির্মমতার ভুতের আছড় কি তবে বীর বাঙালির মনন-মস্তিষ্কেও এখনো সচল?

গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, গেল ০১ জুন বৃহস্পতিবার লংগদু উপজেলা থেকে ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালক ও স্থানীয় সদর ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়ন দুইজন যাত্রী নিয়ে দীঘিনালার দিকে রওয়ানা হন। দুপুরের পর দীঘিনালার চার মাইল এলাকায় তার মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে পুলিশকে খবর দেয় স্থানীয়রা। পরে সন্ধ্যায় সোশ্যাল মিডিয়ায় তার মৃতদেহের ছবি দেখে শনাক্ত করে পরিবার ও বন্ধুরা।

শুক্রবার সকালে নয়নের লাশ লংগদুতে তার গ্রামের বাড়ি বাইট্টাপাড়া আনা হয়। সেখান থেকে লংগদুবাসীর ব্যানারে কয়েক হাজার বাঙালির একটি বিশাল শোকমিছিল উপজেলা সদরের দিকে যাওয়ার পথে প্রধান সড়কের পাশের লংগদু উপজেলা জনসংহতি সমিতির কার্যালয়সহ আশেপাশের পাহাড়িদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়। পাহাড়ি আদিবাসীরা দাবি করেছেন, সেই আগুনে পুড়ে মারা গেছেন ৭৫ বছর বয়সী বয়োবৃদ্ধ গুণমালা চাকমা। এ ঘটনার পরপরই লংগদুর আশেপাশে ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। এই ঘটনায় শত শত আদিবাসী এলাকাছাড়া হয়ে পড়েছে। তারা কোথায় যাবে, কোথায় আশ্রয় পাবে, কী খেয়ে বাঁচবে তার খবর কেউ জানে না। শিশু ও নারীদের কি দশা হবে তা অনুভবযোগ্য নয় কিছুতেই।

পাহাড়ি আদিবাসীরা বিভিন্ন ফোরামে দাবি করে এসেছে, ১৯৮০ সালের ২৫ মার্চ রাঙামাটির কলমপতিতে ৩ শতাধিক বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী পাহাড়িকে মিটিং এ ডেকে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে সেটেলার ও তাদের প্রশাসনিক সহযোগীরা। পুড়িয়ে দেয়া হয় ঘরবাড়ি। ত্রিপুরায় শরণার্থী হয় হাজারখানেক আদিবাসী। সেখানকার সব ভূমি এখন সেটেলারদের দখলে এবং বৌদ্ধমন্দির এখন বাঙালি মুসলমানদের মসজিদ। পাহাড়ে বড় নিপীড়ণের সেটাই শুরু। ঐ ঘটনার আগে পরে মিলিয়ে দীর্ঘ ৪৬ বছর ধরে বাঙালি সেটেলারদের শ্যোণদৃষ্টি এড়াতে অন্তত দুই লাখ পাহাড়ি সাধারণ মানুষ ত্রিপুরা বা ভারতের অন্যত্র শরণার্থী জীবনযাপন করছে বলেও পাহাড়িদের দাবি।

অন্যদিকে এযাবৎ প্রায় চার লক্ষ ভূমিহীন বাঙালি কৃষককে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসিত করা হয়েছে, যারা বাঙালি সেটেলার হিসেবে পরিচিত। আর এই সেটেলারদের জীবন ও জীবিকার উপায় হলো, আদিবাসীদের কাছ থেকে দখলকৃত জমি, জল ও জঙ্গল। আর সব হারিয়ে নিঃস্ব পাহাড়িরা নিজভূমেই পরবাসী হয়ে মানবেতর দিনগুজরান করে যায়। এর পরিণতিই অনিবার্য সংঘাতময় পরিস্থিতি।

অভিবাসন পৃথিবীতে বসবাসের সুপ্রাচীন রীতি। উন্নতবিশ্ব তৃতীয়বিশ্বের গুণসম্পন্ন ও সামর্থ্যবান মানুষদের ডেকে নিয়ে তাদের দেশের নাগরিক বানায়। কিন্তু সেই বৈদেশে গিয়ে এখানকার মানুষেরা কি চুরি চামারি, ধর্ষণ, খুন খারাবি বা দখলবাজিতে লিপ্ত হতে পারে? কিন্তু পাহাড়ে বাঙালির কাজ হলো, তাদের জায়গা দখল করা, জমির ফসল চুরি করা, জুমের শস্য লুট করা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করা, পাহাড়ি নারীদের ধর্ষণ আর পাহাড়ি গ্রামে অগ্নিসংযোগ। সেটেলারদের বিরুদ্ধে পাহাড়িদের খুনেরও অভিযোগ রয়েছে বিস্তর। সেটেলার বাঙালিরা কোনোকালেই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সাথে তাদের আত্মিক বন্ধন অনুভব করেনি। এর মূল কারণ হলো, উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও ইসলামী সাম্প্রদায়িকতা। পাহাড়ের সংস্কৃতিকে ভালোবাসবার মতো, চেয়ে দেখে সহ্য করবার মতো ঔদার্য বাঙালি মুসলমানের নেই। পাহাড়িদের খাবারদাবার, চালচলন, পোশাকআশাক, ধর্মীয় কৃত্য মুসলমানের সহ্য করা হয়ে ওঠে না। কার্যত এর ফলাফলই হল দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও সংঘাত।

একসময় সেটেলারদের হাত থেকে নিজেদের প্রাণ ও সম্মান রক্ষায় সশস্ত্র সংগঠন শান্তিবাহিনী গঠন করেছিল পাহাড়িরা। নিউটনের তৃতীয় সূত্র বা টিট ফর ট্যাটে'র নিয়ম মেনে সেই সংঠনের বিদ্রোহীদের হাতে বিপুল সংখ্যক বাঙালিও প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু সেসব ঘটনার নিদান বা বিহিত করতেই জনসংহতি সমিতির তৎকালীন প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা তথা সন্তু লারমা সদলবলে সরকারের ওপর আস্থা রেখে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তি চুক্তিতে উপনীত হয়েছিলেন। কিন্তু কোথায় শান্তি? চুক্তি অনুযায়ী গঠিত পার্বত্য ভূমি কমিশনের কার্যক্রম কী? চুক্তির পর প্রায় অর্ধলাখ উদ্বাস্তু ভারত থেকে ফিরে এসেছিল; তাদের মানবেতর অবস্থা এখনো কাটল না কেন?

অথচ পাহাড়িরা জঙ্গি নয়, লুটেরা নয়, ধর্ষক নয়, রাজাকার নয়; রাষ্ট্রদোহিতার অভিযোগও এখন আর তাদের বিরুদ্ধে নেই। তবে যে ৫ দশকের অবস্থান বদলাল না? আমাদের বিবেকের জগদ্দল পাথর সরল না। ওরা তো কারো দয়া বা সহানুভূতি চায়নি। এই রাষ্ট্রের অধিবাসী হিসেবে ন্যূনতম অধিকারই তাদের চাওয়া, যাতে অন্ততঃ নিজভূমে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবার সামান্য ফুরসৎটা তাদের মেলে। মহারাজ সাধু হবেন আর পাহাড়িরা চোর বটে-এই ধ্যান ধারণার বিমোক্ষণ হতে পারত যদি রাষ্ট্র হতো সদাশয়।

গেল বছর ডিসেম্বরে শান্তি চুক্তির ১৯ বছর পূর্তিতে রাজধানীতে একটি আলোচনা সভায় বাংলাদেশ আদিবাসী ফরামের সভাপতি সন্তু লারমা বলেছিলেন, পার্বত্য শান্তি চুক্তির ১৯ বছর পার হলো। কিন্তু শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি। আমার কাছে এর কারণ দিবালোকের মতো পরিষ্কার। এ সরকারের মধ্যে অগণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সাম্প্রদায়িক উগ্রজাতীয়তাবোধ ও গণবিরোধী চেতনার কারণেই পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন হছে না। এ চুক্তি বাস্তবায়নে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা রয়েছে। এদেশের সিভিল ব্যুরোক্রেসি পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন চায় না।

পাহাড়ের জমি হুকুম দখল করে বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনী ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় দৃষ্টিনন্দন পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে। সেসব দুর্গম এলাকায় রাখা হচ্ছে সকল নাগরিক সুবিধা। যাতে সমতলের সামর্থ্যবান খেয়ালী মানুষেরা সেখানে গিয়ে শীত বা গৃষ্মকালীন অবকাশ যাপন করতে পারে। এতে পাহাড়ের চুড়ায় খড় বা শণের ঘরে বাস করা, পাহাড়ি কলা খেয়ে জীবনধারণ করা আদিবাসীদের সুখ কোথায়?

এভাবে পাহাড়িদের এড়িয়ে গিয়ে, তাদেরকে আর্থ-সামাজিক অগ্রগতিতে সম্পৃক্ত না করে, সেনা নিয়ন্ত্রণ দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের ১০ লাখ আদিবাসীর শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাসের বদল ঘটানো যাবে না। তাদেরকে দেয়া যাবে না স্বাধীন বাংলাদেশের পরিপূর্ণ নাগরিক অধিকার। লংগদু'র ট্রাজেডিই তাই পাহাড়িদের চিরন্তন অনিবার্যতা। এভাবে চললে, শুধু পাহাড়ে না, বাংলাদেশেও সুবোধ আর ফিরবে না।

লেখকঃ সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন
০৩ জুন ২০১৭।