বর্ষার আবাহনঃ ভালোবাসি শ্রাবণ, জল ও ব্রহ্মপুত্র নদ

ফারদিন ফেরদৌসফারদিন ফেরদৌস
Published : 18 July 2017, 08:45 PM
Updated : 18 July 2017, 08:45 PM


এবারের বরষায় লেখকদের আড্ডায় জলজ জলসা মিলে গেল মন ভুলানিয়া ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে। হৃদয় খুঁড়ে জাগানো গেল কত শত বছরের ঐতিহ্যমন্ডিত বাঙালিয়ানাকে! চোখের তারায় আয়নাবাজি খেলে গেল সুসভ্য প্রাচীন বাংলা। কথা কয়ে গেল আমাদের পথে হেঁটে চলা প্রাজ্ঞ পূর্বপুরুষেরা। ঘুরতে ঘুরতেই গ্রামীণ সবুজ স্বস্তিতে শান্তি কুড়িয়ে নিল নগর লেখকেরা। উপলক্ষটা ছিল ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কমের আয়োজনে বর্ষাযাপন। স্লোগান ছিল 'এসো মিলি বরষার আবাহনে'। ডেটলাইন ৩০ আষাঢ় ১৪২৪/ ১৪ জুলাই ২০১৭। রোজ শুক্রবার।

মেঘমেদুর আকাশকে সঙ্গী করে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ধরে এগিয়ে চলল আমাদের মাইক্রোবাস। বর্ষাকালের রাগ 'মেঘ' ও 'মল্লার'কে পাত্তা না দিয়ে আমাদের শিল্পসুহৃদ জুলফিকার জুবায়েরের দরাজ অডিও যন্ত্রে ভৈরবী-বাউল রাগে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিবিষ্ট মনে গেয়ে চললেনঃ
তুই ফেলে এসেছিস কারে,
মন, মনরে আমার।
তাই জনম গেল, শান্তি পেলি নারে মন,
মনরে আমার।।
যে পথ দিয়ে চলে এলি
সে পথ এখন ভুলে গেলি–
কেমন করে ফিরবি তাহার দ্বারে মন,
মনরে আমার।।
নদীর জলে থাকিরে কান পেতে,
কাঁপে যে প্রাণ পাতার মর্মরেতে।
মনে হয় যে পাব খুঁজি
ফুলের ভাষা যদি বুঝি,
যে পথ গেছে সন্ধ্যাতারার পারে মন,
মনরে আমার।।

আমরা যাচ্ছি, ব্রহ্মপুত্র, মৈমনসিংহ গীতিকা, মহুয়া, মলুয়া, দেওয়ানা মদীনা, চন্দ্রাবতী, কবিকঙ্ক, দীনেশচন্দ্র সেন এবং মুক্তাগাছার মণ্ডা'র এলাকা ময়মনসিংহে। ভৈরবী-বাউল রাগটা তাই বড় যুৎসই মানিয়ে গেল। এমন মধুর সুরে গলা মেলানোর কাজটা দারুণ করে গেলেন, আয়োজনের আহবায়ক, লেখক ও মিডিয়াকর্মী সাজ্জাদ রহমান, সিনিয়র নগর সাংবাদিক নিতাই বাবু, মজিবর রহমান ও মিথুন মিঠু।

কয়েক ঘন্টায় ময়মনসিংহে পৌছতেই আকাশ থেকে গুরুগম্ভীর মেঘেরা হাওয়া। নীল আকাশটাকে ক্যানভাস বানিয়ে সাদা মেঘেরা আঁকা শুরু করে দিল সফেদ আলপনা। মনে করিয়ে দিল শরৎ তোমার বাড়ি নয়ত বহুদূর! আমাদের টিমকে স্বাগত জানালেন সত্যিকারের ব্রহ্মপুত্র, ছবির কবি ও লেখক কাজী শহীদ শওকত। সঙ্গে ছিলেন আমাদের বর্ষাযাপনকে যিনি টেলিভিশনের পর্দায় উপস্থাপন করবেন তার কারিগর ডিবিসি নিউজের স্টাফ রিপোর্টার আশরাফ সিজেল ও ক্যামেরা পার্সন রুবেল রানা।


ব্রহ্মপুত্রের পবিত্র জলে হৃদয় শুচি করবার আগে শহীদ শওকত আমাদেরকে নিয়ে গেলেন শশীলজে। মহারাজা শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর বাড়ি। যে জমিদার বাড়িটি আমরা বিটিভিতে হুমায়ূন আহমেদ রচিত 'অয়োময়' নাটকে একসময় দেখেছি। বাড়িটি সামনের বাগানের মাঝখানটাতে শ্বেতপাথরের ফোয়ারা, যার মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে আছে গ্রিক দেবী ভেনাসের স্বল্পবসনা স্নানরত মর্মর ভাস্কর্য। দেবী ভেনাস এতটা দিন ধরে নির্বিঘ্নে বাংলাভূমিতে শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছে এটা সত্যি অবিশ্বাস্য ও অভাবনীয়!


এরপর আমাদের গন্তব্য আলেকজান্দ্রা ক্যাসেল; মহারাজ শশীকান্ত চৌধুরীর বাগানবাড়ি। মনোরম এই বাগানবাড়ির নির্মাণ-কৃতিত্ব শশীকান্তের পালক পিতা মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর। সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী দত্তকসূত্রে মুক্তাগাছা জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরীর ষষ্ঠ উত্তরপুরুষ। জনকল্যাণকর কাজের পাশাপাশি ময়মনসিংহে অনিন্দ্যসুন্দর কিছু স্থাপনাও নির্মাণ করেন তিনি। লোহার তৈরি সুদৃশ্য ভবনে তৎকালীন ভারত সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ডের পত্নী আলেকজান্দ্রার তৈলচিত্র স্থাপন করেন সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী, তাঁর নামেই এ ভবনের নামকরণ করেন আলেকজান্দ্রা ক্যাসেল। এটিকে 'লোহার কুঠি' বলেই ডাকেন স্থানীয়রা। শোনা যায়, ইংরেজরা ছাড়াও উনিশ শতকের ভারত উপমহাদেশের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিই এখানে বিশ্রাম নিতে আসতেন। সেই সময়ে পাশের একটি ভবনে বর্তমান সময়ের এসি ছাড়াই ২৪ ডিগ্রি তাপমাত্রা বজায় রাখা যেতো। ১৯২৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি এখানে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি বেশ কয়েকদিন এখানে কাটান। এই ক্যাসেল সন্নিকটে ব্রহ্মপুত্র নদ তাঁকে বিমোহিত করেছিল।


এবার রবিঠাকুরের মতো আমাদেরও বিমোহিত হওয়ার পালা। চোখের সামনে ধরা দিল বরষার ব্রহ্মপুত্র। কী তার রূপ! কী তার ছলছল ভরা যৌবন! নদে পালতোলা বাহারি নৌকার এপার-ওপার দেখলেই মন জুড়িয়ে যায়। নদীর পাড় ঘেষে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা ও পার্ক। সেই পার্কে 'ওয়েলকাম টু ময়মনসিংহ' লেখা খচিত মনোলোভা কেক নিয়ে হাজির ইংরেজি ভাষা শিক্ষক কাজী শহীদ শওকতের সহধর্মিনী রাশেদা ইসলাম রাশি ও তাঁদের দুই সন্তান সুমাইয়া তাবাসসুম শৈলী এবং রাগীব সোহবাত নীল। নদের পাড়ে কেক কেটে, হর্ষধ্বনিতে বর্ষা উদযাপন এর আগে কে করেছে কবে? এমন বর্ণাঢ্য সংবর্ধনার সবটুকু কৃতিত্ব ও ভালোবাসা আমাদের সুপ্রিয় রাশি ভাবীর। অশেষ কৃতজ্ঞতা শওকত পরিবার।


জয়নুল আবেদিনের শিল্পকর্ম ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন ঘুরে দেখবার পর শুরু হলো প্রিয় ব্রহ্মপুত্রে আমাদের নৌযাত্রা। হিন্দুধর্মের সৃষ্টির দেবতা ব্রহ্মা। নদীর নাম যদি হয় ব্রহ্মপুত্র, তবে অনুধাবন করা যায় এই পুত্রের সৃষ্টিশীলতার বিশালতা। হাজার বছর ধরে, তিব্বত, ভারত, বাংলাদেশের শত সভ্যতার জন্মদাতা এই ব্রহ্মপুত্রই।

জাতীয় পতাকার রঙে রঙিন পালতোলা নৌকায় শুরু হলো নৌবিহার। ওপারে গিয়ে বাণের জলে পা ভিজিয়ে রাখা চা স্টলে প্রাণভরে চা পান। লেখকদের কারো কাছে তা যেন মনে হলো স্বর্গীয় সূরা। গ্রামবাসীদের সাথে আলাপচারিতা। এপারে ফিরতে ফিরতে শহীদ শওকতের ঠোঁটে বাঁশের বাঁশরি; আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানিরে। আকাশ নীলে সাদা মেঘের নাচন। জলে সূর্যের ঝিকিমিকি। পাড়ে সবুজ-সফেদ কাশফুলের দোলন। নগরের আবর্জনা ক্লেদকে ভুলিয়ে দিয়ে নদীমাতৃক বাংলাদেশকে এভাবে দেখবার এমন সুযোগ ক'জনারই বা জোটে?

বর্ষাযাপনের বিকেলটা মনোমুগ্ধকর হলো আরও। আমরা সাক্ষাৎ পেলাম এমন একজন পুলিশ অফিসারের যিনি কিনা অতি সম্প্রতি নিজের পুলিশ ইউনিটের জঙ্গলভূমিকে স্থানীয় অধিবাসীদের জন্য পার্ক বানিয়ে দিয়েছেন। মুক্তাগাছার ২ আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়ানের কমান্ডিং অফিসার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নজরুল হোসেন। যিনি আলাদা কোনো সরকারি বরাদ্দ না নিয়েই ইউনিটের আয় থেকে নির্মাণ করেছেন মুক্তমঞ্চ, থিয়েটার হল, পিকনিক পার্টির জন্য শেড এবং আধুনিক সুযোগ সুবিধাসম্পন্ন অতিথিশালা। দেখলাম শেয়াল ডাকা জঙ্গল এখন পুষ্পিত শিশুকিশোরদের বৈকালিক আনন্দ আড্ডাখানা। চা-চক্র শেষে পরিচিত হলাম তাঁর হাস্যোজ্জ্বল পরিবারের সাথেও। অনন্তর মঙ্গলকামনায় অধিনায়ক পত্নী ও দুই কন্যার জন্য আমাদের শুভাশিস রাখা থাকল। এমন শিল্পমনা পরহিতবাদী পুলিশ কর্মকর্তাটি তাঁর নির্মিত পার্কের নামটিও দিয়েছেন দুর্দান্ত; 'ধীরে বহো মুক্তাগাছা শিশুপার্ক।' সাধুবাদ প্রিয় নজরুল ভাই।


লেখক জুলফিকার জুবায়ের বলেন, প্রেমে জীবন বাঁচে; আর একটি জীবনকে ভালোবাসা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখবার সামান্য আয়োজনও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম কাজ। মানবিক পুলিশ অফিসার নজরুল ভাইয়ের শিশু পার্কে আমরা তাই সবসময়ের জন্য অমূল্য উপহার দু'খানা বৃক্ষ 'হিজল' ও 'নিমে'র চারা রোপন করে দিলাম। সাথে থাকলেন তরুণ কবি কাজী নাসির মামুন। আর বর্ষাযাপনে বৃক্ষরোপণের অতুল্য আইডিয়াটির রূপকার যিনি তিনি হলেন আমাদের ব্লগের চিরসবুজ ও ট্যালেন্টেড সারেং আইরিন সুলতানা।

আবার সেই রোজকার নগরে ফিরবার কালে মুক্তাগাছার মণ্ডায় সবার মিষ্টিমুখটা মনে রাখবার মতোই হলো। শতবর্ষের পুরোনো মিষ্টান্নে কার রসনা না তৃপ্ত হয়? সারাদিন স্বচ্ছ রৌদ্রশ্রাবণ শেষে সন্ধ্যায় মাঝ রাস্তায় তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়াটা যেন ব্রহ্মপুত্র নদের সাথে বিচ্ছেদের বিয়োগব্যথা হয়েই রইল। বিমুগ্ধ পরিব্রাজকের জন্য মেঘেদেরও কাঁদতে আছে বটে!

'বর্ষার চিঠি' প্রবন্ধে প্রাচ্যের মহামুনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বর্ষা ঋতুকে বাল্যকালের বলে উল্লেখ করেছেন। আর বালকবেলার নিষ্কলুষ সেই চঞ্চলতা, এদিক-সেদিক নির্ভাবনার ঘুরে বেড়ানোটা কে না চায় ফিরে পেতে? মেঘের সঙ্গী করে মনকে খোলে দেবার কালতো এই বর্ষাই। আমাদের বর্ষার আবাহনঃ ভালোবাসি শ্রাবণ, জল, ব্রহ্মপুত্র তাই সার্থক অভীধায় অভিষিক্তই হতে পারে। আনন্দে উদ্ভাসিত এই বরষা নিশ্চিতই আমাদের লেখক পরিবারকে নিয়ে যাবে কবিতা, গানে ও উদযাপনে আগামীর আরো সুন্দর কোনো এক বরষার কাছে!

পুনশ্চঃ আমাদের বর্ষার আবাহনকে কেন্দ্র করে বর্ষা ও শ্রাবণভিত্তিক সংবাদ নির্মাণের জন্য ডিবিসি নিউজ ও সাংবাদিক আশরাফ সিজেল ভাইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা।

ফারদিন ফেরদৌসঃ লেখক ও সাংবাদিক
১৮ জুলাই ২০১৭

অ্যালবামঃ


মাছ ধরছেন সৌখিন জেলে।


নদে নৌবিহারে মেতেছেন ভ্রমণপিয়াসীরা।


নদের বাঁধানো ঘাটে নিতাই বাবু ও সতীর্থরা।


কাজী শহীদ শওকত বাঁশের বাঁশিতে আষাঢ়িয়া সুর তোলেন।


জাতীয় পতাকার রঙে পালতোলা নৌকা ভ্রমণে উথলে ওঠে দেশপ্রেম!


শতবর্ষী তেঁতুল বৃক্ষের নীচে লেখকদের ফটোসেশন।


প্রকৃতিপ্রেমীদের বোটানিক্যাল গার্ডেন পরিদর্শন।


লেখকদের জলজ আড্ডা।