উগ্রবাদের একাল সেকাল!

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 9 June 2017, 06:24 AM
Updated : 9 June 2017, 06:24 AM

১. একালঃ
কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স সম্পন্ন করে মোহাম্মদ শরীফ ৬ বছর ধরে গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানায় কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। কুষ্টিয়ার সাদাসিধে এই মানুষটি থাকেন সদর উপজেলার মাস্টারবাড়িতে। জরুরি কাজে আজ বিকেলে বাড়ি ফিরছিলেন। গাজীপুর-চন্দ্রা রুটে তীব্র যানজট তাই ভিতর দিয়ে বাইপাস সড়কের ভাওয়াল মির্জাপুর হয়ে কালিয়াকৈর পরিবহনের একটি বাসে চন্দ্রা যাচ্ছিলেন। সেখান থেকে কুষ্টিয়ার গাড়ি ধরবেন। আমিও তার পাশের সিটের সহযাত্রী।

ভাওয়াল মির্জাপুর বাজারে এসে যানজটে গেড়ে বসল বাস। আবহাওয়ায় বৃষ্টির পূর্বলক্ষণ। ভ্যাপসা গরম। সবার গা-মুখ বেয়েই শরীরগত লবন-জল ঝরছে। শরীফ ক্লান্তির পেরেশানিটা নিতে পারলেন না। বাসের ডানপাশে জানালায় মুখ বাড়িয়ে জলখাবারের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক যুবকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন।

-ভাই একটু পানি দেবেন?

একমূহূর্ত না ভেবে তেড়েফুঁড়ে এল ছেলেটি। জোটে গেল দু'একজন সাঙ্গপাঙ্গও।

-ওই গাড়ি থেকে নাম। তরে আইজক্যা সাইজ করুম। এত্ত বড় সাহস তুই আমার কাছে পানি চাস!

ইতোমধ্যে গাড়ির চারপাশ দিয়ে কয়েকটি চক্কর খেল ছেলেটি। চালককে বলল:

-গাড়ি এক ইঞ্চি নড়াবি না। নড়াইলে তরে সুইধ্যা বানামু।

বলতে বলতে আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই গাড়িতে ওঠে এল ছেলেটি। লক্ষ্য কুষ্টিয়ার শরীফ। আমি শান্তভাবে বাঁধা দিলাম। বুঝানোর চেষ্টা করলাম। মারাত্মক উত্তেজিত হয়ে পড়ল রাগান্বিত ছেলেটি।

মালাউনের বাচ্চা, রোজার মধ্যে পানি চাস। তর বাপরে চিনস কার কাছে পানি চাইছস?

ইতোমধ্যে সোজাসরল শরীফ গাড়ি থেকে নামার জন্য দাঁড়িয়ে গেছে; ছেলেটি নামতে জোড়াজোড়ি করছে তাই। আমি থামালাম শরীফকে, বসতে বললাম। আরেক হাতে রেগে আগুন হওয়া ছেলেটিকে থামিয়ে রাখলাম। ও শরীফকে মারবেই। গাড়ির যাত্রীরা তামাশা দেখছে; কারো যেন কোনো বিকার নাই।

পরিচয় দিলাম সাংবাদিক। এবার ধর্মীয় অনুভুতি নষ্ট হয়ে অগ্নিগিরি হয়ে যাওয়া ছেলেটি সম্বিৎ ফিরে পেল। গজগজ করতে করতে গাড়ি থেকে নেমে গেল। নীচ থেকেই শরীফের দিকে বিস্ফারিত চোখ তাক করে বলল:

হারামজাদার সাহস কত! ও রোজার দিনে আমার কাছে পানি চায়!

রমজানের দিন, এমনিতেই গাড়ি চলছে না। স্থবির রাস্তাঘাট আর তীব্র গরমে সবাই তিতিবিরক্ত। ছেলেটার বয়স আমার বয়সের অর্ধেকেরও কম। তবু ওর রাগ প্রশমিত করতে আমিই বললাম:

-পানি চাওয়াটা ভুল হয়েছে ভাই, ঠান্ডা হোন প্লিজ।

গাড়ি ছাড়ল। আধাঘন্টা পর ভিমরি খাওয়া শরীফকে জিজ্ঞেস করলাম:

-আপনি ওর কাছে পানি চাইতে গেলেন কেন?
-ভাই রোজা রাখছি। ঘামতে ঘামতে মনে হচ্ছিল শরীরটা পানিশূন্য হয়ে গেছে। একটু মুখ ধুইতে চাইছিলাম। হেলপারকে ১০টা টাকাও দিছি পানি আনতে। ও আসতেছিল না…।

২. সেকালঃ
আমার সম্পর্কিত ফজল মামা একবার এখনকার মতো জ্যৈষ্ঠের এক খরতাপের দিনে বিশেষ কাজে কোনো এক পাহাড়ে গেছেন। আমাদের অঞ্চলে অপেক্ষাকৃত উঁচু লালমাটির ভাওয়াল গড় এলাকাকে পাহাড় বলে। গভীর জলতেষ্টায় এক বাড়িতে ঢু মেরে কোনো এক মহিলাকে দেখতে পেলেন মামা। বিনয়ের সাথে বললেন:
-মা, এক গ্লাস জল দেবেন?

মহিলাটি কিছু না বলেই ভেতরে চলে গেলেন। মামা দাঁড়িয়ে রইলেন জলের অপেক্ষায়, গলা ভেজাবেন বলে।

-জাওরার ঘরের জাওরা, তর বাপে আমারে কবে বিয়া করছে রে! মা বানানির কী শখ!

মহিলাটি ঝাঁটা দিয়ে যেই না এক ঘা দিতে যাবেন, অমনি মামা টের পেয়ে দে ছুট!

৩. উগ্রবাদঃ

কাউকে খামোখা বাপের বউ বানিয়ে মা বলতে গিয়ে ফজল মামা ঝাঁটাপেটা খেয়েছিলেন, সেটা ওইসময় মানা গেছে। এখনো নাহয় মানা গেল। কিন্তু আজ যে ছেলেটি রোজার দোহাই দিয়ে সুশিক্ষিত ও সুশান্ত শরীফের সাথে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করল তা কি কোনোমতেই মেনে নেয়ার মতো? ছেলেটি কি রোজা রেখেছিল? রোজাদারের কি এতো তেজ থাকে? এই ছেলেটিকে তার অন্যায়ের উচিৎ শিক্ষা দেয়া যেত। কিন্তু ক'জনকে আমরা শিক্ষা দেব। কথায় কথায় ধর্মানুভূতি খসে পড়ার যে রোগ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌছে গেছে তা দূরীভূত করবার উপায় খুঁজতে গেলে শত বছর, হাজার বছরও কেটে যেতে পারে। উলটোরথে চলছে আমাদের গতিবিধি; সোজাপথ আর নয় আরাধ্য।
মানুষের মধ্যে নু্ন্যতম সহনশীলতা, ভালোবাসা বা অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের ছিটেফোঁটাও নেই। রোজা ও গরমে নাকাল একজন জলশূণ্য মানুষ মুখ ধোয়ার পানি চাইছে বলে তাকে যে গালিগালাজ ও মারমুখিতার শিকার হতে হলো, এটা ধর্ম নয় চরম অধর্ম। আমরা সবাই কি এখন এই অধর্মেরই বাহাদুর?

ছবি: মোহাম্মদ শরীফ। শরীফকে রক্ষা করতে গিয়ে মারমুখো যুবকের ছবি রাখা হয়নি। তাছাড়া কোনো বেপথো অল্পবয়সী যুবকের প্রতি ঘৃণা বা প্রতিহিংসা উদ্রেক করাও এই লেখার উদ্দেশ্য নয়।

ফারদিন ফেরদৌস
সুখেরছায়া
০৮ জুন ২০১৭।